• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৮, ২০২১, ০২:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৮, ২০২১, ০২:০৮ পিএম

প্রতিবাদ আর সহিংসতাকে গুলিয়ে ফেলবেন না

প্রতিবাদ আর সহিংসতাকে গুলিয়ে ফেলবেন না

নরেন্দ্র মোদি আমার সবচেয়ে অপছন্দের রাষ্ট্রনেতাদের একজন। সমসাময়িকতা বিবেচনা করলে অপছন্দের তালিকায় মোদি নাম্বার ওয়ান। দুই নাম্বারে আছেন পরাজিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই দুই উগ্র সাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী নেতা বিশ্বের ভারসাম্যই নষ্ট করে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি ৭৪ বছর বয়সী গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মৌলিক চেতনাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন। ভারতের নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচিত হওয়ার পরও আমি বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচনা করেছি। নরেন্দ্র মোদি ধর্মকে পুঁজি করেই রাজনীতি করছেন এবং ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছেন। মোদি যে শুধু ভারতের জন্য ক্ষতিকর, তা-ই নয়। মোদির ধর্মভিত্তিক নেতিবাচক রাজনীতির প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বেই। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাম্প্রতিক উত্থানের পেছনেও রয়েছে ভারতের সাম্প্রদায়িক তৎপরতার প্রভাব।

২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সেই দাঙ্গার হোতা হিসেবে মনে করা হয় নরেন্দ্র মোদিকে। এই জন্য তার পরিচয় ‘গুজরাটের কসাই’। গুজরাটের দাঙ্গার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সেই যুক্তরাষ্ট্রই মোদিকে স্বাগত জানিয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সৌদি আরব, তুরস্কসহ বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও মোদিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখনো ভারতের নির্বাচনে আমি মোদি এবং তার দল বিজেপির পরাজয় কামনা করি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যতই অপছন্দ করি, এটা মানতেই হবে, নরেন্দ্র মোদি এখন ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভারতের জনগণের প্রতিনিধি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেসের ঐতিহাসিক এবং আবেগঘন সম্পর্ক আছে। সে কারণে ভারতে যখন কংগ্রেস পরাজিত হয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তখন উল্লসিত বিএনপি মিষ্টি বিতরণ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশই প্রমাণ করেছে পারস্পরিক সম্পর্ক একটা ধারাবাহিকতা। এখানে ব্যক্তি বা দল গুরুত্বপূর্ণ নয়।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এর আগেও বাংলাদেশ সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি। তবে তার এবারের সফরটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। অন্য প্রসঙ্গ যা-ই হোক, প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, তখন ভারতই থাকবে আলোচনার কেন্দ্রে। এটা কৃতজ্ঞতার অংশ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অংশ নিয়েছেন। অনেকেই বাংলাদেশকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের বার্তা পাঠিয়েছেন। তবে নিঃসন্দেহে ভারতই এই আয়োজনের মূল অতিথি। কারণ, একাত্তর সালে ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সহায়তা করেছে, তা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার পরিচালিত হয়েছে কলকাতা থেকে। কোটি শরণার্থীর জন্য তারা সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। শরণার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। মাঠে অদম্য সাহসে লড়লেও নানান আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে কূটনীতির মাঠে হেরে যেতে পারত বাংলাদেশ। ইন্ধিরা গান্ধীর দৃঢ় অবস্থান বারবার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বিজয়ের পথে। শেষ দিকে ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ১ হাজার ৬৬১ জন ভারতীয় সেনা জীবন দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানান মাত্রা আছে। অমীমাংসিত নানা ইস্যুও আছে। বাংলাদেশিদের ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হওয়ার মতো অনেক ঘটনাও আছে। সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও ভারত তা পালন করেনি। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন ইস্যুতেও ভারত বাংলাদেশের প্রতি ন্যায্য আচরণ করছে না। বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় এই সমস্যাগুলো সমাধানে কূটনৈতিক মহলে চাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন একাত্তর, ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা চিরদিনের। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে ভারতের অংশগ্রহণ আমাদের সেই কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। নরেন্দ্র মোদি এখানে ব্যক্তি নন, তিনি এখানে ভারতের প্রতিনিধি।

নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে স্বাগত জানানোর অধিকার যেমন আপনার আছে, তার সফরের বিরোধিতা করার অধিকারও যে কারও আছে। রাজপথে সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদ করার অধিকার আমাদের সংবিধানস্বীকৃত। কিন্তু প্রতিবাদ করার অধিকার আর দিনের পর দিন উসকানি দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা এক কথা নয়। সাম্প্রদায়িক মোদির বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছেন, তারাও চরম সাম্প্রদায়িক আচরণ করেছেন। বাংলাদেশের মানচিত্র পুড়িয়ে, বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননা করে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস বা গরু জবাই করে মোদির সফরের বিরোধিতা করা প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

মোদির সফরকে ঘিরে গত কয়েক দিন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যে ভাষায় উসকানি ছড়িয়েছে, তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারা মোদির বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দিয়েছে। তারা মোদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। প্রয়োজনে সেই যুদ্ধে শহীদ হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে। তাদের সেসব উসকানির ভিডিও এখনো ইউটিউবে আছে। দিনের পর দিন উসকানিতে তারা একটা যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সেই পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটেছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। এর আগেও সাম্প্রদায়িক শক্তি বায়তুল মোকাররমকে তাদের অপতৎপরতার ঘাঁটি বানিয়েছে। এবারও তাই করেছে। জুমার নামজের পর পবিত্র মসজিদ প্রাঙ্গণকে তারা রণক্ষেত্র বানিয়েছে। ঢাকায় সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তারা সহিংসতা চালিয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভূমি অফিস, ডাকবাংলো, রেলস্টেশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে। হাটহাজারীতে তারা থানায় হামলা চালিয়েছে, থানা থেকে অস্ত্র লুট করেছে।

চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণহানিও হয়েছে। প্রতিটি প্রাণ মূল্যবান। কিন্তু আপনি যদি আইন হাতে তুলে নেন, থানায় হামলা করেন, পুলিশের ওপর হামলা করেন, থানা থেকে অস্ত্র লুট করেন; তখন পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে— এমনটা আশা করা ভুল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আরও আগেই যারা উসকানি ছড়াচ্ছিল, তাদের আইনের আওতায় আনত, তাহলে হয়তো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এমন কঠোর ভূমিকায় যেতে হতো না। অনেকেই বলছেন, পুলিশ গুলি না চালিয়ে লাঠিচার্জ বা টিয়ার গ্যাস ছুড়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত। আমি তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একমত। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পরিস্থিতি আসলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। কঠোর অবস্থানে না গেলে হয়তো পুলিশের কাউকে কাউকে প্রাণ দিতে হতো। আরও বেশি রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হতো।

যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করার অধিকারের কথা বলছেন; তাদের অনুরোধ করছি, মোদির সফরের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকানিগুলো একটু শুনে আসুন। তাদের কর্মসূচির ধরনটা একটু দেখে আসুন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে যা ইচ্ছা তাই করা আর প্রতিবাদের নামে সরকারি সম্পদ ধ্বংস করার অধিকার কারও নেই। সরকারের বিরুদ্ধে আপনি যখন যুদ্ধ ঘোষণা করবেন, তখন সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, এমন আশা করা অন্যায়। সংবিধানেও কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর প্রতিবাদ করার অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করা আছে। আপনি যা-ই করেন, সেটা সংবিধান এবং দেশের আইন মেনেই করতে হবে। সীমা লঙ্ঘন করার মূল্য সবাইকেই দিতে হবে। তবে কখনো কখনো সেই মূল্য একটু বেশি হয়ে যায়। যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সবার জন্যই বেদনাদায়ক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক