• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২১, ০১:৩৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৩, ২০২১, ০৭:৪৫ এএম

প্রথম পর্ব

পাঠ উপলব্ধি : আমার দেখা নয়াচীন

পাঠ উপলব্ধি : আমার দেখা নয়াচীন
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

মোহা. শাজাহান আলি ll
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে দৈনিক জাগরণে প্রকাশিত আমার দুই পর্বের লেখাটি (পাঠ-উপলব্ধি) আমার শুভাকাঙ্খীদের নজর এড়ায়নি। এ লেখার পাঠক হিসেবে তারা সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তাদের অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধুকে আরো গভীরভাবে জানার আকুতি আমার হৃদয়ে প্রাণসঞ্চার করেছে। আমি তো মনে করি বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন বাঙালি জাতির জন্য অমূল্য সম্পদ, অসামান্য দলিল, ‘অসামান্য জবানী’ আর বাঙালি জাতির ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু যৌবনের দিনগুলিতে যে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই পাকিস্তানের শাসকরাই তাঁকে ১৪ বছর জেলখানায় বিনাবিচারে আটক করে রেখেছিল। তাই বঙ্গবন্ধুকে জানা মানে বাংলাদেশকে জানা। জন্ম জন্মান্তর থেকে এই সত্য বিরাজমান। বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বাংলার আকাশে তিনটি ধ্রুবতারা। আগামী প্রজন্মের কাছে এই তিনটি বই হবে সকল সত্যের, সকল গবেষণার, সকল চিন্তার অবিনশ্বর দলিল। ‘আমার দেখা নয়াচীন’র পাঠ উপলব্ধি বঙ্গবন্ধুকে জানার ছোট প্রয়াস। এতে ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা মার্জনা করবেন সুধী পাঠকমহল। লেখক হিসেবে নয়, একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মতো এক মহীরূহকে জানার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি মাত্র।

(১ম পর্ব)
বিদেশ না গেলে নিজের দেশকে ভালভাবে চেনা কষ্টকর

১৯৫২ সালে জাতি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীন ভ্রমণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল সে বছরের ০২-১২ অক্টোবর চীনের তৎকালীন রাজধানী পিকিং (বর্তমানে বেইজিং)-এ অনুষ্ঠিত পিস কনফারেন্সে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করা। সেই সময়ের চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে যখন কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন তখন লেখা আরম্ভ করেন। পিকিং-এ পিস কনফারেন্সে যোগদানের পটভ‚মি, পিকিং ভ্রমণ, পিস কনফারেন্সে যোগদান ও চীনের অন্যান্য শহর ভ্রমণকালীন বঙ্গবন্ধুর ‘স্মৃতি নির্ভর’ রচনাটি ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামে গ্রন্থাকারে ফেব্রুয়ারি ২০২০ খ্রিঃ বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রথম প্রকাশ হয়।

মুজিববাদ বা মুজিব আদর্শের সাথে পরিচয় হতে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র গঠনে মনন ও মানসিকতায় নিরেট দেশপ্রেমের বৈভব জানতে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বাঙালি জাতির জন্য একটা অমূল্য সম্পদ। পিস কনফারেন্সে অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু যেমন আরো সমৃদ্ধ ও আলোকিত হয়েছিলেন, তেমনি নিজের দেশকে অনুসন্ধান করারও তাগিদ অনুভব করেছিলেন। চীনে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি চীনের শাসনব্যবস্থা ও সমাজকাঠামোকে নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অনুসন্ধান করেছেন সদ্য বিপ্লবোত্তর গণচীনে মাত্র চার বছরের মাথায় মাও-সে তুং তাঁর আদর্শ, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা দিয়ে কিভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিনি সূতার মালায় বেঁধেছিলেন। ঘটনার চিত্রায়নে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। নিজের দেশের সমাজব্যবস্থা, দেশের উন্নয়নে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা প্রাঞ্জল ও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ফুটে উঠেছে। আদর্শের জন্য বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থেকেছেন। কিন্তু কখনও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বঙ্গবন্ধু আগাগোড়া একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি কারাগারে বন্দি থাকাকালীন সময়ে নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কিন্তু তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না। তাই তাঁর রচনায় তিনি রূঢ় বাস্তবতা স্বীকার করে নিজ দেশে ধর্মীয় উগ্র সাতীক্ষ্ণদায়িকতা, ফতোয়াবাজি আর ধর্মের নামে রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। 

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালি জাতির উপর বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটিতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের পাসপোর্ট তৈরিতে পশ্চিম পাকিস্তান হতে অনুমতি প্রয়োজন হত। পশ্চিম পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীলতার আরেক চিত্র, বঙ্গবন্ধুর পিস কনফারেন্সে যোগদানের জন্য যাত্রার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাসপোর্টে অনুমোদনে সময়ক্ষেপণ। পিস কনফারেন্সে যাবার জন্য প্লেনের টিকিট বুকিং ছিল। প্লেনের সময় ছিল দুপুর ১২.০০ টায়। আর পাসপোর্টের জন্য সরকারের অনুমতি প্রদান করে ঠিক কিছু সময় পূর্বে সকাল ১০.০০ টায়। এর আগে পিস কনফারেন্সে যাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু দোলাচলে ছিলেন। কারণ তিনি পার্টির কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। প্রথমে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। পরে বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খান (তৎকালীন আওয়ামী লীগের ট্রেজারার)-এর অনুরোধে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হলেও আগের দিন পর্যন্ত জানতেন ‘হোম অফিসের অনুমতি নাই’। পরে সাড়ে ১১.০০ টায় পাসপোর্ট পাওয়া যায়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত প্লেন ২৪ ঘন্টা বিলম্ব হয়। এতে বঙ্গবন্ধু কিছু সময় পান নিজের প্রস্তুতি ও অন্য দুই সদস্য আতাউর রহমান ও ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়াকে নিয়ে পিস কনফারেন্সের নির্ধারিত প্লেনে যাত্রা করতে।

একটি সদ্য বিপ্লবোত্তর দেশ গণচীন সরকার তার দেশ পুনর্গঠনে যে উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছিল তা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন। এই উপলব্ধিতে তিনি ঋদ্ধ হয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার হতে ০৮ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখ মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এর পূর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দিয়ে জনগণের কাছে এবং সংসদে অধিকতর জবাবদিহিতামূলক প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ গ্রহণ করতে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি মন্ত্রীসভার সদস্যদের সঙ্গে দু’দফা মিলিত হয়েছিলেন এবং ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন। 

বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং দুঃস্থ-অসহায় ব্যস্তচ্যুত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য নিজকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। দেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, আধুনিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাসহ ভ‚মি সংস্কার। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সুষম বন্টনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২-’৭৩ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের ৬০ ভাগ পল্লী এলাকায় ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর নূরুল ইসলামকে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান এবং প্রফেসর আনিছুর রহমানকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নিয়োগ করা হয় এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-’৭৮ বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয়। সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর যে দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, সততা, সংগ্রাম ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আমার দেখা নয়াচীনে বঙ্গবন্ধুর অনুসন্ধানীমূলক উপলব্ধি ও সূ²বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। চীনভ্রমণ বঙ্গবন্ধুকে নতুনভাবে দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি ছিল নিজের দেশের মাটি ও মানুষকে জানতে বিদেশ ভ্রমণের গুরুত্ব রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিজের দেশে কাজে লাগানোর তাগিদ অনুভব করেছেন। চীন ভ্রমণের কথা বলতে গিয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘বিদেশ না গেলে নিজের দেশকে ভালভাবে চেনা কষ্টকর।’

বঙ্গবন্ধু নয়াচীন ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা এবং একটি নতুন দেশ গঠনে যে আদর্শের কথা উল্লেখিত হয়েছে তা কয়েকটি পরতে নিম্নের অংশে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। পিকিং পৌছার পূর্বে বার্মা (ব্রহ্মদেশ) ও হংকং-এ ট্রানজিট, নয়াচীনে প্রবেশ, সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও সম্মেলনের অভিজ্ঞতা চিত্রায়ন, সম্মেলনের ফাঁকে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, গুরুত্বপূর্ণ শহর পরিদর্শন, দেশগঠনে মাও সরকারের রাষ্ট্রকাঠামো ও উন্নয়ন কৌশল এবং নয়াচীনের লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে নারীর ক্ষমতায়ন, সম্পদের সুষমবন্টন এবং ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতা পর্যালোচনা এবং তৎকালীন বাংলাদেশ প্রেক্ষিত আলোচনা।

ব্রহ্মদেশ (বার্মা) ও হংকং ট্রানজিট
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাত্রার দিন দুপুর ২টায় রেঙ্গুন পৌঁছান এবং হোটেলে অবস্থান করেন। এরপর আতাউর রহমানের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় টাঙ্গাইলের আরফান খান সাহেবের ছেলে আজমল খাঁকে ফোনে তাঁদের অবস্থানের কথা জানানো হয়। তখন আজমল খাঁ নিজে গাড়ি করে তাদেরকে তার দোকান ও বাড়িতে নিয়ে যান। একজন বাংলাদেশি নিজের চেষ্টায় রেঙ্গুনে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যবসা করছেন দেখে বঙ্গবন্ধুর ভালো লাগে। আজমল খাঁ তার স্ত্রীর সাথে বঙ্গবন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি দেশের পরিস্থিতি জানতে চেয়েছিলেন এবং বার্মার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। সেই সময় ব্রহ্মদেশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বহু জায়গা বিপ্লবীদের দখলে ছিল। রেঙ্গুন শহরের পানি বিপ্লবীরা মাঝে মাঝে বন্ধ করে দিত। ‘ব্যান্ডিট’রা দিনে দুপুরে ডাকাতি করত। ভয়ে দিনের বেলা অপরিচিত মানুষ বাসায় আসলে কেউ দরজা খুলত না। আতাউর রহমানের আরেক আত্মীয়ের বাসায় গেলে এই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। রেঙ্গুনে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর সফরসঙ্গীরা ‘ক্লাব, বৌদ্ধদের প্যাগোডাসহ সব ভালো ভালো জায়গা দেখে সময় কাটান। রাতে রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করেন। রাষ্ট্রদূতের অত্যধিক জাঁকজমক ছিল দৃষ্টিকটু। যে দেশের সাধারণ মানুষের ভাত নাই, কাপড় নাই, থাকবার মতো জায়গা নাই, সেই দেশের রাষ্ট্রদূতের এত শান-শওকত ও জাঁকজমক অপ্রত্যাশিত ও দৃষ্টিকটু। ব্রহ্মদেশে কম্যুনিষ্ট ও কারেন সতীক্ষ্ণদায় তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এ বিপ্লব যথাযথ প্রক্রিয়ায় ছিল না। যদিও বার্মার প্রাকৃতিক বৈচিত্র ঘন জঙ্গল, বিরাট  বিরাট বন, পাহাড় ও নদীর জন্য বিপ্লবীরা সুবিধা পেয়েছিল কিন্তু তাদের কৌশল ও আদর্শে ভুল ছিল। বার্মার কম্যুনিষ্টদের জনসমর্থন ছিল না। মাঝে মাঝে তারা রেঙ্গুনের শহরের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিত। মানুষের কাছ থেকে জোর করে টাকা, খাদ্য আদায় করত। জনসমর্থন ছাড়া এ ধরনের বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে বঙ্গবন্ধু সন্ধিহান ছিলেন।

পরদিন খুব সকালে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর সফরসঙ্গীরা প্লেন করে বাংককের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ব্যাংকক হয়ে হংকং-এ পৌছান বিকেল ৪ টায়। যাত্রাপথে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সাথে প্লেনের বামপিং নিয়ে ঠাট্টার বিষয়টি ছিল প্রাঞ্জল ও চমৎকার। প্লেন মেঘের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় নিচের দিকে নেমে পড়ে। যা প্লেনের নিত্যনিয়মিত বিষয়। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলিতে আবহাওয়া একটু খারাপ হলে বা একটু ঝড় বৃষ্টি হলে এ ধরনের বাম্পিং আমরা নিয়মিত অনুভব করি। মেঘের মধ্যে হাওয়া থাকে না বলে বাম্পিং হয় এ ধরনের মজার বিষয়গুলি বইটিকে প্রাণবন্ত করেছে। 

হংকং-এ অবস্থান, এর সৌন্দর্য বর্ণনা এবং হংকং নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তি ছিল চমৎকার। হংকং-এর সৌন্দর্যে বঙ্গবন্ধু বিমোহিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন: ‘পাহাড়ের উপর থেকে আস্তে আস্তে একটা দেশ নিচের সমুদ্র পর্যন্ত নেমে আসছে।’ প্রকৃতপক্ষে মাঝে মধ্যে নদী, ছোট বড় বাড়ি, সমুদ্রের পাড়ে জাহাজের যাতায়াত এবং ছোট লঞ্চগুলির ছোটাছুটি হংকংকে অপূর্ব করেছে। হংকং-এর যে সৌন্দর্য বঙ্গবন্ধু অবলোকন করেছিলেন তাঁর লেখনিতে সেটা ফুটিয়ে তুলা সম্ভব নয় বলে অকপটে মন্তব্য করেছেন। একজন মানুষ কতটুকু সরল হলে এমন বহিঃপ্রকাশ করতে পারেন সেটা সহজেই বোধগম্য।

সেই সময় হংকং ছিল ইংরেজ কলোনি। হংকং-এ তখন ইংরেজদের শাসন চললেও তারা পর্যটকদের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। মানুষকে হয়রানি করতেন না। ইংরেজদের শিষ্ঠাচার ও তাদের কৌশলগত ভালো ব্যবহারের কারণে বঙ্গবন্ধু ইংরেজ জাতকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অবশ্য ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হংকং-এর শাসন ব্যবস্থা চীনের কাছে প্রত্যাবর্তন করে। ‘একদেশ দুই পদ্ধতি’ নামে এ চুক্তিতে সেই সময় মূলত হংকং-এর বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল যা ২০৪৭ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু এটাও সত্য যে, হংকং-এর প্রতি চীনের কঠোর নজরদারি রয়েছে। যেমন : হংকং এর জন্য নিরাপত্তা আইন ও সদ্য পাস হওয়া নির্বাচন সংক্রান্ত দেশপ্রেম বিধি ইত্যাদি। 

বঙ্গবন্ধু হংকং ঘুরে বিভিন্নভাবে হংকংকে জানার চেষ্টা করেছিলেন। হংকংয়ের বহু দোকান সিন্ধু প্রদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে সিন্ধু প্রদেশে হিন্দু সতীক্ষ্ণদায়ের লোকজন বেশি ছিল। দেশভাগের সময় বহু হিন্দু সতীক্ষ্ণদায়ের লোকজন ভারতে চলে যায়। এটা নিয়ে তখনও অস্থিরতা ছিল। এ বিষয়ে সিন্ধু প্রদেশের একজন হিন্দু যিনি হংকং-এ ব্যবসা করছিলেন তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘দেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা?’ বঙ্গবন্ধু সে ধরনের আশংকা মাথায় রেখেই দৃঢ় কন্ঠে বলেন, ‘আইন করে কারও কন্ঠরোধ করার উদ্দেশ্য আমাদের দলের নাই।’ বঙ্গবন্ধুর সাথে কথোপকথনে ভদ্রলোক আশ্বস্ত হতে পেরেছিলেন বলেই চীন সম্পর্কে বিভিন্ন কথিত তথ্য বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যারা নয়াচীন যায়, যাবার সময় একরকম থাকে আর ফিরে আসার সময় আর একরকম হয়ে যায়।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ওখানে গেলে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা তাদের মুগ্ধ করবে, মেয়েরা তাদের ব্যস্ত রাখবে এবং আদর করবে এত বেশি যে তারা দুনিয়া ভুলে যাবে।’

এ ধরণের মিথ বা প্রচলিত কথা হংকং-এ বহুল প্রচারের কারণ হিসেবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। চীন থেকে পালিয়ে আসা জুজুর ভয়, মিথ্যা প্রচারণা এবং একসাথে অনেক লোক হঠাৎ করে হংকং এ আশ্রয় নেয়া ইত্যাদি কারণে সেখানে বিভ্রান্তিমূলক নানা কথা বিদ্যমান ছিল। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরসঙ্গী আতাউর রহমান, মানিক মিয়া ও ইলিয়াস সাহেব রাস্তায় বেড়ানোর সময়ে হংকং-এ মেয়েদের প্রেম নিবেদন নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতেন। কারণ পরের দিন তাদের চীনে যেতে হবে। চলবে...

লেখক জ্যেষ্ঠ সহ সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।