• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ০৬:৫৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ০৭:০০ পিএম

বাংলায় কাজ করে যেতে হবে অবিশ্রান্তভাবে

বাংলায় কাজ করে যেতে হবে অবিশ্রান্তভাবে

মহান ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাগরণ অনলাইনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি “বাংলা ভাষা: ভালোবাসা না কোনঠাসা” শীর্ষক এক বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাগরণ অনলাইন প্রধান বিধান রিবেরুর সঞ্চালনায় তাতে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পশ্চিমবঙ্গের ব্যাকরণবিদ পবিত্র সরকার এবং প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক চিন্ময় গুহ। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী শিশির ভট্টাচার্য্য।

অনুষ্ঠানে করা প্রশ্ন ও পবিত্র সরকারের দেয়া উত্তর এখানে তুলে ধরা হলো। 

 

প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গের সংকট আসলে নানাবিধ। সেখানে হিন্দির একটা আগ্রাসন আছে, ইংরেজিরও আছে এবং বাংলা সত্যি সত্যি কোনঠাসা। গত কয়েক বছর ধরেই সেখানে “বাংলা বাঁচাও” আন্দোলন করছেন তরুণরা, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি।

 

পবিত্র সরকার: দেখো, ‘বাংলা বাঁচাও’ আন্দোলন রাস্তায় নেমে আমরা করছি সেটা একটা জিনিস। তাতে সত্যি সত্যি বাংলা বাঁচছে কিনা সেটা আমার মনে হয় হিসেব নেওয়া দরকার। কারণ, আমরা যারা বাংলা বাঁচাও আন্দোলন করছি আমাদের মধ্যে হয়তো ভালোবাসাটা আছে, কিন্তু কিভাবে বাঁচাতে হবে বাংলাকে, সেই জানাটা হয়তো অনেকের কাছে যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। কারণ, সত্যি সত্যি শহীদ দিবসে যেটা ঘটতে চলেছে শহীদ দিবসে আমরা স্মরণ তো করবই, শোকজ্ঞাপন করব, শ্রদ্ধা জানাবো। কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষা ভারতে একভাবে দুর্গত, বাংলাদেশেও আমি মনে করি একভাবে দুর্গত। তাকে কিভাবে বাঁচাতে হবে সেই সমস্যাটা শিশির (ভট্টাচার্য্য) এবং চিন্ময় (গুহ) দুজনেই বলেছেন। অনুবাদটাতো একটা রাস্তা, কিন্তু অনুবাদ একমাত্র বিকল্প নয়। বাংলা ভাষাটাকে ভালো করে শিখে, ভালো করে ব্যবহার করে, শিক্ষায় শিশির যেটা বললেন সত্যি কথা, শিক্ষায় সমস্ত জায়গায় বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে, সাহস করে আমাদের এটা বলতে হবে। যে মাতৃভাষায় একেবারে সমস্ত প্রযুক্তি, কারিগরী, প্রকৌশলী, বিজ্ঞান, চিকিৎসা সবরকম শিক্ষাই আমরা দিতে চাই। চাই বলে ইংরেজিকে বাদ দিয়ে নয়, বা অন্য ভাষা আমরা শিখবো পাশাপাশি। কিন্তু বাংলায় একেবারে সমস্ত ধরনের শিক্ষা পশ্চিম বাংলা বা বাংলাদেশে করতে হবে। এই দাবির দিকে আস্তে আস্তে যেতে পারি আমরা। আস্তে আস্তে একটা বদলে আরেকটা, একধাপ দু’ধাপ করে যেতে পারি।

সমস্যা আপনারা সবাই ভালো করে জানেন যে, আমরা যে সমাজে বাস করি তাতে ভাষার একটা স্তরভেদ আছে, ক্ষমতার ভেদ। একটা ভাষা বেশি ক্ষমতাশালী, আরেকটা ভাষা তুলনায় কম ক্ষমতাশালী। ক্ষমতাশালী কিসের অর্থে? না, টাকা। যে ভাষা শিখে আমার বেশি রোজগার হবে, যে ভাষায় আমার সাফল্য হবে, সেই ভাষাটার সম্মানও বাড়ে, সে অন্যান্য গুনও থাকতে পারে। অসামান্য সাহিত্যও আছে। এটার সম্বন্ধে আমি বহুবার মধুসুধন দত্তের নাটক থেকে একটা সংলাপ উদ্ধার করি। আপনারা সবাই পড়েছেন—“একেই কি বলে সভ্যতা?”, এই নাটকের একটি অংকে নব আর কালী, এসব বন্ধুরা মিলে, বড়লোকের বখাটে ছেলে, তারা এক জায়গায় আড্ডা দেবে, আমরা যাকে খারাপ জায়গা বলি, খারাপ জায়গা নাও হতে পারে, তো, সেখানে নব’র মদ-টদ আনতে একটু দেরী হয়ে গেছে। দেরী হয়ে যাওয়ার ফলে নব এসে বলছে, আমাকে একটু এক্সকিউজ করতে হবে, আমার একটু লেট হয়ে গেছে। তখন কালি তাকে বলছে, দ্যাটস আ লাই। তখন নব খুব রেগে গেছে। রেগে গিয়ে বলছে, কি তুমি আমাকে লায়ার বল? আমি এখুনি তোমাকে শুট করবো, বন্দুক-টুন্দুক কিচ্ছু নেই কিন্তু বলল। দুজনে মারপিট লাগতে যায়, তখন সবাইকে সামলে নিয়ে অন্য বন্ধুরা বলছে ছি, ছি, একটা ট্রাইফ্লিং মেটারের জন্য বন্ধুতে বন্ধুতে ঝগড়া? তখন নব ফুঁসছে। নব বলছে কি ট্রাইফ্লিং! ও আমাকে লায়ার বললো, সেটা ট্রাইফ্লিং? ও আমাকে বাংলা করে মিথ্যেবাদী বললো না কেন, তাতে কোন শালা রাগতো? বাংলা করে মিথ্যেবাদী বললে রাগতো না। ইংরেজি গালাগাল খেলে লোকে রেগে যায়। আপনারা রাস্তাঘাটেও দেখবেন, ঝগড়া হচ্ছে বাসে, একজন বললো, শাট-আপ। যেই শাট-আপ বললো, ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়াটা একেবারে অন্যমাত্রায় উঠে গেলো। এতে ভাষার ক্ষমতা বোঝা যায়। ক্ষমতার হিসেবটা আমরা সবাই করে চলি।

ফলে ইংরেজি আমাদের, যে কারণেই হোক, ক্ষমতার ভাষা। এই ভাষাটা আমাদের শিখতে হবে, না শিখে উপায় নেই। কিন্ত সঙ্গে সঙ্গে শিশির যে কথাটা বলেছেন যে আমাদের শিক্ষায়, প্রশাসন তো ছেড়েই দিলাম, আমাদের শিক্ষায় বাংলা ভাষাটা শিখলে আমাদের জ্ঞানভিত্তি অনেক শক্ত হবে। নিজের ভাষা জানলে জ্ঞান অনেক শক্ত হয়। সেটার জন্য অনুবাদটা একটা রাস্তা। কিন্তু সেই সঙ্গে আমার ভাষায় কাজ করে যাওয়া, অবিশ্রান্তভাবে কাজ করে যাওয়া, ভালোবেসে কাজ করে যাওয়া, বুঝে কাজ করে যাওয়া, এ কাজগুলোর দরকার আছে, এটাই দরকার। এটাই একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের শপথ এবং সংকল্প হওয়া দরকার।