• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২১, ০৭:১৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৪, ২০২১, ০৩:১৩ পিএম

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন

হুইলচেয়ারে চড়েই খেলা জিতলেন মমতা

হুইলচেয়ারে চড়েই খেলা জিতলেন মমতা

সাম-দাম-দণ্ড-ভেদের রাজনীতিতে অবশেষে শেষ হলো ২০২১ এর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনও সব কেন্দ্রের অফিশিয়াল রেজাল্ট ডিক্লেয়ার না হলেও ২০০’র অধিক আসনে জয়ী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস যে আবারও পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করতে চলেছে তা এরইমধ্যে সবাই জেনে গেছেন। এইবারের নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তো বটেই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে বলেই আমার ধারণা।

সারদা, নারদসহ কয়লা এবং সোনা পাচার কাণ্ডে জর্জরিত সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই করা বিজেপি’র ম্যাজিক ফিগার (১৪৮) তো দূরের কথা শেষ পর্যন্ত ১০০টি আসনও জুটলো না। প্রথমেই জানিয়ে রাখি এই লেখাটা নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শকে দূরে সরিয়ে রেখে একটা পর্যালোচনা করতে চাওয়া মাত্র। কেন এই রেজাল্ট এলো পশ্চিমবঙ্গে? কেন পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভায় বাম এবং কংগ্রেসের কোনও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকলো না! অথচ নবনির্মিত দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের তরফ থেকে বিধানসভা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকলো। একটু নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করা যাক এবারের পরিস্থিতি সম্পর্কে।

সত্যি কথা বলতে গেলে আমার মনে হয়, এবারের নির্বাচনের ফলাফলে এটা পরিষ্কার পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূলকে তার অপশনাল মেজরিটি ডিভিডেন্ডস্বরূপ দিয়েছে শুধুমাত্র বিজেপিকে রুখতে। বাংলার মানুষ ভোট দিয়েছেন নিজের অস্তিত্বকে বাঁচাতে। তৃণমূল থেকে বেরিয়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া কিছু নেতার বিরুদ্ধে ভোট আবার কিছু নেতার পক্ষে ভোট প্রমাণ করে এক প্রচ্ছন্ন পোলারাইজেশনেরও। বামের ভোট রামে যাবে– এই তত্ত্বকে আগে থেকে স্যোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল করা হয়েছে যেমন, তেমনই নো ভোট টু বিজেপি’কেও ভাইরাল করা হয়েছে। মানুষকে বিরত করা হয়েছে বিজেপি’কে ভোট না দিতে, কিন্তু মানুষকে বলা হয়নি ভোট কাকে দেওয়া উচিত হবে। বামেরা করোনা-আমফান মোকাবিলায় জানপ্রাণ লড়িয়ে দিয়েও বলেছে ‘আমরা ভোটের রাজনীতি করি না’। তারপরেও স্যোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং হয়েছে ‘ভোট ফর লেফট্‌’। মানুষ যদিও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন বামেদের। গতবারের বিধানসভায় প্রাপ্ত ভোটের থেকেও এবার তারা পারসেন্টের বিচারে কম ভোট পেয়েছেন। গতবারের ৭% ভোটের থেকে এবার কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৬% ভোট। প্রায় প্রতিটা কেন্দ্রে বিচার করলে দেখা যাবে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে বিজয়ী প্রার্থীর ভোট কোথাও কোথাও ২০-৩০ হাজার, এমনকি ৫০ থেকে ৭৫ হাজারের মতো বড় মার্জিন। এই মার্জিন তখনই আসা সম্ভব যখন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেন। এখন যদি খুব সংক্ষিপ্ত আকারে কয়েকটা পয়েন্ট বিচার করি তাহলে জিনিসটা এরকম দাঁড়ায়:

 

১. বিজেপির ব্যর্থতা

বিজেপি’র পক্ষে প্রথমে রাজনৈতিক এবং কেন্দ্রের তরফ থেকে হাওয়া তৈরি হলেও তা ধরে রাখতে তারা ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কারণ রাজ্যের নেতৃত্বের উপর ভরসা না রাখা। রাজ্য নেতৃত্ব যেখানে একটা দীর্ঘ সময় (আমার মতে দমদম বিধানসভা থেকে প্রথম যখন তপন সিকদার জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন তখন থেকেই) ধরে এখানে আস্তে আস্তে একটা জায়গা তৈরি করলো, এবং শেষ লোকসভায় ৪২টা সিটের মধ্যে ১৮টা সিট জিততে সক্ষম হলো, তারপরে নতুন করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিৎ হয়নি এই সেটআপকে বিব্রত করা। যদি সাহায্য করতেই হতো, কেন্দ্রীয় দল হিসেবে কিছু বড় জনসভা বা র‍্যালিই যথেষ্ট ছিল। ১৮টা লোকসভা সিটের প্রোজেক্টেড বিধানসভা সিট ধরলেও বিজেপির এই সিট গেইন আদতে লোকসভার প্রেক্ষিতে অনেক লস্‌।

২০১৬ বিধানসভার বিচারে ৩ থেকে ৮০ হওয়া তাকে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা দিলেও সেটাই যথেষ্ট বলে মনে করার কারণ দেখি না। এছাড়াও নব্য বিজেপি এবং আদি বিজেপির আভ্যন্তরীণ কোন্দল কোথাও কোথাও প্রকাশ পেয়েছে যথেষ্ট মাত্রায়। একটা টিম যখন বড় হয়, তাকে উপর লেভেল থেকে কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে যায়। সব থেকে বড় ফ্যাক্টর যে দুটি কাজ করেছে বলে আমার অন্তত ধারণা—তৃণমূল থেকে যথেচ্ছ হারে নেতা এবং কর্মীর যোগদান। দ্বিতীয়ত, দলের হায়ার লেভেল নেতৃত্বের সারা দেশের অন্যান্য ইস্যুকে গুরুত্ব না দিয়ে কোভিড পরিস্থিতিতেও প্রায় প্রতিদিন দিল্লি থেকে কলকাতা যাতায়াত যাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট এই ভোটে। এত বিপুল খরচ, এত বিপুল আয়োজনের পরেও রাজ্য নেতৃত্বের উপর ভরসা করতে না পারা এই থমকে যাওয়ার কারণ।

 

২. বাম + কংগ্রেস + আই এস এফ জোটের (সংযুক্ত মোর্চা) অংক

এই জোটের বিষয়ে অনেক কথা বলার আছে। বলার আছে কেন বামেদের এই পতন– (ক) প্রথমত যেদিন ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই জোটের অফিশিয়াল অ্যানাউন্সমেন্ট হয়, সেদিনই স্যোশাল মিডিয়া এবং এই দৈনিক জাগরণের ওয়েবেই আমার একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম, এই জোট আসলে প্রি-ম্যাচিওর জোট। এর এখনও অনেক সময়ের প্রয়োজন। এই জোটের উচিত ছিল পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন থেকে কনটেস্ট করতে করতে উঠে আসা। এটা হলে এই জোটের হাতে অনেক সময় পাওয়া যেত, শুধু তাই না, পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনের বেশিরভাগ সিটই পার্টি বিচার না করে ব্যক্তিগত ক্যারিশমা থেকে হয়। অর্থাৎ ছোট ছোট পদক্ষেপে কাজ করে লক্ষ্যবস্তুতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। হয়তো সময় লাগে, কিন্তু কাজটা হয়। সেটা না করেই বড় ময়দানে পরীক্ষা দিতে নেমে পড়া একটা বোকামির লক্ষণ। (খ) বাম কংগ্রেস জোটকে এর আগের ভোটে মানুষ মেনে নিলেও ভোট শেষে তার স্থায়িত্ব থাকেনি। আইএসএফ’কে এই জোটের অংশ হিসেবে মানুষ মেনে নিতে পারেনি। সাধারণ মানুষের কাছে আইএসএফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকির ভাবমূর্তি স্পষ্ট নয়। (গ) দিনকেদিন বাম এবং কংগ্রেসের ক্ষয়িষ্ণু দশা, এবং এই দশা থেকে উদ্ধারের জন্য যোগ্য নেতৃত্বের তথা যোগ্য নীতির অভাব। (ঘ) বামেদের সাথে সিপিআই (এমএল)-এর সক্রিয় সংগঠন তৈরি না হওয়া। (ঙ) ভোট বাক্সের রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া। (চ) বিশেষ করে সমালোচনা সহ্য করতে না পারা এবং অন্যকে অজান্তেই চাড্ডি, তিনু ইত্যাদি সম্বোধনে ছোট করা। (ছ) আত্মসমালোচনা না করে অতিরিক্ত স্যোশাল মিডিয়া নির্ভর হওয়া। (জ) গ্রাসরূট লেভেল থেকে নেতৃত্ব তুলে না এনে অনেক জায়গায় ইউনিভার্সিটি লেভেলের নেতাদের ভোটে দাঁড় করানো। (ঝ) ভুলে যেতে চাওয়া এই জাতীয় ভোটের ক্ষেত্রে রাস্তার বা এরিয়াভিত্তিক মুখ বেশি কাজ করে যারা সংগঠনকে শুরু থেকে দেখছেন। ইত্যাদি অনেক কারণ রয়েছে বামেদের যা আরও আলোচনা করা যেতে পারে। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ বহু বছরের হারিয়ে যাওয়া জমি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। তবে, এই জোটের ফলে সবচেয়ে লাভবান (যদিও তা পর্বতের মূশিক প্রসব ছাড়া আর কিছুই নয়) আই এস এফ। আব্বাস সিদ্দিকির ভাই নওসাদ সিদ্দিকির ভোটে জয় আই এস এফ’কে অন্তত বিধানসভায় থাকার সুযোগটুকু দিয়েছে।

 

৩. তৃণমূল কংগ্রেসের শেষ হাসি

সারদা, নারদ সহ বিভিন্ন স্ক্যামে জর্জরিত দলটা থেকে যখন একের পর এক নেতানেত্রী সরে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তখন অনেকেই ভাবেননি এই দলটা জিতে ফিরবে। জিতেছে, কারণ আমার মতে চারটি: (ক) দলটার অদ্ভুতভাবে নতুন টিম তৈরি হয়ে গেল, যারা তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রেখে নতুন দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে। (খ) দলটার পলিটিক্যাল হায়ারার্কিতে এবং কর্মসূচিতে প্রশান্ত কিশোরের মাস্টারমাইন্ডের রদবদল অনেক সাপোর্ট করলো। (গ) দলটা আগের কাজের অর্থাৎ সাধারণ, প্রান্তিক মানুষের পালস্‌ বুঝে কাজের ডিভিডেন্ড গেইন করলো এই অসময়ে। (ঘ) সাধারণ মানুষ বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির বিরোধিতায় এবং সংযুক্ত মোর্চার দিশেহারা রাজনীতির হদিশ না পেয়ে তৃণমূলকেই আবার বিপুল জয়ে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসালো।

আসলে রাজনীতি কেন সবকিছুই স্বচ্ছ্বতা ডিমান্ড করে। আপনি যেমন দেখাবেন, আপনাকেও ঠিক তেমনটাই দেখতে হবে। সময় কথা বলবে। এই ভোটটা ঠিক যেন, ম্যাচফিক্সিং কান্ডের পর আজহারের হাত থেকে শচিন হয়ে সৌরভের হাতে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব আসা এবং স্টিভ ওয়া’র অস্ট্রেলিয়ার অপ্রতিরোধ্য বিজয়রথ ইডেন গার্ডেন্সের মাঠে সৌরভের নেতৃত্বে আনকোরা একটা নতুন টিমের কাছে আটকে যাওয়া। লাস্ট লাইন অফ ব্যাটেল বাঙালি খুব ভালো লড়ে তা আবার একবার প্রমাণিত হয়ে গেল। প্রায় ১০ হাজার কোটির যাতায়াত, হিল্লি-দিল্লির পরেও, মার্ক্স-লেনিন-স্তালিন-মাও-এর আইডিওলজি নিয়ে ঘেঁটে যাওয়া বামপন্থী, কংগ্রেস আদর্শ বা নব্য আইএসএফ-এর পরেও মানুষের পালস্‌ বুঝতে পারা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বাউল ফকিরি কপচানো হাওয়াই চটিই জিতে গেল। নিজের সিটে হেরে গেলেও আবারও অন্য কোথাও থেকে প্রতিনিধিত্ব করে তিনি জিতেই মুখ্যমন্ত্রীত্ব নেবেন, কিন্তু আবারও প্রমাণিত হলো—হারকে জিতনেওয়ালোকো বাজিগর ক্যাহতে হ্যায়। এটা টাকার জয় কতটা, শিক্ষা-অশিক্ষার জয় কতটা, সে প্রসঙ্গে আজ আর আসার কোনও প্রয়োজন হয়তো নেই, কিন্তু এইরকম বিপর্যস্ত অবস্থাতেও তৃণমূলের বিপুল জয়– আদতেই পিপলস্‌ ম্যানডেট।

এখন উন্নয়নের ধারাকে আরও তুলে এনে কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবকিছু নিয়ে এই নতুন সরকার কিভাবে এগিয়ে যায় সেটাই দেখার আগামীতে।  

 

লেখক: পশ্চিমবঙ্গের কবি ও অনুবাদক