• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২১, ০১:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১, ২০২১, ১২:৫১ পিএম

পাকিস্তান, মিয়ানমার যদি বন্ধু হয়, ইসরায়েল কেন নয়?

পাকিস্তান, মিয়ানমার যদি বন্ধু হয়, ইসরায়েল কেন নয়?

‘তাইওয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইসরায়েল ব্যতীত’ পৃথিবীর বাকি সব দেশ ভ্রমণ করা যাবে—এই মর্মে ম্যাজেন্টা রঙের সিল মারা থাকত বাংলাদেশের পাসপোর্টে বছর বিশেক আগেও। কালোরা তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার নামটি কাটা যায়। তাইওয়ানের নাম সম্ভবত কাটা যায় বৈদেশিক বাণিজ্যে কোনো ধরনের ব্যাঘাত হচ্ছিল বলে। ‘সবেধন নিষিদ্ধমণি’ ইসরায়েলের নামটিও অবশেষে কাটা গেছে।

‘আস্তেধীরে খইঅ খতা, মাইস্যে হুনিব। ঢোলর বাড়ি কঅড়র তলে খদিন থাকিব?’ শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের গাওয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কলি। খবরটা যখন চাউর হলো এবং তা-ও এগারো দিনের ফিলিস্তিন-হামাস সংঘর্ষের পর, তখন দৃশ্য-শ্রাব্য গণমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে বিপুল আলোচনা-সমালোচনার মুখে সরকারি ভাষ্যে যা বলা হলো তার নিগলিতার্থ এই: ‘পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা মুছে গেছে প্রায় ছয় মাস আগে। এত দিন পরে কেন খবর হলো তোমাদের? বাংলাদেশের পাসপোর্টকে ‘আধুনিক’ করার জন্যই লিখিত নিষেধাজ্ঞাটি মুছে দেওয়া হয়েছে।’ জনগণকে এই মর্মে সতর্ক করে দেওয়া হলো: অলিখিতভাবে ইসরায়েল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা পূর্ববৎ বলবৎ আছে। বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত স্বীকৃতি দেবে না। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক ইসরায়েলে যাওয়া দূরে থাক, যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে হাজির হলেও সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কমপক্ষে দুইজন বাংলাদেশি নাগরিক এই অপরাধে জেল খাটছে। যদিও কানাঘুষায় শোনা যায়, ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কারও কারও নাকি রমরমা ব্যবসা চলছে। 

ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। ঢাক ঢাক গুড় গুড়। শ্যাম রাখি না কুল রাখি? ইসরায়েল ভ্রমণ প্রসঙ্গে সরকারের অযৌক্তিক দ্বিচারিতা, দোদুল্যমান অবস্থান সুস্পষ্ট। সরকার কোনো কারণে ঝেড়ে কাশতে পারছে না। পাসপোর্টে ইসরায়েল গমনের নিষেধাজ্ঞা থাকবে না, কিন্তু সেখানে গেলে তুমি শাস্তি পাবে, যদিও পাসপোর্ট দেওয়া হয় বিদেশ ভ্রমণের জন্যই। আচ্ছা, অস্বীকৃত দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে আদৌ কোনো আইন কি আছে, কিংবা কোনো আইন কি পাস হয়েছে বাংলাদেশে? মালয়েশিয়ার পাসপোর্টেও অনুরূপ লিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং তাদের পাসপোর্টকে অনাধুনিক বলে দাবি করা হয়নি।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু তাইওয়ানের ব্যাপারটা অত সরল নয়। পাসপোর্টে নিষিদ্ধ তালিকা থেকে তাইওয়ানের নাম বাদ যাওয়ার পর বাংলাদেশি নাগরিকেরা ভারতের তাইপেই ভিসা অফিস থেকে ভিসা নিয়ে তাইওয়ান যাচ্ছে। বাংলাদেশ মনে করে, তাইওয়ান চীনের অংশ। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন, সার্বভৌম তাইওয়ান বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেতে পারে না। তাই যদি হয়, তবে বাংলাদেশের নাগরিকেরা কীভাবে তাইওয়ানে যাচ্ছে? তাইওয়ানে যদি যেতে পারে, তবে ইসরায়েলে যেতে পারবে না কেন? এক যাত্রায় কেন পৃথক ফল হবে? তবে স্বীকৃতি না দিলেও দেশ ভ্রমণের কোনো না কোনো উপায় বোধ হয় বের করাই যায়। ১৯৭২-৭৪ সালে বাংলাদেশের নাগরিকেরা ভারত হয়ে সৌদি আরবে হজ করেছে—এমন তথ্য আলজিয়ার্সে বঙ্গবন্ধু-ফয়সল আলাপচারিতায় আছে।

১৯৯৫ সালের অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—এই দুই রাষ্ট্র পরস্পরকে স্বীকার করে নিয়েছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক প্রতিদিন সকালে ইসরায়েলে কাজ করতে যায় এবং কাজ করে দিনের শেষে ফিলিস্তিনে ফেরত আসে। বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি মুসলমান ইসরায়েলের নাগরিকও বটে। এই ফিলিস্তিনিরাও নিশ্চয়ই ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকার করে। অনেক ফিলিস্তিনি ভালো বেতনে চাকরি করে ইসরায়েলে, বিদেশে ছুটি কাটাতেও যায় সপরিবার। এমন একটি ফিলিস্তিনি ‘নাসারা’ (ওদের বাড়ি ইসরায়েল অধিকৃত নাজারেথে) মুসলমান পরিবারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ইস্তাম্বুলে।

মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক রাষ্ট্র, যেমন মিসর বা সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তারা যে ইসরায়েলের সব সিদ্ধান্ত কিংবা কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে, তা তো নয়। এর অর্থ হচ্ছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেও ইসরায়েলের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা সম্ভব। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা মানেই ইসরায়েলকে সমর্থন করা নয় কিংবা ইসরায়েলের দালালি করা নয়। সৌদি আরব বা মিসর আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র নয়, এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দালাল, এসব দেশে গণতন্ত্র নেই, এই দেশগুলো বাংলাদেশের আদর্শ হতে পারে না, সৌদি যা করবে বাংলাদেশকেও কেন তা করতে হবে?—এমন সব অজুহাত কেউ দিতে পারেন বটে, কিন্তু কূটনীতির বিচারে এ-জাতীয় অজুহাত ধোপে টিকবে না। 

ইহুদিরা হাজার বছর ধরে ইউরোপে অত্যাচারিত হয়েছে। গত শতকের মাঝামাঝি হিটলারের গণহত্যার শিকার হয়েছে তারা। কিন্তু নিজেদের রাষ্ট্র পাওয়া মাত্রই তারা প্যালেস্টাইনের স্থায়ী বাসিন্দাদের অকথ্য অত্যাচার করছে, তাদের গৃহহারা করছে ৭০ বছর ধরে। ১৯৯৫ সালে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তিতে প্যালেস্টাইনকে যে ভূমি দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ইসরায়েলিরা সরে তো যাচ্ছেই না বরং ধীরে ধীরে, বিচিত্র অজুহাতে নতুন ভূমি দখল করছে একের পর এক ইহুদি বসতি স্থাপন করে। পশ্চিম তীরে এত বেশি ইসরায়েলি ছিটমহল যে এই অঞ্চলের মানচিত্রকে একটি ইঁদুরে কাটা রুটি বলে মনে হয়। যখন-তখন, যেকোনো অজুহাতে নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা, বন্দি, বোমাবর্ষণ তো লেগেই রয়েছে। এমন একটি ফিলিস্তিনি পরিবারও হয়তো নেই, যার কমপক্ষে একজন সদস্য শহীদ হয়নি কিংবা যুদ্ধে আহত হয়নি। গাজা ও পশ্চিম তীরকে এমনভাবে অবরোধ করে রাখা হয়েছে যে সুড়ঙ্গপথ ছাড়া যোগাযোগ বা জীবনধারণের অন্য উপায় নেই। ইউরোপ ও আমেরিকার তথাকথিত মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া ইসরায়েল এত অন্যায় নিশ্চয়ই করতে পারত না। ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো অনেকগুলো বাচ্চা নেয়, কারণ তারা জানে, এদের বেশির ভাগই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হবে। এই মানবতাবিরোধী অত্যাচারের অবসান হওয়া দরকার। অত্যাচারিত ও অত্যাচারী উভয় পক্ষের জন্যই অত্যচার-নিপীড়ন ক্ষতিকর, অপমানকর।

প্যালেস্টাইনের উপর গত সাত দশকে ইসরাইল যত অত্যাচার করেছে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তান বাঙালি জাতির উপর তার শত গুন বেশি অত্যাচার করেছে। কে বেশি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, ইসরায়েল নাকি পাকিস্তান? মাত্র নয় মাসে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে পাকিস্তান। বহু হাজার মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর পাকিস্তান কখনও তার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা দূরে থাক, এই অপরাধ স্বীকার পর্যন্ত করেনি। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১ এর অবর্ণনীয় গণহত্যার কথা এখনও লেখা হয়নি। 

অন্য জাতির উপর যে অত্যাচার করার অপরাধে বাংলাদেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, নিজের দেশের জনগণের উপর তার চেয়ে শতগুণ বেশি অত্যাচারের অপরাধে পাকিস্তানকে কিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ? বাংলাদেশের পাসপোর্টে পাকিস্তান ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা কখনই ছিল না পাকিস্তান অত্যাচার করেছে সরাসরি বাঙালির উপর, বাংলাদেশের জনগণ নিজেরাই ভুক্তভোগী। অথচ পাকিস্তানে যেতে বাংলাদেশিদের কোনো বাধা নেই, না পাসপোর্টে, না বাস্তবে। নিজের দেশের জনগণের উপর হওয়া অত্যাচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যখন এতটাই উদাসীন, পরের উপর হওয়া অত্যাচারের ব্যাপারে অতটা আপোষহীন কেন? পাকিস্তানকে যদি মেনে নিই, ইসরাইলকে কেন নয়?

ইসরাইল ফিলিস্তিনের জমি জবরদখল করছে, ফিলিস্তিনিদের গৃহহারা করছে। ফিলিস্তিনিরা জান বাঁচাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে আশেপাশের আরব দেশগুলোতে কিংবা ইওরোপ-আমেরিকায়। জমি দখলই মূল কথা, হোক সে প্যালেস্টাইনে কিংবা বাংলাদেশে। বাংলাদেশে কিছু দিন পরপর কেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে থাকে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হিন্দুর জমি দখল করার জন্যেই নয় কি? হিন্দুরা বাংলাদেশ ছেড়ে যায়, কারণ তাদের পাশের দেশ ভারতে বাঙালি হিন্দু আছে। পাঞ্জাবি হিন্দু থাকলে হয়তো দেশত্যাগ না করে বাংলাদেশই এক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতো। ভারতের মুসলমানেরা কিংবা পাকিস্তানের বালুচরা দেশত্যাগ করে না, কারণ তাদের যাবার দ্বিতীয় কোনো জায়গা নেই। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়েই ভারতের তুলনায় অনুন্নত বাজার, যার প্রমাণ এই দুই দেশের অধিবাসীরাই দলে দলে বিদেশে অভিবাসী হচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা দেশত্যাগ করছে, কারণ জান বাঁচাতে আশেপাশের আরব দেশগুলোতে তাদের যাবার জায়গা আছে।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে চুক্তির পথে না গেলে, ইসরাইলকে স্বীকার না করলে, আগামি একশ বছরে জর্দান, মিশর, লেবাননের একাংশ ইসরাইলের দখলে চলে যাবে। এসব দেশের যেসব জায়গায় ফিলিস্তিনিরা বাস করে সেগুলোও ইসলরাইলই দখল করে নিয়েছে বলতে হবে, ঠিক যেভাবে মায়ানমার দখল করেছে বাংলাদেশের টেকনাফ, ভাসানটেক, বাংলাদেশে পা না দিয়েই। রোহিঙ্গাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যচার করেছে মায়ানমার সরকার। কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশ কি মায়ানমারকে স্বীকৃতি দেয় না? ফিলিস্তিনিরা যেমন মুসলমান, তেমনি রোহিঙ্গারাও মুসলমান, তদুপরি জাতিগতভাবে তারা বাঙালি। দুই বিবদমান দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবার জন্যেও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেবার প্রয়োজন রয়েছে। একটি দেশকে যদি আপনি স্বীকারই না করেন, তবে কোন বাহানায় তার সঙ্গে ফিলিস্তিন বা নিজের স্বার্থ বা অন্য যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন?

বাংলাদেশে অত্যাচারের প্রতিবাদ হবার কমপক্ষে দুটি শর্ত আছে। প্রথমত, অত্যাচারিতকে স্বধর্মী হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত অত্যাচারীকে বিধর্মী হতে হবে। ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের অত্যাচারের যে পরিমাণ প্রতিবাদ হয় বাংলাদেশে, ইয়েমেনের উপর সৌদি আরবের অত্যাচার সে পরিমাণ মনোযোগ কাড়ে না, কারণ সেক্ষেত্রে অত্যাচারিত এবং অত্যাচারী উভয়েই স্বধর্মী। যেহেতু বাঙালির উপর অকথ্য অত্যাচার করা পাকিস্তানীরা স্বধর্মী, সেহেতু তাদের সাত খুন মাফ। ‘আফ্রিদী মেরি মি!’ বলে ঢাকা স্টেডিয়ামে চিৎকার করে উঠে বাঙালি তরুণী, যেন ১৯৭১ সালে তার মা-বোনের ধর্ষিতা হওয়াটা  যথেষ্ট ছিল না। তিব্বতিদের উপর চীনের অত্যাচার, কিংবা কারেনদের উপর মায়ানমারের অত্যাচার ক্বচিৎ বাংলাদেশে মনোযোগ পায়, কারণ এক্ষেত্রে অত্যাচারিত এবং অত্যাচারী উভয়েই বিধর্মী। প্রতিবাদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাও অবশ্য আছে। চীন যেহেতু পাকিস্তানের জিগরি দোস্ত, সেহেতু উইগুর মুসলমানের উপর চীনের অত্যাচারেরও ততটা প্রতিবাদ হয় না, কী পাকিস্তানে, কী বাংলাদেশে। 

এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নেহায়েতই একটা নিয়মরক্ষা মাত্র। কোনো একটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর অন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভর করে না। প্রথমে রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং তারপর তার স্বীকৃতির প্রশ্ন আছে। স্বীকৃতি নেহায়েতই দুই রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপার। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের যখন জন্ম হয়েছিল, তখনও পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তান ও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর। একাধিক আরব রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিনিময়ে সৌদি বাদশা ফয়সল অপমানকর শর্ত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। শুনেছি, ইসরাইল নাকি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে, পৃথিবীর অন্য সব রাষ্ট্রের আগে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যদিও সেই স্বীকৃতি বাংলাদেশ সরকার নাকি গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশ স্বীকৃতি না দিলেও পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ইসরাইল রাষ্ট্রটি মুছে যাবে না। কিন্তু সন্তানের জন্ম যখন হয়েই গেছে, তখন আগে পরে তাকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই। কিভাবে মেনে নেবেন, কত দিন পরে মেনে নেবেন, সে সমস্যা আপনার, সন্তানের নয়। জন্ম জায়েজ, নাকি নাজায়েজ—এগুলো নেহায়েতই সংস্কারের প্রশ্ন, স্থান-কাল-পাত্রভেদে এসব সংস্কার বদলায়। ইসরায়েলের জন্ম নাজায়েজ হবারও কোনো কারণ নেই যেহেতু অন্য সব আরবদেশের মতোই অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে ইসরাইলেরও জন্ম হয়েছে। প্যালেস্টাইনে যদি আগে থেকে ইহুদি বসতি না থাকতো, তবে তো ইসরাইল রাষ্ট্র্রগঠনেরই প্রশ্ন আসতো না।

আরব-ইসরাইল সুসম্পর্কের কারণ ইতিহাসের গর্ভে প্রোথিত। ইন্দোইওরোপীয় ইরান ঐতিহাসিক কারণে আরবের ধর্ম মেনে নিয়েছে, কিন্তু আরবের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি, নিতে চায় না। ইরানের যদি পারমাণবিক বোমা থাকে, তবে ইসরাইলকে কাবু করা কঠিন হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ছাড়া একমাত্র ইরানেরই এই বোমা বানানোর মতো জ্ঞানগত ও অর্থায়নগত ভিত্তি রয়েছে। সমধর্মের কিন্তু জাতিগতভাবে ইন্দো-ইওরোপীয় ইরানের ভয়ে সেমিটিক আরব দেশগুলো একে একে জোট বাঁধছে ভিন্ন ধর্মের কিন্তু সমজাতির সেমিটিক ইসরাইলের সঙ্গে। ইন্দোইওরোপীয় আমেরিকা ইরানবিরোধী এবং ইসরাইলের প্রধানতম মেন্টর—এটাও একটা কারণ বটে।

জাতিগতভাবে সেমিটিক ইসরায়েল এবং আরবের চেয়ে আলাদা, কিন্তু আরবের ধর্মভাই তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের এবং সারা মুসলিম জাহানের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হতে চায়। কিন্তু তুরস্কইবা সাম্প্রতিক সময়ে কোন যুদ্ধে জিতেছে যে ইসরাইলকে আক্রমণ করার দুঃসাহস সে করবে? আরব দেশ মাত্রেই তুরস্কের কাছে যেতেও ভয় পায়, কারণ তুরস্ক হচ্ছে সেই অটোমান খেলাফতের উত্তরাধিকারী, যার নাগপাশ থেকে তারা একদিন বহু কষ্টে মুক্ত হয়েছিল ব্রিটেন আর ফ্রান্সের সহায়তায়।

ফিলিস্তিনরা পড়ে গেছে এই বারমুডা চতুর্ভূজের ‘মাইনকার চিপায়’। ‘এদের কপালটাই খারাপ!’ বলেছিলাম রাজনীতিবিজ্ঞানের এক সহকর্মীকে। ‘ওদের কপালই নেই! কপাল থাকলে তো খারাপ বা ভালো হবার প্রশ্ন আসে!’ সত্যি বেচারা ফিলিস্তিনিদের আছে এক চিলতে কপাল গাজা আর একটুখানি ইঁদুরে কাটা কপাল পশ্চিম তীর। চক্ষুলজ্জাবশত এটুকু একবারে দখল করতে পারছে না বলে কদিন পরপর একটু একটু করে দখল করছে, নিত্যনতুন ইহুদি-বসতি সৃষ্টি করে, যখন তখন, যে কোনো অজুহাতে বোমাবাজি, নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের ধরপাকড়, আহত-নিহত করে।

ঢাকার ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশ পাসপোর্টে ইসরাইল ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা মুছে দেওয়াটা দুঃখজনক। আমার প্রশ্ন: ইসরাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার অপরাধে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি সৌদি আরব বা মিশরের সমালোচনা করে না কেন? মিশরীয় বা সৌদি পাসপোর্টে কি ইসরাইল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আছে? খোদ ফিলিস্তিনি পাসপোর্টেই কি আছে? আরব দেশগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে একান্তই নিজ নিজ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে। জোর যার মুলুক তার। একক ও সম্মিলিতভাবে আরব দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে পরাজিত হয়েছে কমপক্ষে তিনবার। যখন ইসরায়েল মাত্র জন্ম নিয়েছে, মার্কিনীরা যখন ধারে কাছেও ছিল না, তখনও, সেই ১৯৪৮ সালেও আরবেরা জিততে পারেনি ইসরাইলের বিপক্ষে।

কেউ যদি বলেন, ‘ছাগল নাচে খুঁটির জোরে’—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল, তবে আমার উত্তর হবে, সেটাও ইসরায়েলেরই বিজয়। গত হাজার বছরে পাশ্চাত্য কখনো ইহুদিদের পক্ষে ছিল না। পক্ষান্তরে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবরাই ছিল পাশ্চাত্যের প্রধান মিত্র। আরবরা সেই বন্ধুত্বের ফায়দা তুলতে পারেনি, ইসরায়েল পেরেছে, এটাই তো ইসরায়েলের কূটনৈতিক বিজয়। পয়সাকড়িরও তো অভাব নেই আরবদের। ঈশ্বরের বখে যাওয়া ছেলে তারা। ইসরায়েলের কোন প্রাকৃতিক সম্পদটা আছে? ঠিক এ কারণেই ইসরায়েলের উন্নতি হয়েছে, আরবদের হয়নি। ঈশ্বর কাউকে হয়তো সম্পদ দিয়েছেন, কাউকে দিয়েছেন আক্কেল ও বুদ্ধি।

সঠিক যুদ্ধকৌশলের কারণেই আরবেরা একদিন মিসর-ইরান-ইরাক-স্পেন দখল করেছিল। বিজয়ীকে আপনি ঘৃণা করতেই পারেন, কিন্তু তার বিজয়টাকে তো অস্বীকার করতে পারেন না। ইসরায়েল যেকোনো আরব দেশের চেয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে উন্নত। ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনো বসি, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি ফেকাহ-হাদিস চষি!’ বলেছিলেন নজরুল সেই ত্রিশের দশকে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুজতে হলে সমমানের বা উন্নততর ক্ষমতা অর্জন করতে হবে আরবকে, বাংলাদেশকে, কাকে নয়?

