• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৮, ২০২১, ১১:২১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৯, ২০২১, ০২:৩৯ পিএম

টাকার আসা-যাওয়ার খেলা ও চৌবাচ্চার অঙ্ক!

টাকার আসা-যাওয়ার খেলা ও চৌবাচ্চার অঙ্ক!

ছেলেবেলায় চৌবাচ্চার অঙ্ক সবাই করেছেন। চৌবাচ্চার নিচে যদি নির্দিষ্ট আকৃতির ছিদ্র থাকে, তাহলে সেটি খালি হতে কতক্ষণ লাগবে। বাংলাদেশের কিছু মানুষের অর্থ পাচারের গল্প শুনে আমার খালি সেই চৌবাচ্চার গল্প মনে পড়ে। যে হারে প্রতিবছর টাকা পাচার হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের ভান্ডার শূন্য হতে কত দিন লাগবে? কথায় বলে, বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়ে যায়। তেমনি পাচার করতে করতে আমরা একদিন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের উপচে পড়া বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারও খালি করে ফেলতে পারব।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আছে মানুষ। তাই আমাদের শ্রম সবচেয়ে সস্তা। এই সস্তা শ্রম বেচতে আমরা ঘুরে বেড়াই বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। তাদের বেশির ভাগই সেসব দেশে যান অনেক কষ্ট করে, কেউ কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব, এমনকি জীবনও খোয়ান। যারা কষ্টে-সৃষ্টে যেতে পারেন, তাদেরও সেখানে অবর্ণনীয় কষ্ট করে টাকা উপার্জন করতে হয়। মনে আছে ছেলেবেলায় আমার এক বন্ধু জমিজমা বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটি দেশে গিয়েছিলেন। সেখানে কনস্ট্রাকশন ফার্মের কাজের কষ্ট সইতে না পেরে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় ইউরোপ-আমেরিকা তো প্রবাসীদের কাছে স্বর্গ। সেই স্বর্গের একটা স্মৃতি বলি।

বছর দশেক আগে আমার একবার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এক সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে এক বন্ধু এক বাঙালি আড্ডায় নিয়ে গেলেন। আড্ডার একপর্যায়ে আমি টয়লেটে যেতে চাইলে পাশের রুমে দেখিয়ে দিলেন। টয়লেটে যেতে গিয়ে আমি যে দৃশ্য দেখেছি, তা কখনো ভুলতে পারব না। পাশের অন্ধকার রুমটিতে অন্তত ১০ জন লোক ফ্লোরে এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে। সবাই মরার মতো ঘুমাচ্ছে। সেই রুমে পা ফেলার জায়গা নেই। অনেক কষ্টে কারও মাথা ডিঙিয়ে, কারও পা ডিঙিয়ে আমাকে টয়লেটে যেতে হয়েছিল। পরে জানলাম, তারা সবাই ট্যাক্সিচালক। দিনের বেশির ভাগ সময় তারা ট্যাক্সি চালায়। দিনে বড়জোর ৫ ঘণ্টা ঘুমানোর সময় পায়। সেটুকু সময় তারা মরার মতো ঘুমায়। দেখে কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়। তাদের এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্থে চাঙা হয় আমাদের অর্থনীতি। বাংলাদেশিদের কাছে যেটা স্বর্গ, সেই আমেরিকার এই অবস্থা। আর মালয়েশিয়ার রাবার বাগান বা সৌদি আরবের ধূসর মরুভূমিতে শ্রমিকদের কষ্টের যে গল্প শুনি, অবিশ্বাস্য মনে হয়।     

প্রবাসী শ্রমিক ভাইয়েরা অবিশ্বাস্য কষ্ট করে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠান। আর আমাদের ‘ভিআইপি’ লুটেরারা তা অবলীলায় পাচার করে। এক পি কে হালদারই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করে পালিয়েছেন। একবার ভাবুন তো, সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার উপার্জন করতে আমাদের কত হাজার শ্রমিককে কত হাজার ঘণ্টা মরুভূমিতে কাটাতে হয়। অথচ এই পাচারকারী লুটেরারা বিমানবন্দরে বা বিমানে ভিআইপি মর্যাদা পান। আর যারা কষ্ট করে টাকা পাঠান, তারা দেশে আসা বা যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে বা বিমানে তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা রীতিমতো অপরাধ। এই করোনাকালে দেশে এসে আটকে পড়া শ্রমিকরা নিজেদের পয়সায় বিমানের টিকিট কাটতে গিয়ে যে হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তা তো সবাই দেখেছেন।

গত বছর মার্চে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। এই টাকা কারা পাচার করে? সাধারণ মানুষের তো টাকাই নেই, পাচার করবে কোত্থেকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাচারের তালিকার শীর্ষে আছেন সরকারি কর্মকর্তা। এরপর ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা। টাকা পাচার নিয়ে অনেক দিন ধরেই নানা মহলে আলোচনা চলছে। তবে রোববার ও সোমবার সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনায় সাংসদরাও অর্থ পাচার নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। শুধু বিরোধী দলের এমপিরা অভিযোগ করলে না হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু রোববার আলোচনাটা তুলেছেন সরকারি দলের সিনিয়র সাংসদ অধ্যাপক আলী আশরাফ। তিনি বলেছিলেন, ‘বড় বড় চোরদের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মতো কার্যক্রমে ঘৃণায়, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।‘ পরদিনও সাংসদরা পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন সংসদে। জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে চলে যাবে, আপনাদের যেমন লাগে, আমারও লাগে।’  

অর্থমন্ত্রীর কেমন লাগে জানি না, তবে তার অসহায়ত্ব দেখে আমারই খারাপ লেগেছে। তিনি বলেছেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে এরা এরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন।’ অর্থমন্ত্রী অর্থ পাচারকারীদের নাম জানেন না, এটা অবিশ্বাস্য। তারপরও আমি বিশ্বাস করলাম তিনি জানেন না। কিন্তু তিনি কি কখনো জানতে চেয়েছেন, কারা অর্থ পাচার করে? বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রাথমিক তদন্তে গত পাঁচ অর্থবছরে ১ হাজার ২৪টি অর্থ পাচারের ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। অর্থমন্ত্রী চাইলে বিএফআইইউর রিপোর্টটি ধরে বিস্তারিত তদন্ত করলে পেয়ে যাবেন পাচারকারীদের নামের তালিকা। অর্থমন্ত্রী তার সহকর্মী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাসা করলেও অন্তত ২৮ জন পাচারকারীর নাম পাবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত বছর নভেম্বরে কানাডায় বাড়ি কিনেছেন, এমন ২৮ জনের নাম পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। সংসদে অর্থমন্ত্রীর সহকর্মী শহিদ ইসলাম পাপুল তো অর্থ পাচারের দায়ে কুয়েতের কারাগারে শাস্তি ভোগ করছেন। অত পেছনে যেতে হবে না, অর্থমন্ত্রী চাইলে তারই সহকর্মী নাটোর-২ আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুলের কাছে জানতে চাইতে পারেন, তার স্ত্রী কানাডায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা দিয়ে যে বাড়ি কিনেছেন, তা তিনি কোথায় পেয়েছেন, কীভাবে কানাডায় নিয়েছেন। হতে পারে অর্থমন্ত্রী কারা অর্থ পাচার করে জানেন না, আসলে তিনি জানতে চান না। চাইলে এই তালিকা পাওয়া এক সপ্তাহের ব্যাপার।

কানাডার প্রবাসীরা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন। কানাডার ‘বেগমপাড়া’য় কাদের বাড়ি আছে, একটা ফোনকলেই অর্থমন্ত্রী তালিকা পেয়ে যাবেন। যদি সরকারিভাবে করতে চান, দূতাবাসগুলোকে বললেই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেনা সেকেন্ড হোম বানানো মানুষের তালিকা পেয়ে যাবেন। স্ত্রী-সন্তান কানাডায় থাকেন, এমন মানুষ কিন্তু সমাজে অপরিচিত নয়। সংসদে কাজী ফিরোজ রশীদ জানার আরেকটা উপায় বলেছেন, তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয় ঢাকার বদলে কানাডায় স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা দুবাইয়ে দুদকের শাখা খোলার পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে অর্থমন্ত্রী চাইলেই পাচারকারীদের তালিকা পেয়ে যাবেন। প্রশ্ন হলো, তালিকা পেলেই কি তিনি তাদের আটকাতে পারবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন?

হাইকোর্ট বারবার অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তালিকা চাইছেন। সংসদে সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই অভিন্ন কণ্ঠে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু তারপরও কারা পাচার করছে, সেই তালিকাটাও মানুষ জানতে পারছে না। তাহলে কি পাচারকারীদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি? 

সংসদে কাজী ফিরোজ রশীদের একটি দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েই লেখাটি শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ‘কালোটাকা বলতে কোনো টাকা নেই। সব টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই টাকা ফেরত আনেন। আমরা চাই দেশের টাকা দেশে থাকুক।‘ আমরাও এই দাবির সঙ্গে একমত। প্রথম দাবি হলো, টাকা পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যারা পাচার করেছে, তালিকা ধরে ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এবং পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যোগাযোগ করা হোক। পাচারকারীদের ঠেকাতে না পারলে তারা দেশকে সত্যি সত্যি তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে ছাড়বে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট