• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২১, ১২:৪০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৪, ২০২১, ০৮:২৩ পিএম

পাঠ-উপলব্ধি - ১

শোকাবহ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী

শোকাবহ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

মোহা. শাজাহান আলি ।।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক রচিত ভূমিকাটি যেন একখণ্ড বাংলাদেশ। এতে যেমন রয়েছে শত দুঃখ জাগানিয়া কথা, শত সহস্র আবেগ-ভালোবাসা তেমনি শত ঝঞ্জা-প্রতিকূলতা পেরিয়ে সৃষ্টির বারতা। ৩২ নম্বর বাড়িটির উপর দিয়ে বয়ে গেছে দুটি বড় ঝড়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে আটক এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে হত্যার পর বাড়িটির হাড়-পাঁজর তছনছ করে ফেলা হয়। তারপরও বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়রিগুলি উদ্ধার করে অসামান্য এক  দলিল বাঙালি জাতির কাছে উপহার দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শ্রদ্ধেয় শেখ রেহানা। বইটির পাঠক হিসেবে আমি উপলব্ধি করেছি সত্য ধ্রুবতারার চেয়ে সত্য। সত্য শাশ্বত বিরাজমান। বইটির ভূমিকায় খুজে পাই স্বতন্ত্র এক মাধুর্য্য। ড. আতিয়ার রহমান তার একটি প্রবন্ধে বলেন, ‘সর্বকালের সবশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রুপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল অস্তিত্ব পড়ে আছে বাংলাদেশের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে, যাঁর জন্ম না হলে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ড হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এ কারণেই একথা বললে ভুল হবে না যে, বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ তাই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে জানার প্রথম পরতে এই ভূমিকাটি যেকোন পাঠককে প্রবলভাবে আকর্ষণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। 

প্রথম
অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাঠক হিসেবে নিজেকে সৌভাগ্যবান হিসেবে মনে করি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখায় সেই সময়ের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করি। হাজার হাজার প্রবন্ধ, বই বা গবেষণায় বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর নিয়ে বিস্তর বর্ণনা চিত্রায়িত হয়েছে। ভবিষ্যতেও লক্ষ-কোটি গবেষণা হবে। কিন্তু তার চেয়ে মহামূল্যবান বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে রচিত তাঁর শৈশব-কৈশোরের প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, তাঁর নিজ গ্রাম ছায়া সুনিবিড় টুঙ্গিপাড়ার বর্ণনা আর শেখ বোরহানউদ্দিন নামে ‘ধার্মিক’ পুরুষের মাধ্যমে শেখ বংশের গোড়াপত্তনের গল্প। এক ইংরেজের সাথে বিরোধকে কেন্দ্র করে শেখ পরিবারে ‘কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানা’ গল্পটি শেখ পরিবারে অন্যতম মাধুর্য্য বহন করে আসছে। সময়ের পরিক্রমায় শেখ বংশের বিত্ত-বৈভব কমলেও আভিজাত্য টিকে ছিল স্বমহিমায়। কাজী পরিবারের সাথে হত্যা মামলা নিয়ে শেখ বংশের দুঃসময়, পরিবার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার আন্তরিকতা, প্রিয় ‘খোকা’কে নিয়ে বাবার ভালোবাসা, ‘বার তের’ বছর বয়সে বঙ্গমাতার সাথে বঙ্গবন্ধুর বিবাহের গল্প, তাঁর নিজের শৈশব ও কৈশোর নিয়ে স্মৃতিচারণ সেই সময়গুলি জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রথম পরতে। 

দ্বিতীয়
বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলা নিয়ে অনেক বই-প্রবন্ধ রয়েছে। সেই সমস্ত বই-প্রবন্ধে ছোটবেলার বঙ্গবন্ধুকে ডানপিটে খোকা হিসেবে পেয়ে থাকি। এর জন্য বঙ্গবন্ধুর বাবার উপর দিয়ে গিয়েছে বহু ধকল। কিন্তু অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিতে আমি মনোযোগ বেশি দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জানতে। জেলখানায় বসে ডাইরী লেখার সময়ও বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সান্নিধ্যের কথা আর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া স্নেহ-ভালোবাসার কথা। ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। সেই সময় তাঁরা সভায় অংশগ্রহণের জন্য গোপালগঞ্জ আসেন। সভা শেষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুল পরিদর্শনে যান। মিশন স্কুলের ছাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সংবর্ধনা দেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রথম দেখা (পৃ. ১১)। সোহরাওয়ার্দীর সাথে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বার দেখা হয় ১৯৩৯ সালে কলকাতায়। সেখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল গোপালগঞ্জের মুসলিম লীগ কমিটি এবং মুসলীম ছাত্রলীগ গঠন। এভাবেই শুরু হয়েছিল সক্রিয় রাজনীতে বাংলাদেশ নামক দেশটির স্বপ্নদ্রষ্টা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্ভিক পথচলা।

তৃতীয়
পাঠক হিসেবে অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটির মাধ্যমে সেই সময়ের মুসলিম লীগের ভিন্নধর্মী চিন্তাধারার রাজনীতির সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটে। ১৯৪৩ সালে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন আর সম্পাদক হন আবুল হাসিম। আবুল হাসিমের পূর্বে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীঁ। সেই সময় বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটি বিপরীত মুখী ফ্রন্টের অস্তিত্ব অনুধাবন করেন। ‘একটি প্রগতিশীল দল, আর একটি প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিনত করতে চায় এবং জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল’ (পৃষ্ঠা:১৭)। বঙ্গবন্ধু সেই সময় মুসলিম ছাত্রলীগের পাশাপাশি মুসলিম লীগকে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়ার জন্য প্রণান্ত চেষ্টা করেছিলেন।বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত থেকে উদ্ধার’ করার প্রণান্ত চেষ্টাও করেছিলেন। সে লক্ষে কাজ করতে গিয়ে নিজের টাকায় ১৯৪৩ সালে দিল্লীতে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন’ এ যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালের ছাত্রলীগের বাৎসরিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ এবং দোলাচলের সময়ও বঙ্গবন্ধু তাঁর সাংগঠনিক অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের পার্লামেন্টোরী বোর্ড গঠনের সময় বেশ কিছু নেতার হীনতা ও কলুষতার স্মরূপও উন্মেচন করেন। যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর নিজ আসন ছেড়ে দিয়ে বাই ইলেকশন করে খাজা নাজিমুদ্দিনকে এমএলএ করে মুসলিম লীগে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিলেন সেই নাজিমুদ্দিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করেনি বা মনোনয়ন দেননি (পৃ. ৪১-৪৫)।

চতুর্থ
ভারত ভাগের প্রেক্ষাপটে দলীয় আদর্শের অর্ন্তদ্বন্ধ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ এবং ভারত ভাগ নিয়ে সেই সময়ের ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে আগামী প্রজন্ম আরো গভীরভাবে পর্যালোচনার সুযোগ পাবে বলে বিশ্বাস করি। ভারত ভাগ নিয়ে ১৯৪৫ সালে লেবার পার্টির নির্বাচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির বক্তব্যে সে সময়ের বিবেচনায় মুসলমানদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই মনে করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালের ২৩ মার্চ ক্যাবিনেট মিশন ভারতবর্ষে এসে যে সমস্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতেও বঙ্গবন্ধু বিচলিত হন। ভারত বিভাজনের সেই সময়েই মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্রিটিশ সরকারের ভারত ভাগে মুসলিম লীগের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ৭-৯ এপ্রিল দিল্লীতে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কাউন্সিল ডাকেন। উক্ত কাউন্সিলে লাহোর প্রস্তাবের আদোলে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কাউন্সিল শেষে আগ্রায় তাজমহল দেখতে গিয়ে আবেগ, ভালোবাসা আর সৌন্দর্যমন্ডিত অপরূপ দৃশ্য দেখে বিমোহিত বঙ্গবন্ধুকে আমি নতুনভাবে খুজে পাই। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু যেদিন তাজমহল দেখতে গিয়েছিলেন সেইদিন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। সন্ধ্যায় গৌধুলীর আভা আর রাতে তাজের বুকে চাঁদের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে বঙ্গবন্ধু আপ্লুত হয়েছিলেন। পূর্নিমার চাঁদ দেখে যে তাজ তার ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রুপ ধারণ করেছিল সেই তাজের অপরুপ সৌন্দর্য ২১ বছর পর জেলখানায় স্মৃতিচারণের সময় বঙ্গবন্ধু কোন কিছুই ভুলেননি (পৃষ্ঠা ৫৯)। 

পঞ্চম
দেশভাগের সেই সময়ের পটভূমি ও হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস এবং বইয়ে বিভিন্নভাবে আমাদের কাছে চিত্রায়িত হয়েছে। খুশবন্ত সিং এর ট্রেন টু পাকিস্তান; জিন্নাহ: ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা; মাওলানা আবুল কালাম আজাদ: ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: পূর্ব-পশ্চিম; আহমেদ রফিকের বিশ্লেষণধর্মী ফিরে দেখা বইসমূহে সে সময়ের ট্রাজেডি আমি উপলব্ধি করি। কয়েকজনের ভুলের মাসুল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল আর ধর্মের দোহাই দিয়ে এভাবে ভাগ হয়ে যাওয়াকে অনেকে তুলনা করেছেন জীবিত প্রাণীর শবব্যবচ্ছেদের অসহ্য যন্ত্রনার সঙ্গে। এ যন্ত্রনা পাঠক মাত্র মানুষের মনস্তত্বকে তাপদগ্ধ ও অসাড় করে দেয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও সেই ট্রেজেডির ছোয়া পাওয়া যায়। সেই সময়ের পটভূমি চিত্রায়নে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ উপস্থিতিতে বর্ননাগুলি বিমূর্ত হয়ে উঠে আমাদের মানসপটে।১৯৪৭ সালের জুন মাসে যে ভারতবর্ষ ভাগের ঘোষনা আসে তাতে কংগ্রেস রাজি হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে। হাস্যকর ছিল একদিকে বাংলাকে ভাগ হতে না দেওয়ার জন্য আন্দোলন চলছে অন্যদিকে ‘গোপনে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ফর্মুলা। অথচ বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারনা (পৃ. ৭৩)। ’বাংলা ভাগ না করা জন্য সেই সময়ের বাংলার নেতাদের আকুতি পরিস্ফুটিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর লেখায়। কংগ্রেসের সাথে মাউন্ট ব্যাটেনের সুসম্পর্ক, মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর হওয়ার ইচ্ছা, তাতে জিন্নাহর বাঁধ সাধা, রাডক্লিফ এর সীমানা চিন্থিতকরণে মাউন্ড ব্যাটেনের হস্তক্ষেপ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু অকপটেই।

ষষ্ঠ
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কূটচাল আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে। একটা মহল সবসময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষনতা ও কর্মক্ষমতাকে হিংসা করতেন। এই মহলটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নেতৃত্ব থেকে নামিয়ে নাজিমুদ্দিনকে বসাবার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল কলকাতা ও দিল্লী থেকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই সময় সমগ্র বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অথচ ষড়যন্ত্র করে কাউন্সিলদের ভোটে খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। সেই সময়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষনে বঙ্গবন্ধুর কাছে মনে হয়েছিল, পাকিস্তানের জন্য সেই সময়টা যতটা না ছিল নেতা নির্বাচন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রশমন, হিন্দুস্থান থেকে নিজ দেশের জন্য সম্পদের ভাগবাটোয়ারা আর সিলেটের গণভোট। অথচ নেতাদের সেদিকে ভ্রক্ষেপই ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কলকাতা, নোয়াখালী ও বিহারের দাঙ্গা বিধ্বস্তদের সহায়তা দান, মুসলিম লীগের সংগঠন, দিল্লী, কলকাতা দৌড়াদৌড়ি নিয়ে যখন সোহরাওয়ার্দী কাজ করছেন তখন নেতা করার জন্য আর একজনকে আমদানি করা কতটা অন্যায় তা বঙ্গবন্ধু সময়ের কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। নির্বাচিত হয়েই তিনি পশ্চিম পাকিস্থানের মুসলমানদের অবস্থা এবং কলকাতা হতে সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা বা কারো সাথে কোন পরামর্শ না করেই রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে ঘোষনা করেন। কলকাতা নিয়ে তখন পর্যন্ত একটা টানাপোড়ান চলছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তখন পর্যন্ত কলকাতা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। যা খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষনা লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে কলকাতা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহজ করে দেয়। এ ধরনের বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য ‘মিশন উইথ মাউন্ডব্যাটেন’ বইটি রেফারেন্স হিসেবে পড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন। কলকাতা পাকিস্থানের না হিন্দুস্থানের হবে তা নিয়ে ইংরেজরা তখনও ঠিক করতে পারেনি। সেই সময়ের পরিস্থিতি এমন ছিল যে কলকাতাকে ‘ফ্রি’ শহর করার বিষয়টিও বিবেচনার মধ্যে ছিল। কলকাতা হিন্দুস্থানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্থানে আসার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুরা কলকাতা পাবার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হত’(পৃ. ৭৮)।

সপ্তম
ছাত্রলীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস ১৯ দিন পর ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখ এর যাত্রা শুরু। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বাপরের বিস্তারিত বর্ণনায় পরিপূর্ণতা পেয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনী। যে আশা আকাঙ্খা আর স্বপ্ন নিয়ে কর্মীরা সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী তরুণ নেতা কর্মীদের পরবর্তী করণীয় বা সাংগঠনিক দিক নির্দেশনা প্রদানের উদ্যোগ হিসেবে গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সমগ্র বাংলার মুসলিম ছাত্র প্রতিনিধিদের এক সম্মেলনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সহযোগী সংগঠন নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সহযোগী সংগঠন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কুষ্টিয়ায় সর্বশেষ কাউন্সিলে প্যানেল নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন এবং সাংগঠনিক প্রাধান্য অব্যাহত রাখেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ইসলামিয়া কলেজকেন্দ্রিক ছাত্ররাই ছিলেন কলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের মূল শক্তি এবং তাঁরা সবাই ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক। দুর্ভাগ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও হোসেন সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের ওপর চালানো হয় জেল-জুলুম, গ্রেফতার নানা নির্যাতন। চলবে...

লেখক : জ্যেষ্ঠ সহ সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।