• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৫:৩৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৯:৩৫ পিএম

ব্যাভিচারে স্ত্রীর শাস্তি যে কারণে হয় না

ব্যাভিচারে স্ত্রীর শাস্তি যে কারণে হয় না

১৮৬০ সালের বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে ধারা ৪৯৭-এ ব্যাভিচারের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ব্যাভিচারের সংজ্ঞাটি লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখানে উল্লেখ আছে, “যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির স্ত্রী অথবা যাকে সে অপর কোন লোকের স্ত্রী বলে জানে বা তার অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোন ব্যক্তির সাথে উক্ত অপর লোকের সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরূপ যৌনসঙ্গম করে যা নারী ধর্ষণের শামিল নয়, সে ব্যক্তি ব্যাভিচারের অপরাধে দোষী এবং যেকোন মেয়াদের কারাদণ্ডে যার মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থ দন্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। অনুরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটি দুষ্কর্মের সহায়তাকারিনী হিসেবে দণ্ডনীয় হবে না।”

ধরা যাক, ক একজন পুরুষ যার স্ত্রী খ-এর সাথে গ ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে, ক গ-এর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে, কিন্তু এক্ষেত্রে স্ত্রী খ-এর কোন শাস্তি হবে না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নারীটি কেন কোন শাস্তি পাবে না? কেন গ এবং খ পরকীয়ায় লিপ্ত হলেও শাস্তি শুধু গ অর্থাৎ পুরুষ ব্যক্তির হবে, নারীর হবে না? কেন এখানে নারীকে ছাড় দেয়া হচ্ছে?

যুক্তিটি খুব সহজ। যদি মালিক এবং সম্পত্তির ধারণাকে আমরা আমলে নিই, তাহলে খ-এর মালিক ক তার সম্পত্তি নিয়ে নেয়া বা ক্ষতি করার জন্য গ-এর উপর মামলা করতেই পারেন। আর গ যেহেতু পুরুষ, অন্যের সম্পত্তি নষ্টের জন্য তার শাস্তি হলেও খ অর্থাৎ নারীটির কিছুই হবে না। কারণ এই আইন অনুযায়ী, নারীটি তার স্বামীর সম্পত্তি, এবং এই আইন অনুযায়ী সম্পত্তির কোন দোষ নেই।

এই আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯(১) ধারায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মূল ধারণা একই। দুটো জায়গাতেই, নারী যে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ, তার যে যৌনতা, যৌনতা চর্চার অধিকার বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে, সেই সকল বিষয়কে অস্বীকার করা হয়। দুটো আইনেই, যৌনতার ক্ষেত্রে নারী প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাকে প্রলোভন দেখানো যায়, এমন একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

পুরুষের বহুবিবাহের স্বীকৃতি থাকলেও, নারীর একই সঙ্গে একের অধিক পুরুষের সাথে বিয়ের বৈধতা ও স্বীকৃতি নেই, তাই নারীকে আইনীভাবে একটি সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে অন্য একটি সম্পর্কে জড়াতে হবে। কিন্তু সমস্যা তখন বাঁধে যখন নারী একটি বিয়ের সম্পর্কে থাকা অবস্থায় অন্য আরেকটি সম্পর্কে জড়ায়। এক্ষেত্রে, নারীর স্বামী তার স্ত্রীর প্রেমিকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যভিচারের মামলা করতে পারেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অধিকার আছে সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার। অর্থাৎ ৪৯৭ ধারাটি ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এই ব্যাপারটির ধরন আদতে সিভিল বা দেওয়ানী।

একজন মানুষ বিয়ে করে ফেললেই আরেকজন মানুষের মালিক হয়ে যান না। কিন্তু ব্যাভিচারের এই ধারাটি বারবার এটাই প্রমাণ করে যে, স্বামী ব্যক্তি মালিক এবং তার মালিকানাধীন স্ত্রী আসলে সম্পত্তি, তাই স্ত্রী অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ালে, মালিক হিসেবে স্বামীর অধিকার আছে তার সম্পত্তিতে প্রবেশ করা অন্য আরেকটি পুরুষের উপর মামলা করার। আবার অপরদিকে, কোন বিবাহিত পুরুষ যদি অন্য কোন নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে সেই ব্যক্তির স্ত্রীর কিন্তু একই ধারা অনুযায়ী ব্যাভিচারের মামলা করার কোন বিধান নেই। কারণ কি? কারণ হচ্ছে, সম্পত্তি আরেকটি সম্পত্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না।

আমাদের সমাজব্যবস্থা যেহেতু পুরুষশাসিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তাই কোন নারী যদি স্বামীকে ছেড়ে অন্য একজন পুরুষের সাথে সংসার করতে চান, সেটা আইনি প্রক্রিয়ায় হলেও, সেই নারীকে ব্যভিচারিণী বলে উল্লেখ করে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করা হতে থাকে। অর্থাৎ, স্বামীকে ত্যাগ করার বিষয়টি এই সমাজে অত্যন্ত ঘৃণিত। অথচ কোন পুরুষ, অন্য একজন নারীর জন্য যদি তার আগের স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান, সেক্ষেত্রে মানুষ এতো প্রতিক্রিয়া দেখান না। কিছু ক্ষেত্রে, সেই নতুন নারী কিংবা আগের স্ত্রীরই দোষত্রুটি খোঁজা হতে থাকে।

সম্প্রতি আরেকটি ঘটনা মিডিয়ায় এসেছে একজন ক্রিকেটার ও তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর ক্ষেত্রে। ক্রিকেটারের স্ত্রীর আগের একটি সংসার ছিলো, যা ত্যাগ করে তারপর তিনি ক্রিকেটারকে বিয়ে করেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, তার আগের স্বামী তাকে অপদস্থ করার জন্য বিভিন্ন পোস্ট দেন এই অভিযোগ এনে যে তারা এখনো বিবাহিত এবং বিবাহিত থাকা অবস্থায় নারীটি ক্রিকেটারকে বিয়ে করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই নারীকে কঠিন সমালোচনা ও তীর্যক মন্তব্যের শিকার হতে হয়। নারীটির প্রাক্তন স্বামীর আচরণ স্পষ্টতই পুরুষতান্ত্রিক আচরণ, কেননা তার পুরুষত্বের অহংবোধ থেকে তিনি প্রাক্তন স্ত্রীর নতুন জীবন মেনে নিতে পারেন নি। আর সমাজ একজন নারীর আরেকবার বিয়ে, নতুন করে জীবন শুরুর ক্ষেত্রে এখনো নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। পুরুষ আগের স্ত্রী সন্তান রেখে, নতুন সম্পর্কে জড়ালে যতটুকু না তাকে অসম্মান করা হয়, একজন নারীকে সেই তুলনায় আরো অনেক গুণ বেশি অসম্মান করা হয়ে থাকে।

মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে একটি চুক্তি, কেউ সে চুক্তিতে অসুখী হলে তালাকের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারেন, এবং ইদ্দতকাল শেষ হলে আরেকটি বিয়েতেও আবদ্ধ হতে পারেন। আইনত এতে কোন সমস্যা নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে মানুষের মানসিকতায়। মননে মগজে বেশিরভাগই যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভাইরাস বহন করেন, তাই ব্যক্তিগত সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও মানুষ সেই বিষয় নিয়ে নাক গলায়, এবং ঘটনায় জড়িত নারীটির চরিত্র বিশ্লেষণে নেমে পড়ে।

 

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী।