
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে উৎসব এবং উদযাপনের পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও উচ্চারিত হচ্ছে যে ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না। কোনো জাতির যাত্রাপথ সরলরৈখিক নয়, তাতে আসে বিভিন্ন বাঁক–বাংলাদেশ তা থেকে ভিন্ন নয়। গত ৫০ বছরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রাপথ অবশ্যই সরল বা একরৈখিক ছিল না। আত্মসমীক্ষার তাগিদে তোলা এই প্রশ্ন কীভাবে করা হচ্ছে, কোন বিবেচনা দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা পরিমাপ করা হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি বা আপনি কোন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, সেটা হয়তো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্ত রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা নিরূপণে সেটা কতটা যথাযথ, তা ভেবে দেখা দরকার।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। তাঁরা সবাই একই ধরনের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, এমন মনে করার কারণ নেই। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন –পাকিস্তানি রাষ্ট্র যাকে যেভাবে বঞ্চিত করেছে সেই শ্রেণির মানুষ তারই অবসানের স্বপ্ন দেখেছে। সেটা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কারও কারও বিবেচনায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই অর্জনের স্বপ্ন ছিল, আবার কারও কারও কাছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে তা অর্জনের বিকল্প ছিল না। এ কথা মনে করার কারণ নেই যে এমনকি যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁরা একই ধরনের রাষ্ট্র গঠনের কথা ভেবেছেন। যে শ্রেণি পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে তাঁর শ্রেণির অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা নেই বলে ভেবেছেন, তাঁরা যে রাষ্ট্র চেয়েছেন সেটা, আর যারা পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে কাঠামোগতভাবে নাগরিকের অধিকার এবং অংশগ্রহণের সম্ভাবনা দেখেননি তাঁরা, একই রকমের রাষ্ট্রের কথা ভাবেননি। তাঁরা ভিন্ন ধরনের বাংলাদেশ রাষ্ট্র চেয়েছেন। এই দুইয়ের ভেতরে যে পার্থক্য আছে, বিরোধ আছে সেটা বলাই বাহুল্য।
তাহলে আমরা কী করে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের অগ্রযাত্রাকে মূল্যায়ন করব? সেটা বিবেচনার জন্য আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। ফলে একটি জনযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যেসব আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে, সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গত ৫০ বছরে কতটা আলোচনা হয়েছে? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা কতটা, সেটা কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে? যে রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি, নিচ্ছে না, সেই রাষ্ট্রের কাঠামো সেইভাবেই গড়ে উঠবে।
রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা পরিমাপের অন্যতম এবং জরুরি মাপকাঠি হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র কোন লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং সংবিধান এই বিষয়ে সুস্পষ্টভাবেই বলেছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যে তিন লক্ষ্যের কথা বলেছে –সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদা –তার ভিত্তি হচ্ছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র; বাংলাদেশের সংবিধান যখন বলেছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ তখন তা নির্দেশ করছে রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকের সম্মতিই ভিত্তি। যেকোনো ‘রিপাবলিক’ গঠনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে পপুলার সভরেনটি –অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌমত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং সংবিধান রিপাবলিক হওয়ার শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করেছে।
বাংলাদেশের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় আমরা নিশ্চয় দেখব অর্থনীতিতে সে কতটা এগোল, সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রে তার অর্জন কী, কিন্তু সেগুলো কার জন্য অর্জিত হচ্ছে, সেটা দেখা দরকার, আর এই সব অর্জনের জন্য রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনরা নাগরিকের অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করে দিলেন কি না, নাগরিকের ক্ষমতাই অপসৃত হল কি না, সেটা আগে বিবেচনা করতে হবে। ফলে আমি বা আপনি কোন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই রাষ্ট্র গত ৫০ বছরে নাগরিকের মালিকানা নিরঙ্কুশ করতে পেরেছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট