• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২২, ১২:২০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ৭, ২০২২, ১২:২০ পিএম

আর্য পরিচয়নামা 

আর্য পরিচয়নামা 

‘আর্য’- এ নাম নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এটা শুধু একটি ঐতিহাসিক বিতর্ক নয়, প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক বিতর্কও বটে। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বিতর্ক; আর্য জনগোষ্ঠী কারা -তা নিয়ে বিতর্ক; তাদের আদি নিবাস নিয়ে বিতর্ক; তারা বাইরে থেকে ভারতে এসেছে নাকি ভারতের আদিবাসী -তা নিয়ে বিতর্ক; তারা সিন্ধু তথা ভারতীয় সভ্যতার কারিগর নাকি বিনষ্টকারী -তা নিয়ে বিতর্ক। তাদের ভারতে আগমণের সময় নিয়ে বিতর্ক; বাংলায় আগমণ ও বসতি বিস্তার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
 
আর্য ভাষা বিতর্ক: ইউরোপীয় গবেষকদের অনেকেই ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল আগ্রহী হন। ফিলিপো স্যাসেটি Filippo Sassetti (1540-1588) নামে এক ইতালীয় বনিক ফ্লোরেন্স থেকে ভারতে এসে গোয়া ও কেরালায় বসবাস করেন (১৫৮৩-১৫৮৮)। শেখেন সংস্কৃত। এরপর তিনি লক্ষ্য করেন- সংস্কৃত ও ইতালীয় ভাষার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। তারপর থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের চর্চা শুরু হয়। ব্রিটিশ জেসুইট পাদ্রি Thomas Stephens (১৫৪৯-১৬১৯) ভারতের গোয়াতে এসে মারাঠি ও কন্নড় ভাষা শেখেন। তিনি গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার সাথে ভারতীয় মারাঠি ও কন্নড় ভাষার সাদৃশ্যের উল্লেখ করে নিজের ভাইয়ের কাছে চিঠি লেখেন। আরেক ফরাসি জেসুইট পাদরি GASTON-LAURENT COEURDOUX (1691-1779) ভারতে এসে  অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক ইত্যাদি এলাকায় খ্রিষ্টবাদের প্রচার করতে থাকেন। শেখেন সংস্কৃত ও তেলেগু ভাষা। রচনা করেন তেলেগু-ফরাসি-সংস্কৃত অভিধান। দেখান -তিন ভাষার বিপুল সাদৃশ্য। এরপর এ প্রশ্ন জোরালো হয়ে ওঠে যে, এ সাদৃশ্যের উৎস কোথায়?

ডাচ পণ্ডিত MARCUS ZUERIUS VAN BOXHORN (১৬১২-১৬৫৩) হাজির করেন স্কিথিয়ান নামে এক আদিম ভাষার বয়ান, যা থেকে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ভাষা। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস পারসন্স ‘THE REMAIN OF THE JAPHET’ গ্রন্থে দাবি করেন যে, ইউরোপীয় ও ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষ একই।

১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-১৭৯৪) এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, কলকাতায় প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলেন-- গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতের ধাতুরূপ ও ব্যাকরণের মধ্যে গভীর মিল রয়েছে। গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক, কেল্টিক, সংস্কৃত, পারসিক, জার্মান ইত্যাদি একই উৎস থেকে উদ্ভব। একই উৎস থেকে উদ্ভব হয়ে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে। তবে অনেক পণ্ডিত তাঁর এ মতের সাথে একমত হতে পারেননি।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ গবেষক থমাস ইয়ং (১৭৭৩-১৮২৯) ইউরোপ ও এশিয়ার আদিম ভাষার নাম দিলেন ইন্দো-ইউরোপীয়। এই ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিন্দি, ইংরেজি, ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, রুশ, বাংলা, জার্মানসহ বহু ভাষা। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মান পণ্ডিত ফ্রেডারিখ ম্যাক্সমুলার (১৮২৩-১৯০০) ভাষাতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথম আর্য শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর ‘The Home of the Aryas’ গ্রন্থে বলেন, আর্য একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম, কোন জাতির নাম নয়। তাঁর মতে, আর্য জনগোষ্ঠী ভারতে এসে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আর্যরা ছিলেন ইন্দো-পার্সিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর। উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের আর্যরা ছিলেন ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অধিকারী।

আর্য কারা: যারা আর্য ভাষায় কথা বলে তারাই আর্য জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত। সংস্কৃতে আর্য শব্দের অর্থ সৎ বংশজাত ব্যক্তি। ককেশীয়, সেমিটিক, হ্যামেটিক, নর্ডিক, আলপীয় সকলেই আর্য গোষ্ঠীভুক্ত। R.C. Mazumdar says in his book `The Ancient Indian History’ that the Aryans are the forefathers of the Greek, the Roman, the German, the English, the Dutch, the Scandinavian, the Spanish, the French, the Russian and the Bulgarian nations. He says, there are similarity in some words among Sanskrit and Europian languages. Like, the Sanskrit words pitar and Matar are essensially the same as Pater and Mater in Latin, Pater and Meter in Greek, Father and Mother in English, and Vater and Matter in German, all denoting the notion of parents. লম্বা মাথা, নাক সরু থেকে মাঝারি, রং ফর্সা, পুরুষের মুখে দাড়ি, গোফের প্রাধান্য এবং বলিষ্ঠ গড়ন এদের মূল বৈশিষ্ট্য।

আর্য জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস বিতর্ক: গর্ডন চাইল্ড সোভিয়েত রাশিয়ার দক্ষিণাংশে তৃণভূমিকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তার মতে উল্লিখিত অঞ্চলের বিভিন্ন মাটির ঢিবিযুক্ত কবর খুঁড়ে একশ্রেণির মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে যাদের ছিল লম্বা ও সুগঠিত চোয়াল, সরু নাসিকা ও লম্বা মাথা অর্থাৎ নর্ডিক গোষ্ঠীভুক্ত। এর সঙ্গে পাওয়া গেছে অশ্বের অস্থি ও আর্যদের ব্যবহৃত অন্যান্য কিছু উপাদান। ড. গাইলস বর্তমান অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি অঞ্চলকেই আর্যদের আদি বাসভূমি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইন মনে করেন যে, উরাল পর্বতের দক্ষিণে কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি শব্দতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রথম দিকের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে কোনো পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ স্তেপভূমিতে আর্যদের আদি বাসভূমির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জমি, গাছপালা এবং জীবজন্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে শুষ্ক স্তেপভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দাবলীর পরিবর্তে জলাভূমির স্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী শব্দাবলী পাওয়া যায়।

বর্তমানে অধিকাংশ পন্ডিতই ব্র্যান্ডেস্টাইনের মতের সমর্থক এবং তাঁরা মনে করেন যে, কিরঘিজ অঞ্চলই আর্যদের আদি বাসভূমি। পণ্ডিত কোসিনারের মতো গবেষকদের দাবি, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল উত্তর ইউরোপীয় উপত্যকায়। বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, প্রাচীন আর্যজাতির বাস ছিল ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীতে উত্তর মেরু অঞ্চলে। অধ্যাপক জে এল মায়ার্স, হ্যারল্ড পিক এবং গর্ডন চাইল্ড মনে করেন খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এদের নিবাস ছিল দক্ষিণ রাশিয়াতে এবং তার পূর্বাঞ্চল কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। একদল পন্ডিত মনে করেন যে, আর্যরা আদিতে ভারতবাসী ছিল। আর্যদের প্রাচীন গ্রন্থ বেদ। বেদ ভারতে রচিত হয়েছিল। বেদে যে সপ্ত সিন্ধু যথা শতদ্রু, ইরাবতি, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, ঝিলাম, সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর উল্লেখ রয়েছে তা থেকে তারা মনে করেন, আর্যরা ভারতীয়। পরবর্তীকালে তারা ভারতের বাইরে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আর্যরা ভারতীয়, না বৈদেশিক অথবা আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায় এ বিষয়ে বিতর্ক আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। ভাষাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য এখন সুপ্রমাণিত যে আর্যরা বৈদেশিক।

এ থেকে মনে করা যায় যে, ঋগবেদের রচনা শুরু হয়েছিল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। অধ্যাপক ব্যাশাম মনে করেন যে, ঋগবেদের রচনা কাল ছিল ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এ সব বিবেচনায় পন্ডিতগণ মনে করেন আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে প্রথমে আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তারা ‘সপ্তসিন্ধু' নামে আখ্যা দিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে লোহার প্রচলন ঘটলে আর্যরা দ্রুত বসতি বিস্তার করতে সক্ষম হয়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে গোচারণ ভূমি, বনজ সম্পদ এবং কৃষি ক্ষেত্রের ওপর চাপ পরে। পূর্ব ভারতের গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ছিল উর্বর এবং খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ। এসব সম্পদের লোভে এবং পাঞ্জাবে স্থানাভাবের কারণে আর্যরা পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হয়।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর। ই-মেইল rejaulkarim1975@gmail.com

 

 

দ্রষ্টব্যঃ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।