• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২১, ০১:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৯, ২০২১, ০১:১৯ পিএম

সাম্প্রদায়িক হামলা থামাবে কে?

সাম্প্রদায়িক হামলা থামাবে কে?

চুপ করে আছি আমরা। চুপ করেই থাকব। এমন সময় কেমন করে যেন আমাদের সুনসান নীরবতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। এই অবকাশের ছুতো, পালিয়ে যাওয়ার। চোখ বুজে থাকার। সমাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার। এই লুকোচুরি খেলাতেই মেতে আছি আমরা। কে কোভিড ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে ব্যথা পাননি, কার তৃতীয় বিয়ে বা সন্তান হলো, আটটি আমের আঁটি চুষল কে, কোথায় কোন রাজনৈতিক নেতা বসে চা খেল বা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ছবি তুলল, তাতেই চমৎকার, বাহ চমৎকার বলে অবয়বপত্র ভাসিয়ে দিচ্ছি আমরা।

বীভৎস নিপীড়নের ছবি তুলে দিতেও মুহূর্ত দেরি করি না আমরা। বলা যায় কুৎসার এক সমাজ তৈরি করে ফেলেছি। যে চমৎকার সহমত সংগীতের কথা বলছি, সেটিও তৈরি হয়েছে অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর নিমিত্তে। কুৎসা কোথায় নেই? রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে শুরু করে ধর্মীয় জমায়েত সর্বত্রই আছে। জনগণকে সহিষ্ণু হওয়া, বিপক্ষের মতামত গ্রহণ করার মতো মানসিকভাবে তৈরি করা, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ তৈরিতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন ও নেতার ভূমিকা থাকার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি বিপরীত চিত্র। ধর্মের মূল আদর্শ ও শক্তি থেকে সরে গিয়ে ধর্মচর্চা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় রূপ নিচ্ছে রাজনীতির মতোই। ফলে এক বিশ্বাসের মধ্যে বহু গোত্রের উত্থান। পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নেওয়া আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা সুযোগ হারাতে চান না, তাদের অভেদ্য লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যভেদ করতে গিয়েই দেখছি সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত আসছে একের পর এক। রামু , মানিকগঞ্জ , ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে খেলোয়াড়রা এখন সুনামগঞ্জের শাল্লার ময়দানে।

একসময় ওয়াজ মাহফিলে যেতাম। বয়ান শুনতাম। দেখতাম আলেমরা নবী রাসুলের জীবন নিয়ে আলোচনা করতেন। সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনে নবী, রাসুল ও কোরআনের আলোকে নির্দেশনা দিতেন। কখনো তাঁদের পারস্পরিক গিবত করতে দেখিনি। নিজ গ্রাম থেকে শুরু করে শহর, এমন অভিজ্ঞতাই ছিল। সেই আলেমরা তাঁদের অনুসারীদেরও কখনো উত্তপ্ত করে তুলতেন না। এখন ইউটিউবে দেখি, শুনি মাহফিলে ইসলাম বা ধর্মের আচার নিয়ে যতটা না কথা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হয় অন্য আলেম, রাজনীতি এবং অবয়বপত্রের ভাইরাল ইস্যু। যে বক্তব্য শুনে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অন্ধ বিশ্বাসে যে কেউ প্ররোচিত হতে পারে। একইভাবে এসব বক্তব্যকে উসকে দিয়ে মাঠে ঝড় তোলার মানুষ কম নেই। খামোখা কটূক্তি করে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। এতে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক বন্ধন, তাতে চিড় ধরানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সেই অপচেষ্টাতে যখন একের পর এক মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা ভাঙা হয় তখন চুপসে যাই আমরা। ভয়ে। ধর্মকে ভয় পাই আমরা। স্পর্শকাতর ভাবি। অনুভূতিতে আঘাত লাগবে ভাবি। রাজনীতির জ্বালানি ভাবি। কিন্তু সাধারণ মানুষ কিন্তু তা ভাবে না। তারা সহিষ্ণু। একে অপরের সঙ্গে এক ভিটায় থাকতেও তাদের আপত্তি নেই। নারায়ণগঞ্জের শাব্দি গ্রামে দেখেছি ব্রহ্মপুত্র নদের কূলে মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি। আমার গ্রামে এখনো যে পুকুরে মুসল্লি ওজু করেন, সেই পুকুরে থেকে পানি তুলে নিয়ে যান হিন্দু নারী। আমার গ্রামে মাহফিলে, পুজোতে যোগ দেন উভয় ধর্মের মানুষেরা। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধদের নানা সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছি। যোগাযোগ আছে এখনো। দেখছি একবিন্দু চিড়ও ধরেনি পরস্পরের মাঝে। আমরা অবয়ব জগতের বাসিন্দারা, যারা নিজেদের সমাজচিন্তক ভাবি, তারাই নিজেদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করছে।

সুযোগমতো আওয়াজ তুলি আবার কায়দা করে চুপ মেরে যাই। সুবিধাজনক অনিকেত প্রান্তরে থাকব বলে। শাল্লার ঘটনার পর আমরা পুরোনো দৃশ্যই দেখছি। মামলা, ধরপাকড়, চার্জশিট। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে একটি জনপদের, একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন দেখা দিল, তা থেকে তো নিস্তার নেই। এই পীড়নের শিকড় বিস্তৃত অনেক দূর।

চিন্তকদের ওপর আমার ভরসা নেই। ভরসা রাখতে চাই স্থানীয় রাজনৈতিক দল, নেতা ও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি। তাঁরা যদি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, একে অপরের মতকে স্বাগত জানান এবং অসহিষ্ণুতাকে নিজ অনুসারীদের মধ্যে বিতরণ করেন, তবে শাল্লাই হতে পারে শেষ লজ্জা।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক