• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২১, ১২:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৮, ২০২১, ১২:৪৪ পিএম

সাংবাদিক হেনস্তা

সত্যান্বেষী রোজিনার সঙ্গে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল

সত্যান্বেষী রোজিনার সঙ্গে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল

ছোটরা শুধু নয়, বড়দের অনেকেও আজকাল জানতে চান, হযবরল কী? সামাজিক মাধ্যমে নতুন নতুন শব্দের আবির্ভাবে এমন শব্দের ব্যবহার কমে গেছে। কিন্তু উদাহরণসহ যদি কেউ এখন শব্দটির মানে জানতে চান, তাহলে মঙ্গলবার থেকে আজ অবধি সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, বৃহত্তর অর্থে সাংবাদিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যা ঘটল, সেটা হযবরল-এর জুতসই উদাহরণ। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি এই পেশার মামুলি ব্যাপার। যে সাংবাদিক গোপন নথির খবর যত বেশি সংগ্রহ করতে পারবেন, তার দক্ষতা ততই পাঠক, দর্শকের কাছে প্রমাণিত হবে। নিজ পেশায় তিনি হবেন ঈর্ষণীয়, তুলনীয়। তাই সাংবাদিকরা গোপন নথি সংগ্রহের জন্য বিচিত্র কৌশল রপ্ত ও প্রয়োগও করে থাকেন।

দপ্তরের বিভিন্ন স্তরের কর্মীকে মাসোহারা দিয়ে, গোপন ও জরুরি কাগজ নিশ্চিত করার একটা রেওয়াজ ছিল। আমাদের আগের কালে এবং আমাদের কালে। সচিবালয় বা দপ্তরের অফিস সহকারী, টাইপরাইটার থেকে শুরু করে সচিব স্বয়ং রিপোর্টারকে গোপন নথি দেখান। কারণ, প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত নন। কতিপয়ের দুর্নীতির দায় তারা নিতে চান না। অনেক অন্যায় সিদ্ধান্ত বা কাজ তারাও সইতে পারেন না। তারা চান খবরগুলো জনসমক্ষে আসুক। তাই সাংবাদিকদের ফাইল খুলে দেখান, কাগজ ফটোকপি করে দেন। অনেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বা বঞ্চনার শোধ নিতে সাংবাদিকদের কাছে নথি সরবরাহ করেন। আবার সাংবাদিকরাও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অগোচরে নথি সরিয়ে নেন। নথি বা কাগজ সরিয়ে নিতে আমরা কখনো কখনো কাগজ মুখে পুরে নিতাম। যেন তল্লাশি করলেও না পাওয়া যায়। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে এমন কাজ করেছি আমরা। এখন তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে সেলুলার ফোনে নথির ছবি তুলে নেওয়া অনেক সহজ। নিজের সংরক্ষণে রাখা যায় প্রমাণপত্র। রোজিনা ইসলাম হয়তো এমন কাজই করেছিলেন। সেটি কারও নজরে পড়ে যায়।

নথি হাপিস করতে গিয়ে আমরা যে কখনো ধরা খাইনি, তা নয়। সচিবালয়সহ অনেক দপ্তরে এমন হয়েছে। মন্ত্রী পর্যন্ত ঘটনার জানাজানি হয়েছে। কিন্তু কর্মচারী, কর্মকর্তা কেউই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েননি। অনুরোধ করেছেন রিপোর্টটি না করতে। অফিসের বড় কর্তার কাছেও তদবির হয়েছে। কিছুদিন হয়তো ওই দপ্তরের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক গিয়েছে, এ পর্যন্তই। একজন প্রয়াত প্রভাবশালী সচিব আমার টক শোতে অতিথি হিসেবে এসে বলেছিলেন, “তোমার রিপোর্টারদের ‘চোথা’ চুরির তালিম কেমন দিয়েছো? তোমরা যে কত জ্বালিয়েছো আমাকে।” আজ সকালেই একজন সাবেক সচিব বললেন, “যে আইনে রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা হলো, সেই আইনে আমিসহ অনেক আমলার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। কারণ, আমরা তোমাদের হাতে সেই ইউএনও আমল থেকে কত নথি তুলে দিয়েছি!”

 

যে অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হলো, সেই আইনটির সাধারণ প্রয়োগ নেই। অব্যবহৃতই বলা যায় । ১৯৯১-৯২ সালের দিকে এই আইনটি রহিত করার জন্য আমলাদের ভেতর থেকেই প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু প্রতিবেশী ও শত্রুপক্ষের কাছ থেকে গোপন বিষয় গোপন রাখার স্বার্থে তখনকার জ্যেষ্ঠ আমলারা আইনটি রহিত করতে দেননি। আওয়ামী লীগ সরকার তথ্য অধিকার আইন করার পরও, প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, দুটি আইন একসঙ্গে সক্রিয় বা জীবিত থাকতে পারে কি না? কিন্তু এই প্রশ্নেরও কোনো মীমাংসিত উত্তর বা সমাধান পাইনি।

লিখতে লিখতেই কথা বলছিলাম সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমানের সঙ্গে। তাঁর মত হচ্ছে, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ তৈরি হওয়ার পর অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনটির আর নৈতিক অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছায়ায় আইনটিকে জীবিত রাখা হয়েছে। ড. গোলাম রহমানের মতে, সাংবাদিকদের তথ্য প্রকাশের তাড়া থাকে, তাই তথ্য অধিকারের আইনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় তাদের হাতে থাকে না। তখন নিজেরাই নিজেদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বেশ জোর দিয়েই বললেন, আইন দুটি সাংঘর্ষিক।

রোজিনা ইসলামকে কারাগারে যেতে হলো। আমার কাছে মনে হয় এতে শুধু সাংবাদিক সম্প্রদায়ই নয়, আমলাতন্ত্রের বড় অংশও বিব্রত হয়েছে। কারণ ঘটনা এত দূর গড়াবে, সেটি প্রত্যাশিত ছিল না কারও। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জট খোলা যায়নি হয়তো শেষ পর্যন্ত। যেত যদি সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ঐক্য থাকত। আমরা প্রতিবাদ জানানোর বেলাতেও বিভাজন রেখা তৈরি করেছি। ফলে প্রতিবাদে দৃশ্যমানতা আছে, সমীহ আদায়ের গর্জন নেই। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের কঠোরতার মধ্যেও বুদ্ধিবৃত্তিক ঝলক ছিল, যা হযবরল জট এড়িয়ে সহজ পথ খুঁজে নিতে পারত। কিন্তু দুর্নীতির কাঁটা হয়তো সেই পথকে কঠিন করে তুলেছে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক