• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২১, ০৪:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৮, ২০২১, ০৫:০২ পিএম

পানি নিয়ে ভাবনা

পানি নিয়ে ভাবনা

বেশ কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি, আগামীতে পৃথিবীব্যাপী যে যুদ্ধটা সংঘটিত হবে, তার কারণ হবে পানি। যে দেশের নিয়ন্ত্রণে যত পানি থাকবে, সে দেশ তত নিশ্চিন্ত, তত শক্তিশালী। কিন্তু পানির সংকটে থাকা অন্য দেশগুলো কি হাত ঘুটিয়ে বসে থাকবে? নিশ্চয়ই না, স্বাভাবিক কারণেই বেধে যাবে লড়াই। তাহলে কেন এই পানির সংকট তৈরি হবে, হচ্ছে? এর পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কেন এখনই নেওয়া হচ্ছে না? এই আলোচনা চলমান থাকা অবস্থাতেই কোভিড-১৯ নামের মরণঘাতী এক ভয়াবহ ভাইরাস পৃথিবীকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে শীর্ষে থাকা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো অসহায় হয়ে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখার কথা বলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ এর প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে মানবদেহে প্রয়োগ শুরু করলেও কেউই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছে না, এই ভ্যাকসিন শতভাগ কার্যকর। এই অসহায়ত্বের মধ্যেই এক বছর পার করল বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

এই সময়ে দেশে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট অনেক বেড়ে গিয়েছে। একে তো প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, এর সাথে চলছে পবিত্র মাহে রমজান। এর সঙ্গে প্রাণঘাতী করোনায় প্রাণ হারাচ্ছে আপনজন। এই সময়ে সুপেয় পানির সংকট যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের খাবার পানির সংকট নিয়ে দুর্দশার চিত্র সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও তাদের কষ্ট লাগব হচ্ছে না। আমরা দেখি সাধারণত গ্রীষ্মকালে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দেয়। এ সময় নদ-নদী-খাল-বিলের পানিও কমে যায়, কোথাও কোথাও শুকিয়ে যায়। এর পেছনের মূল কারণ কী, তা অনেকটাই জানা থাকলেও স্থায়ীভাবে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে টেকসই কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ে না। কোথাও কোথাও সরকারি-বেসরকারি কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা সাময়িক সমাধান মাত্র।

দেশের নানা প্রান্তে একটু নজর দিলেই আসল চিত্রটা বোঝা যাবে। রাঙামাটি জেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটের কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, কাপ্তাই লেকের পানি শুকিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ও বৃষ্টি না হওয়ার ফলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার প্রত্যন্ত ও উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ নলকূপে পানি না ওঠার কারণ সম্পর্কে স্থানীয়রা বলছে, একদিকে পানির ওজন স্তর নিচে নেমে যাওয়া, অপর দিকে শিল্পকারখানাগুলো ইলেকট্রিক মটরের মাধ্যমে অনেক নিচ থেকে পানি তুলে নেওয়ার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। দেশের আরেক প্রান্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সংকটের কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, বৈশাখের তীব্র তাপদাহে সমুদ্রবর্তী এসব এলাকায় শুকিয়ে গেছে খাবার পানির পুকুর। সে এলাকার নলকূপের পানি নোনা হওয়ায় এক কলস পানি সংগ্রহ করতে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে দিতে হচ্ছে লম্বা লাইন। তবুও মিলেছে না কাঙ্ক্ষিত পানি। সেখানকার লোকজন সাংবাদিকদের জানাচ্ছে, খরায় খাল-বিল-পুকুর শুকিয়ে গেছে। নলকূপেও পানি ঠিকমতো উঠছে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নড়াইল জেলায় খাবার পানির সংকট নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, এ বছর নড়াইলে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ থাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর এলাকাভেদে ৩০ থেকে ৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে।

দেশের সবখানে পানি সংকটের চিত্রটা প্রায় একই। একই অবস্থা খোদ রাজধানীতেও। ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, জুরাইন, বাসাবো, মুগদা, দোলাইরপাড়, দনিয়া, গোপীবাগ এলাকায় পানির সংকট রয়েছে। ঢাকাবাসী শুধু খাবার পানি নয়, নিয়মিত ব্যবহারের রান্না কিংবা গোসল করার জন্যও প্রয়োজনীয় পানির সংকটে ভোগে। সেদিন এক টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদে দেখলাম, একজন তার মৃত মাকে গোসল দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাননি, এ অবস্থায় পরিচিত একজন তাকে বোতলজাত পানি কিনে দিলে, তা দিয়ে তার মৃত মায়ের গোসল করায়। পানির এই নিত্য সংকটের প্রতিবাদে এলাকাবাসী কখনো কখনো রাস্তায় নেমে আসে, মিছিল করে, মানববন্ধন করে। কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দেয় খুব দ্রুতই এই সংকট দূর হবে, কিন্তু তা আদৌ হয় না। একই সঙ্গে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে রয়েছে দুর্গন্ধের সমস্যাও আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নগরবাসীর জন্য পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়াসা কিংবা নাগরিক সেবায় নিয়োজিত দুটি সিটিকরপোরেশন কি যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে? এর উত্তর হচ্ছে না। কিন্তু কেন করছে না, আমরা তা জানি না।

পানি সংক্রান্ত আরও একটি বিষয় আমাদের ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় এক ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি বরিশালে ডায়রিয়া বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ সেখানকার নদী ও খালের পানিতে থাকা কলেরা জীবাণু। আমরা জানতে পেরেছি, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বরিশাল বিভাগে এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার ১৩৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ১৫৪২ জন। (২২ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত)। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, নদী-খাল ও পুকুরে কলেরার জীবাণুর উপস্থিতি ও গৃহস্থালী কাজে এর ব্যবহারের কারণে ব্যাপক হারে এই ডায়রিয়া ছড়িয়েছে। গত ১ থেকে ১৪ মার্চ আইইডিসিআর-এর ৬ জনের একটি দল বরগুনায় কাজ করে রোগীদের মলে কলেরার জীবাণু পেয়েছে। তারা নদী ও খালের পানিতেও কলেরার জীবাণু পেয়েছে।

এখন সময় এসেছে আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার, দায়িত্বশীল হওয়ার। আমাদের নদ-নদীর পানি দূষণ মুক্ত রাখার দায়িত্ব আমাদের। যেহেতু নদ-নদীর পানি আমরা নিত্যদিনের গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করি, তাই নদীকে, নদীর পানিকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বটা সবার আগে নদী পাড়ের মানুষকেই নিতে হবে।

সারা দেশে অব্যহত খড়া, পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়া, সেচের পানির সংকট ও সুপেয় পানির সংকট দূর করতে হলে আমাদের নদ-নদী-খাল-বিলকে দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে। দখল ও দূষণমুক্ত নদ-নদীই আমাদের আগামীদিনের পানি সংকট অনেকটাই দূর করবে। তাই আসুন আমি-আপনি পানি নিয়ে ভাবি, সচেতন হই, দায়িত্বশীল হই আর ‘পানি সংকট’ মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক।