• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২২, ০৪:২৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৭, ২০২২, ০৪:২৩ পিএম

ছয় দফা : অভীষ্ট গন্তব্যের লক্ষ্যভেদী অভিযাত্রা

ছয় দফা : অভীষ্ট গন্তব্যের লক্ষ্যভেদী অভিযাত্রা

ছয় দফা ছিল বঙ্গবন্ধুর সময়োপযোগী একটি রাজনৈতিক কৌশল। এ রাজনৈতিক কৌশলটি অবলম্বন করে এবং যথাযথভাবে এর প্রয়োগ ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার আপামর জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন এ কারণে যে, পূর্ব বাংলার হতভাগ্য মানুষের মুক্তি ও তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ জোরালো দাবি নিয়ে রাজপথে থাকেননি। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যখন বঙ্গবন্ধুকে আইয়ুব খানের সামরিক জান্তা বাহিনী ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা কর্মসূচি প্রণয়নের অপরাধে গ্রেফতার করে।

১৯৪৭’র দেশভাগে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অংশীদার হতে বাধ্য হয়েছিলেন শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হওয়ার কারণে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত ধারণায় একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয় পাকিস্তান। কিন্তু পূর্ব বাংলার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনার স্বচ্ছ প্রকাশ যুগ যুগ ধরে লালিত-পালিত হয়ে আসছিল সেখানে পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল বিপরীতমুখী। বিষেশত তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ভিন্নতা এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়কে বিষময় করে তুলেছিল। বিভ্রান্তির ভারতবর্ষ বিভক্তির রাজনৈতিক কূটচালে পূর্ব বাংলার জনগণকে বোকা বানিয়ে পাকিস্তানি শাসক, বুরোক্রাট ও সমরসেনারা প্রথমেই বৈষম্যমূলক নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে এ অঞ্চলে উপনিবেশ শাসনের পায়তারা আরম্ভ করে। হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী এই বৈষম্যমূলক পীড়নের প্রতিবাদ করে বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ব্রতী হলেও একমাত্র শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে, হতভাগ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করে পূর্ব বাংলার জনগণকে একটি পৃথক আবাসভূমির স্বপ্নে জাগ্রত করেছিলেন। আরও বিস্ময়কর সত্য হলো- বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের মানুষের সে স্বপ্নটিকে বাস্তবে পরিণত করে গেছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে তুলে ধরার প্রক্রিয়াটি ছিল ভীষণ কষ্টসাধ্য প্রতিকূল। তিনি দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এগিয়েছেন, ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও এর প্রায়োগিক দক্ষতার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্নকে জাগরুক করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে অনুভবের প্রয়োজনীয়তা এ কারণে এখন খুব বেশি প্রাসঙ্গিক যে, আমাদের ব্যক্তিজীবনের নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই অসম ধারাটিকে যদি সোচ্চারকণ্ঠে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হই আমরা, তাহলে আরেক অন্ধকার আমাদের জীবনকে গ্রাস করবে। তাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন থেকে বাঙালি জাতির মানসগঠনের চির প্রবহমান ধারাটিকে কোনোভাবেই হারানো যাবে না। বরং অনিবার্য হবে তাঁর জীবন-দর্শন থেকে আরও আরও পাঠ গ্রহণের। 

১৯৪৭’র দেশভাগ পরবর্তী চব্বিশ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী রাজনৈতিক ঘোষণা। পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা ঠিকই অনুধাবন করেছিল ছয় দফা আন্দোলনের মধ্যে বাঙালির স্বাধীন জাতিসত্তা গঠনের বীজটি রোপিত আছে। ভীত সামরিক জান্তারা তাই বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে অন্তরীণ রেখে এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনটি রহিত করতে উদ্যোগ নেয়। কারাগারে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বজন ও পরিবার সদস্যদের এ মর্মে আদেশ দিয়েছিলেন যে, ছয় দফা ছাড়া বাঙালি জাতির পৃথক আবাসভূমি গঠনের কোনো প্রক্রিয়ায় সফল হবে না। ছয় দফাই হলো বাঙালির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধুর আদেশটি পালনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চেয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছার অবদান কোনো অংশেই কম নয়। তিনি দৃঢ়তার সাথে ছয়-দফার বিভিন্ন দিক নিয়ে রচিত ঘোষণাপত্রটি জনতার মাঝে শুধু বিলিয়েছেন তা-ই নয়, তিনি বরং ওই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ রেখে ছয় দফার আন্দোলনকে সফল করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর আবাসস্থলে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ছয় দফা আন্দোলনকে বেগবান করতে। এ মহীয়সী নারীর উদার সহযোগিতা এবং আন্তরিক আগ্রহ না থাকলে ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের গতি এমন প্রকট হতো না।

ছয় দফা কর্মসূচির মধ্যে বাঙালি জাতির অধিকার এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান খুবই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিকে বঙ্গবন্ধু গভীর তাৎপর্য দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন বলেই ছয়-দফায় এ সংক্রান্ত বিষয়কে বঙ্গবন্ধু সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া অর্থনৈতিক মুক্তির প্রসঙ্গটি পাকিস্তানি শাসকশ্রেণিকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। তারা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাদের খুব কৌশলে অপপ্রচারের মাধ্যমে কালিমা লেপনেরও চেষ্টা করেছিল। খুব সামান্য সংখ্যক বাঙালি এতে বিভ্রান্ত হলেও আপামর জনতা ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। ছয় দফা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধু যে সহজ সরল ভাষার প্রয়োগ ঘটান এটাও ছিল ছয় দফা আন্দোলনের একটা সাফল্যের উল্লেখযোগ্য দিক। বঙ্গবন্ধু জানতেন বাংলার সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে হলে তাদের উপযোগী ভাষায় কর্মসূচি প্রণয়ন করা আবশ্যক।

ছয় দফা ঘোষণার নেপথ্যে একটি সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষকে অবহেলিত ও অনিরাপদ রাখার বিষয়টি এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর ভেতর ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং তাদের অবহেলা ও উদাসীনতায় এই অঞ্চলের জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ভয়ঙ্কর দিন অতিবাহিত করেছেন। বাঙালির জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক ঘটনা ছিল সে সময় ভারত পূর্ব বাংলায় কোনো ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করেনি।

তারা যদি আক্রমণ করতেন তাহলে পূর্ব বাংলার জনগণ আত্মরক্ষার কোনো সুযোগও পেত না। কেননা পূর্ব বাংলায় সামরিকবাহিনীর উল্লেখযোগ্য কোনো শক্তি তৈরি করা হয়নি। আর বারো’শ মাইল দূর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বা সামরিকবাহিনী আক্রমণ মোকাবেলা করতে আসবে এমনটা ভাবাটাও ছিল বোকামী। পাকিস্তানের সব সরকারই বাংলার ঊর্বরভূমিকে ব্যবহার করেছে এবং লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে এ অঞ্চলের সম্পদ; কিন্তু এ জনপদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। তাদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থেকে হাতে গোনা কয়েকজন সামরিকবাহিনী ও সিভিল প্রশাসনে উচ্চপদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রাপ্য সম্মানে অধিষ্ঠিত করা হয়নি।

পাক-ভারত যুদ্ধের অবসান ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রসিদ্ধ নগর তাসখন্দে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এ চুক্তির কোথাও পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে একটি কথাও উল্লেখ করা হয়নি। ফলে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর রাজনৈতিক মিত্রদের বড় অংশটি হতাশ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নানা রকম বৈষম্যের সাথে যুক্ত হয় নতুন আরেকটি বিষয় আর তা হলো পূর্ব বাংলার মানুষের নিরাপত্তা। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার কোনোদিনই পূর্ব বাংলার জনগণের মৌলিক অধিকার ও তাদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করবে না। তারা বরং শোষণ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে এদেশের সম্পদ আত্মসাৎ করবে। বঙ্গবন্ধু এই শোষকচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পথটিকে তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য জনবান্ধব রাজনীতির সূচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অসম নীতি, শোষণ-বঞ্চনা এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার প্রসঙ্গটি বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনসভায় উত্থাপন করে শাসকচক্রকে সতর্ক করে দিতে থাকেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি সম্মেলন শুরু হয়। সৈয়দ মুহাম্মদ আফজাল তখন কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি। তার সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলন। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হয়ে সবজেক্ট কমিটির সভায় ছয় দফার বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির সাথে অন্যান্য বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমে ছয় দফার প্রস্তাবকে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধাচারণ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল বলে মন্তব্য করা হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সংবাদ সম্মেলন করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ খণ্ডন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি স্বদেশের মাটিতে ফিরেই সাংবাদিকদের ছয় দফার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেন। একথা সত্য যে, বঙ্গবন্ধু ছয়-দফার মাধ্যমে মূলত: পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকে পরোক্ষভাবে উত্থাপন করেছিলেন।

আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ছয় দফা অনুমোদন করে সারা দেশব্যাপী এর স্বপক্ষে প্রচারণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে কেন্দ্রীয় সরকার ভীত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু যখন যেখানে জনসভা করতেন সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হতো। এসবে ভীত না হয়ে তিনি সংগ্রামের পথেই হেঁটেছেন। জনগণের অধিকার আদায়ে তিনি কোনো সমঝোতা করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার লেখা একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক জনসংযোগে ভীত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে মাত্র দু মাসের ব্যবধানে ৮ বার গ্রেফতার করে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের জনসভা থেকে বাসায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু এবং সেদিনই তাঁকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসা থেকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে অনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার ও মিথ্যে মামলা আরোপের প্রতিবাদে জনসভা করে। জনসভায় বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য ছয় দফার বিকল্প পথ নেই বলে মন্তব্য করা হয়। এবং ৭ জুন দেশব্যাপী (পূর্ব পাকিস্তান) হরতাল আহ্বান করা হয়।

হরতালের সমর্থনে সারা দেশের বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে আন্দোলনে শরিক হন। আইয়ুব খানের পুতুল গভর্নর মোনায়েম খানের নির্দেশে হরতালের সমর্থনে প্রতিবাদী জনতাকে নির্বিচারে গুলি চালায় পেটোয়া পুলিশ বাহিনী। ১১ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। হাজারও মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদী জনতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলার মানুষের মুক্তির দাবি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। সর্বস্তরের মানুষ ছয় দফা বাস্তবায়নে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রসর হতে থাকেন। আইয়ুব খানের মসনদ কেঁপে ওঠে; ভীত আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দায়ের করে। ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার শপথ নেন। উনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান আইয়ুব খানের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু এবং বাংলার মানুষের মুক্তির দাবি নিয়ে নির্বাচনের পথে পাকিস্তানি শাসকদের আহ্বান জানান। ১৯৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও ক্ষমতায় যাতে আওয়ামী লীগ অধিষ্ঠিত না হতে পারে তার সব রকম ষড়যন্ত্র তারা করতে থাকে। নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানালেও ভুট্টো ও সামরিক জান্তাদের কুটচালে সব আলোচনা ভেস্তে যায়। অনিবার্য হয়ে ওঠে অসহযোগ আন্দোলন। এর ফলে ছাত্ররা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বাঙালিদের প্রস্তুত হতে বলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণাটি প্রদান করেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের মাধ্যমে এ সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। শুরু হয় মরণপণ লড়াই। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ।

৩০ লাখ শহীদ, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর। নতুন রাষ্ট্রের নতুন মানচিত্র নিয়ে বাঙালি আনন্দে উদ্বেল হলেও এক মহাশূন্যতা তাদের গ্রাস করতে থাকে। প্রিয় নেতা, বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার মহানায়কের অনুপস্থিতি তাদের ভাবিয়ে তুলে। বিশ্বনেতাদের তোপের মুখে পাকিস্তান মুক্ত করতে বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশে ফেরেন এ ভূমির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব। কিন্তু চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে এই চক্রান্তকারী ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। এ হত্যাকাণ্ডের ঘোর অমানিশায় আজও জ্বলছে বাংলাদেশের বুভুক্ষ অন্তর। বাংলাদেশের হৃদয়ে অঙ্কিত মহানায়কের দৃঢ় বজ্রকণ্ঠের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত না হলে অভীষ্ঠ গন্তব্যের লক্ষ্যভেদী অভিযাত্রাটা বিফলে যাবে।


লেখক- সাংবাদিক, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী।।

 

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।