• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২১, ০১:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৫, ২০২১, ০১:১৯ পিএম

সাংবাদিকরা বিষণ্ণ, দায় কার?

সাংবাদিকরা বিষণ্ণ, দায় কার?

গণমাধ্যমের একজন সহকর্মী চারদিন আগে অবয়বপত্রের অন্দরে লিখে পাঠালেন কোথাও  যদি কিছু লিখেন সেখানে আমার কথা বলবেন, আর ১০/১২ দিন যদি এখানে চাকরি করতে হতো , তাহলে লাফিয়ে পড়ে মরে যেতাম। কোন জরিপের প্রয়োজন নেই। এমন  বার্তাই স্বাক্ষ্য দেয়, গণমাধ্যমের কর্মীরা কেমন আছেন। প্রায় ছোটবেলাই বলা যায়, তখন একটি শিল্পগোষ্ঠীর বড় পত্রিকায় কাজ করি। সেখানকার বার্তা সম্পাদক , তাঁর যোগ্যতার ঘাটতি মেটাতে সারাক্ষণই চিৎকার চেঁচামেচি করতেন। রিপোর্টাররা তাঁর চেয়ে যোগ্য ছিলেন প্রায় সবাই, তাই তাঁর এই কৌশল। একেক সময় একেক রিপোর্টারকে কখনও ডেস্কের সহকর্মীদের টার্গেট করে চলতো দুর্ব্যবহার।

আমার ঠিক পাশেই বসতেন, এক জ্যেষ্ঠ আপাকে একাধিক দিন বাড়ি চলে যেতে হয়েছে চোখের জল মুছতে মুছতে। একই পত্রিকায় রিপোর্টিং বিভাগের নেতা বদল হতো তিন মাস বা ছয় মাস পরপর। সেই পালাবদলে একজন দায়িত্ব পান, বয়সে সকলের জ্যেষ্ঠ। তাঁরও কৌশল ছিল মানসিক পীড়ন দিয়ে আনুগত্য আদায়। তাঁর সেই পীড়নে আমাদের দুই একজনের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। সেই সময় অন্য পত্রিকাতেও এমন পীড়ন দেওয়ার মতো মানুষ ছিল। তাঁরা ভাবতেন দুর্বব্যবহারই ব্যক্তিত্বের পরিচয়। টেলিভিশন জীবনে এসে পরম্পরায় সেই পরিবেশ পেলাম। শুরুর প্রতিষ্ঠানে দুর্ব্যবহারের ভয়াবহতা ছিল না। ছিল মানসিক সূক্ষ্ম পীড়ন। এটা গণমাধ্যমকর্মীদের তৈরি। বার্তাকক্ষে গোত্র তৈরি হওয়ার প্রভাব।

টেলিভিশন বদল হতে হতে দেখলাম, পত্রিকার দেখে আসা চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না টেলিভিশন। নিজস্ব গোত্র প্রথা গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করেছে যেমন, তেমনি এক গোত্র অন্য গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে। মানসিক পীড়ন থেকে শুরু করে চাকরিচ্যুতিতেও গণমাধ্যমকর্মীদেরই প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে। যেখানে গোত্র স্পষ্টত নেই, সেখানে আবার মালিক পক্ষ বা পরিচালনাকারীদের কেউ কেউ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। উদ্দেশ্য নিজের অযোগ্যতা ও দুর্বলতাকে আড়াল করে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এমন ভয়ঙ্কর মানুষের আচরণে চোখের জল ফেলে অফিস ত্যাগ করতে দেখেছি অনেক সহকর্মীকে। কারো অসুস্থতার কারণও বড় কর্তার অশোভন আচরণ।

দুর্ব্যবহারের মানসিক পীড়নের পাশাপাশি আছে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে যৌন নিপীড়নের ঘটনা। ছোটবড় সব আকারের গণমাধ্যমই এই দোষে দুষ্ট। কোন কোন গণমাধ্যমে যৌন হয়রানির বিষয়গুলো স্পষ্ট হলেও, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। কে বা কারা এধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সবার জানা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দায় চাপায় মেয়েদের ওপরই। অনেক মেয়েই কাউকে কিছু না বলে চাকরি থেকে সরে গেছে। দুই একজন প্রতিবাদ বা নালিশ করেও বিচার পাননি। নিপীড়নকারীরা প্রতিষ্ঠানে রয়ে গেছেন তো বটেই, তার কুকর্মটিও বন্ধ হয়নি, চলমান।

