• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২১, ০১:৩৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৫, ২০২১, ০১:৪৮ পিএম

দুর্ঘটনা

সবকিছু ভেঙে পড়ে!

সবকিছু ভেঙে পড়ে!

দেশজুড়ে এখন উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। সবকিছুর ওপরে পদ্মা সেতু তো আমাদের সামর্থ্যের, সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক হয়ে এগিয়ে চলছে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, সারা দেশে অবকাঠামো খাতে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি হয়েছে। ঢাকায় বসে আসলে এটা বোঝা সম্ভব নয়, কীভাবে গ্রামে-গঞ্জে বদলে গেছে বাংলাদেশ। যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে ওঠা মানেই অর্থনীতি সচল হওয়া। বড় বড় সড়ক-মহাসড়ক বা সেতু তো আছেই, গ্রামেগঞ্জে আঞ্চলিক যোগাযোগেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। আমার পরিচিত এক ডাক্তার বন্ধু অজপাড়াগাঁয়ে জমি কিনেছিলেন শেষ বয়সে নিরিবিলি থাকবেন বলে। কেনার কিছুদিন পর সেই এলাকার মানুষ খুব খুশি, তাকে জানাল, ডাক্তার সাহেব আপনার জমি তো সোনার হরিণ হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা চলে যাচ্ছে। শুনে সেই ডাক্তার খুব মন খারাপ করলেন এবং সেই সোনার হরিণ বিক্রি করে দিলেন। কারণ, তিনি নিরিবিলি থাকতে চেয়েছিলেন। রাস্তা চাননি।

আমার নিজেরও খুব ইচ্ছা শেষ জীবনটা নিরিবিলি কোনো জায়গায় কাটানো, যেখানে কোনো গাড়ির হর্ন শোনা যাবে না। এখন বাংলাদেশে তেমন জায়গা খুঁজে পাওয়াই কঠিন। ভেবেছিলাম, সারা দেশ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় এলেও আমার মামাবাড়ি হয়তো কখনো তেমন হবে না। ছেলেবেলার স্মৃতি মনে আছে, মামাবাড়ি যেতে হলে বর্ষাকালে নৌকা এবং শুকনা মৌসুমে পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। দাউদকান্দির রঘুনাথপুরের সেই অজপাড়াগাঁয়েই আমার জন্ম। ভেবেছিলাম জন্মস্থানেই হয়তো নিরিবিলি শেষ জীবনটা কাটানো যাবে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে অনেক বছর পর মামাবাড়িতে গিয়ে খুবই মন খারাপ হলো। যে ঘাটে নৌকা ভিড়ত, সেখানে এখন গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। যেটা নিয়ে আমার মন খারাপ, সেটা নিয়েই সবাই উৎফুল্ল। সবাই সরকারকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। দুর্গম হাওরের বুক চিড়ে যখন দৃষ্টিনন্দন সড়ক হয়, পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে যখন আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তখন বাংলাদেশে আর অসম্ভব কিছুই নেই।

মাঝে মাঝে গ্রামে গেলে আমরা অবাক হই। তবে শুধু গ্রামে কেন, ঢাকা শহরেই উন্নয়ন বিস্ময় কম নয়। মহাখালী, খিলগাঁও, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল ফ্লাইওভার তো আমাদের চোখের সামনেই হয়েছে। এখন চলছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র‍্যাপিড ট্রানজিটসহ নানা প্রকল্প। রাজধানীর ক্রমবর্ধমান যানজট নিয়ন্ত্রণে এসব প্রকল্পের কোনো বিকল্প নেই। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার হওয়ার আগে সড়কপথে চট্টগ্রাম যাওয়া ছিল দুরূহতম কাজ। প্রায়ই ভাবি ঢাকার ফ্লাইওভারগুলো না হলে ঢাকার অবস্থা এখন কী হতো? এত কিছুর পরও যানজট পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। হয়নি কারণ ফ্লাইওভারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ আর গাড়িও বাড়ছে। তাই একেকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হতে হতে যানজটের চাপ তাতে সমন্বয় হয়ে যায়। শুধু ঢাকা নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামও এখন ফ্লাইওভারের নগরী। সেসব ফ্লাইওভার কতটা পরিকল্পিত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে বটে, তবে ফ্লাইওভারগুলো না হলে চট্টগ্রামও স্থবির হয়ে পড়ত।

এই যে নির্মাণযজ্ঞ, তাতে কিন্তু মানুষের ভোগান্তির অন্ত নেই। একেকটি উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে যে কত মানুষের বছরের পর বছর দুর্ভোগের হাহাকার জড়ানো, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবু সবাই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় হাসিমুখেই সেই দুর্ভোগ মেনে নেন। সবাই একে বলেন উন্নয়নের প্রসব বেদনা। সুন্দর শিশুর জন্মের আকাঙ্ক্ষায় প্রসব বেদনা মানতে আপত্তি নেই। কিন্তু সেই বেদনা যদি প্রাণঘাতী হয়, তাহলে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

গত রোববার মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পে দুটি দুঘর্টনা ঘটে। এক জায়গায় পিলার, অন্য জায়গায় লঞ্চিং গার্ডার ধসে পড়ে। এতে দুজন চীনা শ্রমিকসহ মোট ৮ জন আহত হয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ, দুর্ঘটনা বড় হলেও প্রাণহানি ঘটেনি। এ দুটি দুর্ঘটনাই বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত। নির্মাণ প্রকল্পে দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, মালিবাগ ফ্লাইওভারে গার্ডার ধসে প্রাণহানি ঘটেছিল। এ ধরনের প্রথম কোনো দুর্ঘটনাকে আমরা ‘দুর্ঘটনা’ বলে মানতে রাজি আছি। কিন্তু বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে তখন আর সেটাতে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া কঠিন। এসব দুর্ঘটনার জন্য দুর্নীতি, অনিয়ম, খামখেয়ালি, অদক্ষতা, নজরদারির অভাব দায়ী। এ ধরনের প্রথম দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যবস্থা নিলে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে পরের ঘটনাগুলো আর না-ও ঘটতে পারত। কিন্তু আমাদের শিক্ষা হলো আমরা আগের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিই না। আর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নিতে পেরিয়ে যায় বছরের পর বছর। তাই কেউ সাবধান হন না। তাই বারবার ছোট বা বড় দুর্ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞ চলছে এটা যেমন সত্যি, আবার উন্নয়নের পাশাপাশি চলছে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার মহাযজ্ঞও। সড়ক-মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। বরাদ্দের সবটা যদি উন্নয়নকাজে ব্যয় হতো, তাহলে বাংলাদেশ আরও অনেক আগেই বদলে যেতে পারত। কিন্তু বরাদ্দের অনেকটাই চলে যায় ঠিকাদারের লোভের পকেটে বা ইঞ্জিনিয়ারের কমিশনে। ঠিকাদাররা অভিযোগ করেন, তাদের কাজ পেতে কমিশন দিতে হয়, বিল পেতে হয়, স্থানীয় মাস্তানদের সামলাতে হয়। তারপরে নিজের লাভ। এভাবে উন্নয়ন বরাদ্দের অনেকটাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এ কারণেই বাংলাদেশে উন্নয়ন ব্যয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। ব্যয় বেশি হওয়ার পরও নির্মাণকাজে রডের বদলে বাঁশ, উদ্বোধনের আগেই সেতু ধসে পড়ার খবর আসে। এসব দেখেশুনে আমার খালি হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’র নামটি মনে আসে।

শুরুতেই বলেছি, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সত্যি সত্যি বদলে গেছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। বদলে যাচ্ছে ঢাকার চেহারাও। কিন্তু শুধু উন্নয়ন হলেই হবে না, তা হতে হবে নিরাপদ ও টেকসই। এ জন্য নিশ্চিত করতে হবে নির্মাণকাজের নিরাপত্তা ও মান। রাশ টানতে হবে দুর্নীতির, অপচয়ের।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক