• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২১, ০৬:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১২, ২০২১, ০১:৪৩ পিএম

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা  নির্বাচন : নাগরিক প্রতিক্রিয়া

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা  নির্বাচন : নাগরিক প্রতিক্রিয়া

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে খুব শিগগির। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যটির প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, বিশেষত রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএমসহ অপরাপর বামপন্থিদলগুলো তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে জোট গঠন করেছে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ। আসন ভিত্তিক দলগুলোর প্রার্থী ঘোষণাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে দলবদল শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে। কেন্দ্রীয় শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপিতেই গিয়েছে এর বেশির ভাগ অংশ। নির্বাচনী এই মৌসুমে অনেক সিনেমা তারকাও যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা মিঠুন চক্রবর্তী। রোববার পশ্চিবঙ্গের ব্রিগেডের মঞ্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতেই তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে রাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর। বেড়েছে নাগরিকদের ব্যস্ততাও। এই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে কোন দল? টানা দুইবার ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলই থেকে যাবে শাসনের দায়িত্বে? নাকি তাদের হটিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসবে বিজেপি? কিংবা দীর্ঘ সময় পশ্চিবমঙ্গ শাসনকারী বামদলগুলোর নতুন জোট বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে? এসব নিয়ে চলছে নানা সমীক্ষা, চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন? —এমনটি জানতেই দৈনিক জাগরণের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পেশার কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে। সেই আহ্বানে তাঁরা লিখে জানিয়েছেন তাঁদের অভিমত। কাজটি সমন্বয় করেছেন সাংবাদিক ফয়সাল আহমেদ।

সুমন ভট্টাচার্য
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

তৃণমূল জিতলে পশ্চিমবঙ্গ কাশ্মীর হয়ে যাবে বলে শুভেন্দু অধিকারী আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন? সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতা তাহলে কি আসলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান মনে করেন? আর হিন্দুত্ববাদী দলে যোগ দেওয়ার পরে তিনিও কি আসলে ‘মুসলিম বিরোধী’ মন্তব্য করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটতে চাইছেন? ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের আগে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে এইগুলো আমার কাছে জরুরি প্রশ্ন হয়ে উঠে আসছে। কারণ এই বছরটা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহেই বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ ভ্রমণ করবেন বঙ্গবন্ধুর স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তাই একদিকে নরেন্দ্র মোদী মুসলিম প্রধান বাংলাদেশকে কাছে টানতে চেষ্টা করবেন, সেখানে গিয়ে শেখ হাসিনার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ‘প্রতিবেশীর সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করবেন, আর তাঁরই দলের নেতারা মোদীর সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের দিকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করবেন, সেটা কি করে চলতে পারে?
শুভেন্দু অধিকারীর ব্রিগেডে করা ‘সাম্প্রদায়িক’ মন্তব্যের জবাব এমনিতে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা টুইট করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আজকের এই ফেসবুক, টুইটার সোশ্যাল মিডিয়ার পৃথিবীতে বিশ্বের কোন প্রান্তে কি হচ্ছে, তা আর কারও জানতে বাকি থাকে না। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গকে যত ‘সাম্প্রদায়িক বিভাজন’-এর রাজনীতি দিয়ে ভাগ করে দখল করতে চাইবে এবং ‘মুসলিম বিরোধী’ জিগির তুলবে, তার প্রভাব তো প্রতিবেশী বাংলাদেশেও পড়বে। ঠিক যেমনভাবে বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হলে পশ্চিমবঙ্গে তার প্রভাব পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের এক দলীয় শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ যেহেতু একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বহু দলীয়, বহু ধর্মীয় সমাজের প্রতীক, সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি সীমান্ত রাজ্যের নির্বাচন এবং নির্বাচনের ইস্যুগুলো গুরুত্বপূর্ণ। 
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্রিগেড থেকে হিন্দুত্ববাদের জিগির না তুললেও এর আগে তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘অনুপ্রবেশ’কে ইস্যু করতে গিয়ে সব অনুপ্রবেশকারীকে ‘উঁইপোকা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। যা নিয়ে ভারতবর্ষের ভিতরে তো বটেই, ঢাকাও যথেষ্ট কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গে শুধু ২৭ শতাংশ মুসলিম বাস করেন না, আন্তর্জাতিক মানচিত্রের দিক থেকেও এই রাজ্যের অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যেই হিন্দু প্রধান দেশ নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আর খুব মধুর নয়। এবং আশ্চর্য সমাপতন, সেই নেপালের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রয়েছে, আর জনজাতির দিক থেকে কাঠমান্ডুর সঙ্গে যে গোর্খাদের ‘আত্মিক’ সম্পর্ক, সেই দার্জিলিংয়ের গোর্খা নেতৃত্বও এই নির্বাচনের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে সরব।
তাহলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন জিততে গিয়ে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি জনসংখ্যার কত অংশকে রুষ্ট করতে পারে এবং কয়টি প্রতিবেশী দেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, সাংবাদিক হিসেবে সেটা আমার কাছে নজর রাখার মতো বিষয়। তৃণমূল থেকে দলে দলে যোগদান করিয়ে বিজেপি এটা প্রমাণ করে দিয়েছে এতদিন তারা মমতার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতি বা স্বজনপোষণের অভিযোগ করত, আসলে তারাও সেটাই অনুসরণ করতে চায়। তাহলে বিজেপি আলাদা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি সীমান্ত রাজ্যে ‘সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ’-এর ক্ষেত্রেই একমাত্র তারা আলাদা। পশ্চিমবঙ্গে তাদের সেই কৌশল সফল হয় কিনা, সেটাই দেখার।

তুহিন শুভ্র মন্ডল
পরিবেশ চিন্তক, নাট্যকর্মী, সংগঠক

এসেই গেল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। টান টান উত্তেজনা চারদিকে। দুঃচিন্তার চোরা স্রোতও আছে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে। শেষ পর্যন্ত কী হবে, কে জিতবে এসব নিয়ে চায়ের কাপে তুফান উঠছে। সর্বত্র একই আলোচনা। তৃণমূল কংগ্রেস কি আবার  ক্ষমতায় থাকতে পারবে? নাকি ভারতীয় জনতা পার্টি প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসবে? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। লক্ষ করে দেখুন, এখানে দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের কথা আসেনি। তাহলে কি বাম-কংগ্রেস-আই এসএফ এবার স্রেফ দর্শকের ভূমিকায় থাকবে? নাকি ভোট কাটাকুটির খেলায় তারাই উঠে আসবে সামনে। নাকি ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও ক্ষমতা দখলের নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে? নানান স্তরে চলছে তার বিশ্লেষণ। পশ্চিমবঙ্গের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমিও তাকিয়ে আছি এই নির্বাচনের দিকে। এবং তাকিয়ে আছি কিছু প্রশ্ন নিয়ে কৌতূহলী চোখে।
বিগত সময়ে দেখেছি নির্বাচন হয়েছে হিংসাস্রয়ী। রক্ত ঝরেছে মাটিতে। বিবাদ-বিসম্বাদে নির্বাচনী হাওয়া হয়েছে চূড়ান্ত উষ্ণতাপূর্ণ। মানুষের লাশ দেখেছে পশ্চিমবঙ্গের আমজনতা। কিন্তু তারা তো এটা চায় না। নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে।মানুষ মারা যাবে কেন? যারা মারা যায় তাদের পরিবার-পরিরজনের অবস্থা কী হয় কেউ ভেবে দেখেছে? কত ধরনের অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়! তাই এবারের নির্বাচন হোক অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। কোনোপ্রকার রাজনৈতিক উত্তাপ যেন প্রাণ কেড়ে নিতে না পারে। এবারের নির্বাচন হোক কর্মসংস্থানের। অসংখ্য যুবক-যুবতী প্রস্তুত তাদের নিজেদের কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের জন্য। সেই সুযোগ করে দিতেই হবে। 
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে বলার আছে। উন্নয়ন হোক। কিন্তু উন্নয়ন হোক প্রকৃতি কেন্দ্রিক। সাসটেইনেবেল ডেভেলপমেন্ট চাই। নদী-জলাভূমি-পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়ন হোক। উন্নয়নের ভুল পথে আমরা চলছি। ইট-কাঠ-পাথরের উন্নয়ন নয়, চাই সবুজ বাঁচিয়ে উন্নয়ন। করোনা পরিস্থিতি দেখিয়েছে প্রকৃতি কতটা শক্তিশালী। তার কাছে মানুষ বড় অসহায়। সেখান থেকে তো শিক্ষা নিতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ টিকিয়ে রেখে উন্নতি করতে হবে। প্রকৃতিকে মান্যতা দিয়ে উন্নয়নের ভাবনা রাখতে হবে। কেননা পরিবেশ যদি ভালো না থাকে তাহলে উন্নয়ন কিসের উপরে হবে? তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দায়িত্বশীল আচরণ চায়। দায়বদ্ধতা চায়। মানুষের ভালো থাকার প্রতি দায়বদ্ধতা। শাসক নয় সেবকের মনোভাব। কোনোপ্রকার বিভেদ-হিংসা-হানাহানি নয়। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সম্ভাবনার বিকাশের মাধ্যমে একটা সোনার বাংলা; যে বাংলা ভারতকে শুধু নয় বিশ্বকে পথ দেখাবে।