ফলে রয়ে যাওয়া নারীকর্মীরা বাড়তি মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সকলের জানা, গণমাধ্যমগুলোতে বরাবরই বেতনভাতার আকাল লেগে থাকে। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বেতনভাতা হয়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বিষণ্ণ নন। নিয়মিত বেতন পেলেও কর্তৃপক্ষ ও সহকর্মীদের মানসিক পীড়নে তাদের মুখেও স্বতঃস্ফূর্ত হাসি নেই। মানসিক অবসাদে ভুগছেন তাঁরাও। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজনের কথা জানি, যারা পেশা বদল করেছেন। অথচ সাংবাদিকতাকে তাঁরা জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শুধুমাত্র মানসিক প্রশান্তি পেতেই তাদের পেশা বদল।

বিষণ্ণতার বড় একটি কারণ গণমাধ্যমের অপরিকল্পিত বিস্ফোরণ। পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার, অনলাইন কোনটিই বাজার নীরিক্ষার মাধ্যমে হয়নি। রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক প্রভাবের বিস্তার ঘটাতে এগুলোর জন্ম হয়েছে। দক্ষ কর্মী তৈরি না করে একের পর এক গণমাধ্যমের আত্মপ্রকাশে এখাতে কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। একে অপরের সঙ্গে আধিপত্যবাদী প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বেতন ভাতার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। অসময়ে পদোন্নতি দেয়ার রেওয়াজ চালু করেছে। ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে যোগ্যতার দূরত্ব বেড়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিকল্পিত বিনিয়োগ করে একসময় হাপিয়ে উঠে আর বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে চাইছে না। বিনিয়োগের বিশাল দিগন্ত সংকীর্ণ করে নেয়া হচ্ছে।

কর্মীরা অসময়ে পদোন্নতি পেয়ে এমন এক স্তরে দ্রুত গিয়ে পৌঁছে যে, ঐ প্রতিষ্ঠান আর গণমাধ্যম থেকে তাঁর বা তাঁদের আর পাওয়ার কিছু থাকে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই বিষণ্ণতা তৈরি হয় দক্ষকর্মীর মাঝেও, তখন বাধ্য হয় সে বিকল্প পেশা খুঁজে নিতে। আর বিপুল সংখ্যক যে অদক্ষ কর্মী তলানিতে জমা পড়ছে, তা এখন বেশ স্ফীত। অনেকেই অন্য পেশায় যাওয়ার সময় সুযোগ হারিয়ে বসে আছেন। তারা বিকল্প পথ খুঁজে না পেয়ে এখন হতাশায় নিমজ্জিত।

করোনাকালের সুযোগ নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা গণমাধ্যমের ঝাঁপ ফেলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে মুনাফা গুনছে এমন প্রতিষ্ঠানও করোনার ছুঁতোয় কর্মী ছাটাই করেছে। এবাস্তবতাতেও অনেক শিল্পগোষ্ঠী নতুন গণমাধ্যম আনছে, আনবে। সেখানে যোগ দেওয়ার আগে গণমাধ্যমকর্মীদের ভেবে দেখা দরকার, যাচাই করে নেওয়া দরকার, প্রতিষ্ঠানটির গণমাধ্যম নিয়ে ভাবনাটা কতো দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। একই সঙ্গে নিজ দক্ষতা দিয়ে তিনি কতোটা সময় এখানে টিকে থাকতে পারবেন। এই যাচাইবাছাই, বিষণ্ণতাকে কিছুটা হলেও দূরে রাখতে পারবে।

 

গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির অনিশ্চয়তা, গণমাধ্যমের অস্থিরতার জন্য পেশাগত সংগঠনগুলোর বিভক্তি এবং দলবাজীও দায়ী। একারণগুলোর সুযোগ সরকারি বেসরকারি সকল পক্ষই নিচ্ছে। সাংবাদিকরা নিজেদের বিপন্নতায় একাট্টা হতে পারছে না কোন সংকট, দাবি এবং অনিবার্যতায়। ফলে অনিশ্চিত গণমাধ্যমকর্মীরা পেশাগত সংগঠনকে তাঁর অসহায় সময়টাতে পাশে পাচ্ছে না। ফলে লড়াইটা শেষ পর্যন্ত একার হয়ে যায়। বিপন্নতার এই একাকিত্ব গণমাধ্যমকর্মীদের আরো বিষণ্ণতার গহ্বরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যে পরিসংখ্যানটি গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে, সেটি বাস্তবতার নির্যাস মাত্র। বাস্তব পরিস্থিতি আরো করুণ। এর দায়ভার আমি শুধু মালিকপক্ষের কাঁধে তুলে দিতে চাই না। গণমাধ্যমকর্মীদের আন্তঃগোত্রপ্রথার বিলুপ্তি না ঘটা পর্যন্ত, গণমাধ্যমের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক