• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২১, ০২:২৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৬, ২০২১, ০২:৪৫ পিএম

বাংলাদেশে টিকা-সংকট ও ভারতের অবস্থা

বাংলাদেশে টিকা-সংকট ও ভারতের অবস্থা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২৮ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভায় ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে একটা বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘করোনাযুদ্ধে বহু জীবন রক্ষা করে আমরা একটা বড় ট্র্যাজেডি থেকে গোটা মানবসমাজকে রক্ষা করেছি। ভারত বিশ্বেও বৃহত্তম ভ্যাকসিন অভিযান শুরু করেছে; ইতিমধ্যে মাত্র ১২ দিনে ২৩ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দিয়েছি।’ এ নিয়ে তাঁর দেশের ও বাইরের ভক্তরা বেশ ধন্য ধন্য রব তোলেন।

কিন্তু মাত্র তিন মাস না যেতেই কী এক অদ্ভুত কারণে সবকিছু কেমন গোলমেলে হয়ে গেল। শহরগুলোতে হু হু করে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। একপর্যায়ে এ মহামারি প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে দেশটির বহুখ্যাত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভীষণ অপ্রতুল বলে প্রমাণিত হতে লাগল।

জটিল করোনা রোগীর সেবায় অত্যাবশ্যকীয় আইসিইউ তো দূর স্থান, অক্সিজেন প্রাপ্যতাই দুরূহ হয়ে পড়ল। হাসপাতালের বেড হয়ে পড়ল একপ্রকারের সোনার হরিণ। এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেল। এমনকি মৃতদেহ সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় নিয়মে সৎকার করার সময় না পেয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হলো। সেসব লাশ ঢেউয়ের তোড়ে পাড়ে এসে থিতু হওয়ার পর তা শিয়াল-কুকুরের খাদ্য হলো। চারদিকে ত্রাহি মধুসূদন রব উঠল।

যে টিকাকরণ নিয়ে মোদিজি এত গর্ব করলেন, তা-ও মুখ থুবড়ে পড়ল। ভারতের জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকা দ্য হিন্দু ৮ জুন লিখেছে, দেশটি ওই দিন পর্যন্ত ২৩ কোটির কিছু বেশি লোককে টিকা দিয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৮ কোটির কিছু বেশি পেয়েছে প্রথম ডোজ টিকা, আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে মাত্র ৪ কোটি ৬০ লাখের চেয়ে কিছু বেশি লোক।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, জানুয়ারির ১৬ তারিখে শুরু হওয়ার পর ৭ জুন পর্যন্ত ভারতে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ পূর্ণ ডোজ টিকা পেয়েছে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, এ হারে টিকাকরণ চললে দেশটির ৭৫ শতাংশ মানুষকে (একটা দেশে করোনার বিস্তার কার্যকরভাবে ঠেকাতে যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি প্রয়োজন, তার জন্য এ সংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে হয়) পূর্ণ ডোজ টিকা দিতে আরও অন্তত ২২ মাস সময় লাগবে, যদিও মোদি সরকার দাবি করছে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সবাইকে টিকা দেওয়া হবে।

 টিকাকরণ পলিসিই তো পুরোপুরি ঠিক করতে পারেনি দেশটির সরকার ৭ জুনের আগ পর্যন্ত। প্রথমে বলা হয়েছিল, শুধু ৪৫ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়া হবে। এপ্রিলের দিকে ঘোষণা দেওয়া হলো, ১৮ বছর-ঊর্ধ্ব সবাই তা পাবে, যদিও তখন টিকার সংকট সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু তা নয়, দুটো ডোজের মধ্যকার সময় প্রথম ঠিক করা হয়েছিল দুই সপ্তাহ, তারপর চার সপ্তাহ। কিছুদিন আগে বলা হলো, ১২ সপ্তাহের আগে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে না।

টিকা ফ্রি দেওয়া হবে, না পয়সা নিয়ে দেওয়া হবে, তা-ও পরিষ্কার ছিল না। প্রথমে বলা হল, পয়সা লাগবে না। তারপর বলা হলো, শুধু ৪৫-ঊর্ধ্ব মানুষদের কেন্দ্রীয় সরকার টিকা দেবে বিনা পয়সায়; বাকিদের রাজ্য সরকার টিকা দেবে পয়সার বিনিময়ে। বেসরকারি খাতকেও অধিকার দেওয়া হলো টিকা নিয়ে বাণিজ্য করার। এ নিয়ে সংগত কারণেই বিরোধী রাজনীতিকদের তরফ থেকে হইচই শুরু হয়। শেষে সুপ্রিম কোর্ট এতে হস্তক্ষেপ করে। তারা তীব্র ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকারের এমন দ্বিচারিতার সমালোচনা করে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদি ৭ জুন ঘোষণা দেন যে ২১ জুন থেকে ১৮-ঊর্ধ্ব সব নাগরিক টিকা পাবে বিনা মূল্যে।

ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়ার মতো মনে হলেও বাংলাদেশের টিকা সংকট নিয়ে আলোচনায় ভারতের প্রসঙ্গটি টানতে হলো এ কারণে যে জানুয়ারির ওই ভাষণে মোদিজি করোনাকে ‘পরাজিত’ করেছেন বলে যে অতি আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তার জন্য দুর্ভোগ শুধু ভারতীয়রা নয় বাংলাদেশিদেরও পোহাতে হয়েছে। সময়মতো টিকাপ্রাপ্তির বিষয়ে আমরা আজকে যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি, তার জন্য মোদি সরকার আমাদের সরকারের চেয়ে কম দায়ী নন।

এ কথা শুনেই হয়তো সরকারের সমালোচক মহল হইহই করে উঠতে পারেন এই বলে যে বাংলাদেশের টিকা সংকটের কারণ আমাদের সরকারের টিকা সংগ্রহের ‘ভুল’ নীতি। সরকার যদি টিকার জন্য শুধু ভারতের ওপর নির্ভর না করত, তাহলে বাংলাদেশকে আজকে টিকার জন্য এতটা হন্যে হতে হতো না।

তাঁদের এ বক্তব্যকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে এটা তো ঠিক যে বাংলাদেশ যে সময়ে টিকাকরণ শুরু করেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ছাড়া আর কেউ টিকা পায়নি। অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা, যা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদন করছে—এ ছাড়া আর কোনো টিকা বাংলাদেশের কাছে সহজলভ্য ছিল না, অন্তত ওই সময়ে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা ছাড়া তখন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও মডার্না টিকা, যার সংরক্ষণ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। এগুলোর দামও ছিল বাংলাদেশের নাগালের বাইরে।

হ্যাঁ, চীনের সিনোভ্যাক এবং রাশিয়ার স্পুতনিক ভি টিকা তখন বাজারে ছিল। কিন্তু এগুলো তখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশকে টিকা কেনার জন্য বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। দুটো সংস্থারই শর্ত হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই, এমন টিকা তাদের টাকা দিয়ে কেনা যাবে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ওপরই ভরসা করেছে।

আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে ওই একই সময়ে ভারত সরকার—প্রধানত ভূরাজনৈতিক কারণে—আগ্রাসী ভ্যাকসিন কূটনীতি শুরু করে এবং অনেকটা আগপিছ না ভেবেই প্রায় দুহাতে বিভিন্ন স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মাঝে ভ্যাকসিন বিলাতে শুরু করে। ভারতের মিডিয়া বলছে, ভারত দ্বিতীয় দফায় করোনা সংকটে পড়ার আগ পর্যন্ত আট কোটিরও বেশি টিকা বিভিন্ন দেশকে অনুদান ও রপ্তানি-পণ্য হিসেবে দিয়েছিল।

বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের সুবাদে এর সুযোগ নিতে চেয়েছিল। মোদি সরকারও বাংলাদেশ সরকারকে এমনভাবে আশ্বস্ত করেছিল যে বাংলাদেশের যত টিকা লাগবে, সবটাই তারা সরবরাহ করতে পারবে। এর জন্য অন্য কারও কাছে দেনদরবার করার দরকার নেই। তাছাড়া টিকার দামও ধরা হয়েছিল অনেক কম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায়। প্রতি ডোজ টিকার দাম ছিল মাত্র চার ডলার। এমনও বলা হয়েছিল, এ দামে প্রথম ফেজে তিন কোটি টিকা দেওয়া হবে। এরপর যা লাগবে তার দামও হবে ভারত সরকার সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে যে-দামে কিনবে তার সমান। এমন লোভনীয় অফার কেউ ছাড়ে?

আমাদের মনে আছে, টিকার এ চার ডলার দাম নিয়েও বহু মানুষ তখন আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আজকে যখন চীন থেকে ১০ ডলারে টিকা কেনা হচ্ছে—তা-ও শ্রীলঙ্কা প্রতি ডোজের জন্য ১৫ ডলার দিয়েছে বলে চীন এখন আমাদের কাছে ১০ ডলারে বিক্রি করতে গড়িমসি করছে—ওই মহলটি এ নিয়ে একেবারে ‘স্পিকটি নট’।

বলা হতে পারে, চীনের প্রস্তাব অনুসারে সিনোভ্যাকের ট্রায়াল যদি এখানে হতো তাহলে আজকে টিকা নিয়ে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে যে দাড়িয়াবান্ধা খেলছে তার সুযোগ পেত না। এ সমালোচনাটা অযৌক্তিক নয়। বাংলাদেশ ভারতের অতি আত্মবিশ্বাসী টিকা কূটনীতির ফাঁদে পড়ে তখন চীনের প্রস্তাবটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। আবার এটাও ঠিক যে সিনোভ্যাকের ট্রায়ালের জন্য বাংলাদশে যখন সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে এনেছিল, তখন হঠাৎ করেই চীন এ ট্রায়ালের সব খরচ বাংলাদশেকে বহন করতে হবে বলে চাপ দেয়। এটা বাংলাদেশের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। আর তখন এ ধরনের বিনিয়োগের ফল ছিল খুবই অনিশ্চিত। অন্যদিকে অ্যাস্টাজেনেকায় বিনিয়োগের ফল ছিল অনেকটা নিশ্চিত।

যাহোক, ৭০ লাখ টিকা পাওয়ার পর বাংলাদেশ যখনই বুঝতে পেরেছে যে ভারত আর টিকা দিতে পারবে না, তখনই সে অন্য টিকার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে এবং ইতিমধ্যে এর কিছু ফলও ফলতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে এ শিক্ষাও সে অর্জন করেছে যে, কখনোই এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখতে নেই। আর করোনার মতো প্রায় আনপ্রেডিক্টেবল একটা মহামারির সঙ্গে জোরজবরদস্তি চলে না। এটা করতে গিয়েই মোদি সরকার নিজে বিপদে পড়েছে, সঙ্গে বাংলাদেশকেও ফেলতে যাচ্ছিল।

বাংলাদেশ এ বিপদ থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসতে পারলেও ভারত কিন্তু এখনো সেই গাড্ডায় পড়ে আছে। আর তার সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্যের মিডিয়া ভারতের হাঁড়ির খবর খুঁজতে দেশটির কিচেনে পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। এ করে করে এরা গোটা বিশ্বের সামনে সুপারপাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ভারতকে প্রায় খেলো করে দিয়েছে। তাকে বিশ্বের স্বঘোষিত মোড়ল য্ক্তুরাষ্ট্রের পেটে ঢুকে যেতে হয়েছে, যেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় সমানে সমান লড়ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যা বলবে, তাকে তা-ই শুনতে হবে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনাকারী ভারতের জন্য এ এক দুর্ভাগ্যই বটে।

 

লেখক: সাংবাদিক