রাজু বিশ্বাস
তরুণ কথাসাহিত্যিক  ও সমাজকর্মী

ঈদ বা দুর্গাপূজার চেয়েও বাঙালির ঘরে এখন সবচেয়ে বড় উৎসব ‘ভোট’। নতুন জামা কেনার হিড়িক না থাকলেও রঙ-বেরঙের পতাকা ব্যানার ফেস্টুনে ছয়লাপ শহর থেকে মফস্বল, গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল। আগামী বিধানসভা নির্বাচন ২০২১-কে কেন্দ্র করে উত্তেজনার পারদ প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে। কিছুটা আনন্দ আর অনেকটা আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গের হতদরিদ্র সাধারণ জনতা থেকে উচ্চবিত্ত সকলেই। তবে বরাবরের মতো ভয়টা বেশি নিম্নবিত্ত মানুষের। ভোটে যত মানুষ লাশ হবে তাদের সিংহভাগ তারাই। তারা বোঝে না রাষ্ট্রনীতি-দেশ-সমাজ, রাজনীতির জটিল প্যাঁচ। রুটিরুজির জোগাড়েই যাদের দিনের বেশির সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তারাই চিরকাল বলির পাঁঠা বনে যায়; আর ঠান্ডা ঘরে বসে সেই চিরাচরিত কায়দায় নেতারা টেলিভিশনে বাইট দেন। অবস্থাটা বদলাবে না মোটেও; আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে। কারণ মানুষের ঐক্যকে ভেঙে ফেলার একটা চক্রান্ত চলছে তুমুলভাবে এই বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। বিজেপি আর তৃণমূল দুই বিরোধী শক্তি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যকে দ্বিখণ্ডিত করার নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছে। এর মধ্যে সিপিএম, কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট এবং অন্যান্য দলের জোট শক্তি মিলিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করার যে প্রয়াস চালাচ্ছে তার সাফল্যের একটা বড় সোপান হয়ে রইলো গত ২৮ ফেব্রুয়ারির বামেদের বিগ্রেড সমাবেশ। মাত্র সাত শতাংশ আসন নিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকা বামশক্তি আসলে যে ভীত সন্ত্রস্ত আতঙ্কিত মানুষের মনে আশার সঞ্চার ঘটাতে পারছে, এটা তার একটা বড় প্রমাণ।
বিজেপির ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির দানবীয় উল্লাসে, তৃণমূলের ‘খেলা হবে’ স্লোগানের মারকাটারি প্রয়োগের মধ্যে দিশাহীন সাধারণ মানুষের ‘অন্ন চাই, শিক্ষা চাই, চাকরি চাই, স্বাস্থ্য চাই’ ধ্বনি চাপা পড়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার মতো আরও বহু পরীক্ষা বন্ধ, বেকারত্ব সীমা ছাড়িয়েছে, কোনো নির্ভরযোগ্য কাজের সংস্থান নেই। সমস্ত রকম কলকারখানা বন্ধ। তার উপর অতিমারি করোনার থাবা; সাধারণ মানুষ নাজেহাল। এই ভয়ঙ্কর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন আসলে একটা প্রহসনের মতো মনে হয়। আবার কিছু প্রতিশ্রুতির জন্ম হবে। সাধারণ মানুষ আশায় বুক বাঁধবে। আম্ফানে ঘরের চাল উড়ে গেছে। মাথায় গাছ পড়ে মরে গেছে সন্তান; প্রায়ান্ধকার দিনযাপনের মধ্যে এখন তারা নিয়মিত শুনতে পাচ্ছে নানা আশার বুলি। নতুন ঘর হবে, চাকরি হবে, কারখানা খুলবে, তিন বেলা পেট ভরে খাবার জুটবে... শুনতে শুনতে কখন যে পাঁচটা বছর চোখের উপর দিয়ে চলে যাবে, জানতেও পারবে না তারা। না হবে ঘর, না খুলবে কারখানা, না জুটবে খাবার। অন্ধকার খুপরিতে হতদরিদ্র মানুষ মৃত্যুর দিন গুনতে থাকবে আর নেতা নেত্রীরা গোপন ঘরে বসে হাতে আতর লাগিয়ে ঘুষের টাকা গুনবে। গণতন্ত্রে ভিখারি থেকে রাজা— সকলেরই ভোটের মূল্য সমান! কিন্তু পেটের মূল্য আলাদা। ভোট আসবে, ভোট যাবে; কিন্তু সমাজ কি বদলাবে? আসবে নতুন দিন? জানা আছে কারো?

কণিষ্ক ভট্টাচার্য
কথাসাহিত্যিক

স্মৃতি কেবল অভিজ্ঞান নয়, স্মৃতি আসলে আয়ুধ। ঋত্বিককুমার ঘটক তাঁর ছবিতে বিজন ভট্টাচার্যকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘এরা মন্বন্তর দ্যাখে নাই, দাঙ্গা দ্যাখে নাই, দেশভাগ দ্যাখে নাই...’ ফলে সেই না-দেখা প্রজন্মকে ঋত্বিকের চরিত্র দেখে শহরে এক ‘বীভৎস মজা’য় নিমজ্জিত হতে। যে স্মৃতি সময়ের স্রোতে-প্রতিস্রোতে ভেসে না যাওয়ার শক্তি জোগায় সেই স্মৃতির অনুপস্থিতি আমাদের মানসিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্রমশ অবশ করে। ফলে শিথিল পেশি অসাড় মন তখন আত্মসমর্পণ করে স্রোতের কাছে। অথচ এই প্রতিস্রোত নতুন কিছু নয়। বাংলার ইতিহাস ঔপনিবেশিকতার আমল থেকেই যুগপৎ হাঁটেনি বাকি ভারতের সঙ্গে। কেরানি তৈরির ইস্কুলের অপুষ্ট শিক্ষার মধ্যে থেকে বাংলা শুষে নিয়েছিল জীবনের নির্যাস। ইউরোপের বাইরে অপরাপর মহাদেশ যখন মানবমূল্যে জীবনকে যাচাই করে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেনি, সেই সময়ে এশিয়ার প্রান্তে থাকা বাংলা প্রগতি আর মানবতার নতুন আলোয় পথ চিনে চলেছিল। আমাদের একটা ভাঙাচোরা অপূর্ণ বিকশিত হলেও নবজাগরণ ছিল। প্রগতিভাবনার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিরোধী রক্ষণশীল শক্তি জেগে উঠলেও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কখনো তাদের হাতে যায়নি। এই নবজাগৃতি ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে মুক্তির সন্ধানী ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এমনকি সেই আন্দোলন ভূমি সংযোগহীন অথবা উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠলে এই বাংলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ তীব্র কণ্ঠে সতর্ক করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসক বাঙালি জাতিসত্তাকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করতে চাইলে নজরুল সেই জাতির মিলনান্তিক স্বরূপ চিনিয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে আপোষকামী দেশীয়শক্তি যখন বারবার মুচলেখা দিয়ে শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে বিভেদের উস্কানি দিয়েছে তখন রুখে দাঁড়িয়েছে সম্মিলিত শ্রমিকশ্রেণি। তবু শাসক বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বে ফল বহন করতে হয় বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার মাধ্যমে। যার সাক্ষী উত্তর-বিশ্বযুদ্ধ সবচেয়ে বড়ো জাতিগত এক্সোডাস। 
স্মৃতি, জাতিগত যৌথ-স্মৃতি শুধু রক্ষা করে একটা জাতিকে তার সম্ভাব্য পতনের থেকে। তার শিকড়কে সহায়তা করে মাটি আঁকড়ে থাকতে। দেশভাগের গণনাতীত, অনিয়ন্ত্রিত, বিকল্প ব্যবস্থাহীন উদ্বাস্তু মানুষের স্রোতকে স্বাধীন ভারতের আর কোনো রাজ্যকে স্থান দিতে হয়নি যা বাংলাকে হয়েছে। খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় ভাত-রুটির বদলে মাইলো খেয়েছে এই রাজ্যের মানুষ আর ক্ষুধার্ত মানুষের আন্দোলনে শাসকের পুলিশি লাঠি প্রাণ নিয়েছে আশিজন অভুক্তের। ‘শিক্ষার দাবি জাতীয় দাবি’র আন্দোলনে চলেছে গুলি। হ্যাঁ, স্বাধীন দেশের রাজ্যে। পশ্চিমবাংলায়। এদিকে ঔপনিবেশিক আমলের শিল্প বিকাশের কারখানা পড়েছে এই রাজ্যে আর তার কাঁচামাল উৎপাদনের জমি হয়ে গেছে বিদেশ। তার সঙ্গে মাশুল সমীকরণ নীতি আর লাইসেন্স প্রথায় বিকশিত হয়নি নতুন যুগের নতুন শিল্প। পুরনো ন্যুব্জ শিল্পে উৎপাদন কমে যাওয়ার নিদান দিয়েছে শিল্পপতিরা নির্বিচার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার গড়ে উঠেছে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে ছুতো করে বন্ধ হয়েছে একের পর এক আধুনিকীকরণ না হওয়া কারখানা। স্বাধীনতার বিশ বছরের মধ্যে যৌবনের তীব্র স্বপ্নভঙ্গ এই ব্যবস্থাকেই উৎখাত করে দিতে চায়। সারা পৃথিবীতেই তখন চলছে ছাত্র বিক্ষোভ। নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে ছাত্ররা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে। গোটা ভারতে সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে এই বাংলা থেকেই। তবু ব্যবস্থা বদলাতে গিয়ে ব্যক্তিহত্যার কানাগলিতে আর রাষ্ট্রীয় বুলেটে মহৎ স্বপ্নের মহত্তর বিনষ্টির সাক্ষী থাকে এই রাজ্য। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে জাঁকিয়ে বসা জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ স্বাধীন দেশে আইন করে হলেও নানান ফন্দিফিকিরে ধরে রাখা জমি ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ফিরিয়ে দেওয়া হয় চাষির হাতে। লাঙল যার জমি তার স্লোগানের অনেকটাই পূরণ হয়। প্রান্তিক চাষির হাতে জমি যাওয়ায় ফসলের উৎপাদন বাড়ে। খানিকটা আর্থিক সুরাহা যেমন হয় তেমনই সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নেন প্রান্তিক মানুষ। ফলে বিদ্যালয় শিক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ে। তবু আরও যা হতে পারত তার অনেকটাই অধরা থেকে যায়।
নয়ের দশক কেবল এক খোলাবাজারের ধান্দাপুঁজির অর্থনীতি নিয়ে আসে না, নিয়ে আসে বিকল্পহীনভাবে আদর্শের মৃত্যুর প্রচার। নিয়ে আসে ভোগবাদের দর্শন আর ইতিহাসের মৃত্যুর কথা। সমষ্টির বদলে ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে ‘অর্ডার অব দ্য ডে’। কল্যাণকামী রাষ্ট্রে নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর গৃহীত ব্যবস্থাগুলো প্রত্যাহৃত হওয়া শুরু হয়। যাদের তা আটকানোর কথা ছিল তারাও ক্রমাগত দিশাহীন হয়ে পড়ে নতুন বিশ্বব্যবস্থার ভাবনার কাছে। তাদের সমষ্টিভিত্তিক দর্শনের ঠিক বিপরীত এই ব্যক্তি উচ্চাশাকেন্দ্রিক এই ভাবনাকে কী করে প্রতিহত করা যায় তার কোনো পথ খুঁজে পায়নি তারা বিশ্বজুড়ে। সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ এই বিশ্বনির্লিপ্ত আত্ম-উদযাপনকে ক্রমাগত প্রলুব্ধ করে সমষ্টির থেকে বিযুক্ত হতে। ঋত্বিক কথিত সেই ‘বীভৎস মজা’য় নিমগ্ন সমাজকে তার আত্ম-স্মৃতি জাগরুক করানোর কেউ ছিল না এই বলে, ‘এরা যুদ্ধ দেখেনি, মন্বন্তর দেখেনি, দাঙ্গা দেখেনি, দেশভাগ দেখেনি এমনকি মুক্তির দশকের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ দেখেনি।’ যারা যুদ্ধ মন্বন্তর দাঙ্গা দেশভাগ দেখেছিলেন আজ তাঁরা অশীতিপর বা নবতিপর। এমনকি মুক্তির দশকের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গে আন্দোলিত মানুষেরা অন্ততপক্ষে অবসরপ্রাপ্ত বা সত্তরোর্ধ্ব। তবু আজ যাঁরা এদেশে বা এ রাজ্যে সর্বাধিক সংখ্যায় আছেন তাঁরা হয়তো-বা এই সবকিছুর থেকে আরও গভীর আরও অন্তর্ঘাতী ইতিহাসের সাক্ষী, যে ইতিহাস তৈরি করেছে ফাটকা পুঁজির সঙ্গে অবমূল্যবোধের হাত ধরাধরির মাধ্যমে। সেই প্রাক বিশ্বায়িত পুঁজির মানুষেরা অন্তত চল্লিশোর্ধ্ব। তাঁরা দেখেছেন সামাজিক অন্তর্ঘাতের মধ্যে দিয়ে কীভাবে দেশে ধর্মীয় রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আর বিগত বিশ-তিরিশ বছরে খোলাবাজারে সারা পৃথিবীতেই সেই পুঁজির সংকট যত বেড়েছে ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সামাজিক প্রকৌশল আর অপরিকরণ। শাসকের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা সংখ্যালঘুকে চিহ্নিত করতে চেয়েছে সমস্ত দুর্দশার কারণ হিসেবে। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রতিবেশীর দিকে আঙুল তুলে নাগরিকের চোখে ধুলো দিয়েছে বারবার। অথচ এসবকিছুর স্মৃতি নেই সহস্রাব্দের জাতকদের। যারা আজকের নবনাগরিক। 
এই সংকটের মধ্যে জাতিগত যৌথ স্মৃতি, আমাদের অভিজ্ঞান, যা হয়ে উঠতে পারত আমাদের আয়ুধ, তাকে আত্মপরায়ণতার দর্শন ভুলিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে। আত্ম-উদযাপনের মোহে আমরাও নিয়ত চর্চায় তাকে জাগিয়ে রাখতে পারিনি। সত্তরোর্ধ্ব আমাদের প্রৌঢ় স্বাধীনতা আমাদের এমন এক সমাজ এনে দিয়েছে যেখানে রাজনৈতিক শাসকগোষ্ঠীর কাছাকাছি না-থাকলে সমাজের অধিকাংশের জীবনজীবিকা সুরক্ষিত হয় না। ফলে শাসক বদলালে অধিকাংশ নাগরিককে তার আনুগত্য বদলাতে হয়। জীবনের কোনো মুহূর্ত বা অবস্থান অরাজনৈতিক না-হলেও অ-দলীয় হতেই পারত। কিন্তু দলীয় আনুগত্যহীন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠেনি আমাদের। রাজনৈতিক দল বা নাগরিক সমাজ এখানে প্রত্যুপকারে অন্বিষ্ট থেকেছে। আবার রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তন যাঁদের জীবন-জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করে না তাঁরা নিজেদের ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ ভেবে রক্ত-আলোর মদে-মাতাল ভোরেও যে-যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায় বসে তাঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়হীন পুচ্ছটি উচ্চে তুলে নাচানোকেই কর্তব্য বলে মনে করেছেন। শাসকের দ্বারা আক্রান্ত শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের স্বার্থের মিল হয়নি বা যতটুকু হয়েছে তা তাঁদের এক সুতোয় বাঁধতে পারেনি। ফলে ভারতের স্বাধীনতা ও সংবিধানের সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রস্তাবনা সত্তরাধিক বছর পার হয়ে এলেও আজ দিনান্তে কোনো রাজনৈতিক নেতা জনসমক্ষে বলতে পারছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় ঐতিহ্যের পথে বাধা। আর প্রতিদিন নাগরিক জীবনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অধিকারগুলো বিক্রি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে শাসকের কাছাকাছি থাকা পুঁজিপতিদের হাতে। আমরা নাগরিকেরা প্রতিদিন টুকরো হচ্ছি জাতে-ধর্মে-বর্ণে-ভাষায়-শিক্ষায়-পেশায়। আমাদের লড়াই করার আয়ুধ নেই। যেই আয়ুধ নির্মিত হতে পারত এই বিস্মরণের কালে কেবল স্মরণ দিয়ে। এই ভুলে যাওয়ার সময়ে কেবল মনে রাখা দিয়ে। আমাদের জাতিগত যূথস্মৃতি হয়ে উঠতে পারত আমাদের আয়ুধ নির্মাণ সংস্থা।