দান দান, তিন দান। আরবেরা চতুর্থবার শক্তি পরীক্ষা করার সাহস করবে না। ইসরায়েলের জ্ঞান ও শক্তির সঙ্গে আরবের পেট্রোডলার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারার কথা নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে সন্ধি করা ছাড়া আরবদের সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। এই প্রবল শত্রুর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সময় আরবেরা ফিলিস্তিনের কথা ভাবেনি, ধর্মের নিষেধের কথা ভাবেনি, ভাবেনি মুসলিম বেরাদরির কথা। রাজনীতি বা কূটনীতিতে আবেগের কোনো স্থান নেই। স্থায়ী শত্রু বা বন্ধু বলে কিছু নেই রাজনীতিতে, থাকতে পারে না। শত্রু থাকা কিংবা রাখাটাই কোনো রাষ্ট্রের জন্য অন্যতম রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা।

যেকোনো আরব দেশের তুলনায় ইসরায়েল সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী। সুতরাং ইসরায়েলের দায়িত্ব অনেক বেশি। ইসরায়েলকে সংযত হতে হবে। আইনস্টাইন একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইসরায়েলের সুপারিশ করেছিলেন বলে শোনা যায়। হয়তো সেটাই প্রকৃত সমাধান। সেই কাম্য সমাধান যত দিন না আসে, তত দিন বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দেওয়ার পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি নেই। বাংলাদেশ স্বীকৃতি না দিলেও ইসরায়েলের খুব যে ক্ষতি হবে কিংবা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের দখলদারি বন্ধ হবে, তা কিন্তু নয়। স্বীকৃতি দিয়েই ইসরায়েল সরকারের কুকর্মের প্রতিবাদ করতে হবে। ইসরায়েলি জনগণের একাংশও ইসরায়েলকে স্বীকার করেই ইসরায়েলি সরকারের প্রতিবাদ করছে।

তালি অবশ্যই এক হাতে বাজেনি। প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে প্রথম দিকে স্বীকার করেনি, জন্মের এক বছর পর, ১৯৪৮ সালেই এক যোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে রাষ্ট্রটিকে মুছে দিতে চেয়েছিল। কমপক্ষে তিনবার সম্মিলিত আক্রমণের শিকার হয়েছে ইসরায়েল এবং তিনবারই ইসরায়েল সবার বিপক্ষে একা যুদ্ধ করে জিতেছে। কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াটাই ইসরায়েলের সাফল্যের টুপিতে একমাত্র পালক নয়। মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসরায়েল। ইসরায়েলে অবস্থান করেই একজন ইসরায়েলি নাগরিক ইসরায়েল সরকার কিংবা জায়নবাদের সমালোচনা করতে পারে। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা যায় ইসরায়েলে। ইহুদিধর্মাবলম্বী ইসরায়েলি অধ্যাপক শোমো স্যান্ডের লেখা ইসরায়েলবিরোধী পুস্তক ও প্রবন্ধ কিংবা ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এবং জায়নবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল এর প্রমাণ। কোনো আরব দেশে অনুরূপ প্রতিবাদ সম্ভব নয়। সৌদি সরকারের মৃদু সমালোচক জামাল খাশোগির তুরস্কে বেঘোরে খুন হওয়া এর অন্যতম প্রমাণ।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে এটা যেমন সত্য, তেমনি হাজার বছর ধরে ঘৃণিত-বিতাড়িত-অত্যাচারিত একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মাত্র সাত দশকে, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, তিন তিনটি যুদ্ধের ধকল সামাল দিয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-সংগীত-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এমন অসামান্য উন্নতি করে উঠতে পেরেছে যে আরব দেশগুলো, এমনকি ইরানও তার ধারেকাছে নেই—এ কথাও তো মিথ্যা নয়। যেসব মানদণ্ডে ইসরায়েল একটি সফল, আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হবে, সেই একই মানদণ্ডে মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্রকেও আধুনিক বা সফল বলা যাবে না। ইসরায়েলকে স্বীকার না করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাশকুসুম স্বপ্ন না দেখাই ভালো, সে আরবের জন্য হোক, ফিলিস্তিনের জন্য হোক, কিংবা হোক বাংলাদেশের জন্য।

বাংলাদেশ-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশের শ্রম ও পণ্য আরব দেশের মতো ইসরায়েলে রপ্তানি হতে বাধা কোথায়? ইসরায়েলের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেতে পারে আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান, যা একটি আরব দেশও বাংলাদেশকে দিতে পারবে না। ইসরায়েলের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পায়ন পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সমমানের, যার সঙ্গে আরব দেশগুলোর তুলনাই হতে পারে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাপ্তির এই সুযোগ বাংলাদেশ নিতেই পারে। বহু দূরের পাশ্চাত্যে না গিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ইসরায়েলে উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা নিতে সমস্যা কোথায়? আরবির ভগ্নীভাষা হিব্রুই বা আমরা শিখব না কেন? ইসরায়েলকে যদি কেউ শত্রুও মনে করে, সে ক্ষেত্রে এই শত্রুকে জানবার স্বার্থেও তার সঙ্গে মিশতে হবে (একই কথা মিয়ানমারের বেলায়ও প্রয়োজ্য)।

গ্রিক/ল্যাটিন ‘doxa’ কথাটার অর্থ ‘জনমত’। বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদকে prodoxal হলে চলে না, paradoxal হতে হয়। বুদ্ধিজীবীকে জনমতের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিসম্মত প্রশ্ন তুলতে হয়। সক্রেটিস আমৃত্যু paradoxal ছিলেন। বাংলাদেশে বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী prodoxal হতে চায়, অর্থাৎ জনমতকে আহত করতে চায় না, বরং উসকে দিতে চায়। রাজনীতিবিদকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে paradoxal হয়ে জনমতের বিপক্ষেও যেতে হয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জনমতের বিপক্ষে গিয়ে ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছিলেন। এই চুক্তির বলে মিসর ও ইসরায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে দখল করা মিসরের সিনাই ফেরত দিয়েছিল ইসরায়েল এবং বিনিময়ে সুয়েজ খাল ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিল। এর প্রায় দুই দশক পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন কট্টরপন্থীদের বিপক্ষে গিয়ে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে অসলো চুক্তি করেছিলেন ১৯৯৫ সালে, যার ফলে প্যালেস্টাইন একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দুই নেতাকেই জাতীয় বেঈমান ফতোয়া দিয়ে খুন করেছিল কট্টরপন্থীরা। কিন্তু তাঁরা যদি জনমতের তোয়াক্কা করতেন, ব্যক্তিগত লাভক্ষতির চিন্তা করতেন, তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রমের সূচনাই হতো না এবং অবশ্যই এর প্রভাব পড়ত বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর।

‘মূর্খ বন্ধু অপেক্ষা জ্ঞানী শত্রু উত্তম’ এবং ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য’—যুগান্তরের এই দুই প্রবাদবাক্যের মধ্যে কোনটি অনুসরণীয়— শাঁখের করাতসদৃশ্য এই রণকৌশলগত সিদ্ধান্ত ব্যক্তি ও জাতিকে কখনো না কখনো নিতেই হয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এই সিদ্ধান্ত বদলায়। ‘দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে!’ পঙক্তিটিতে রবীন্দ্রনাথ আদান-প্রদান ও মিলনের কোনো শর্ত বেঁধে দেননি। ‘কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’—এটাই ছিল রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূল পররাষ্ট্রনীতি। প্রবন্ধের উজানে উল্লেখিত অকাট্য যুক্তিগুলো (১. ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বিনিময়ের সম্ভাবনা যদি থাকে, ২. একাধিক আরব দেশ এবং খোদ ফিলিস্তিন যেহেতু ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে, ৩. অত্যাচারী পাকিস্তান এবং মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেতে পারে, ৪. রাজনৈতিক চাপ দেওয়ার জন্যও একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, ৫. বাংলাদেশ স্বীকৃতি না দিলে ইসরায়েলের কোনো ক্ষতি নেই কিন্তু স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের লাভ রয়েছে, ইত্যাদি) খণ্ডন যদি করা না যায়, তবে স্রেফ আবেগের বশে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক না রাখা সম্ভবত সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।

 

লেখক: ভাষাবিদ ও শিক্ষক