• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২২, ১২:৩১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৬, ২০২২, ১২:৩৫ এএম

আমার প্রাণের মানুষ কই

আমার প্রাণের মানুষ কই

আজ শোকাবহ আগস্টের প্রথম দিন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- সারা পৃথিবী এই শোকের মাসটিকে যখন শোকের আবহে একইভাবে গ্রহণ করছে; বঙ্গবন্ধুকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করছে বা সমব্যথী হয়ে একাত্মতা প্রকাশ করছে, ঠিক তখনই এদেশের ৭৫-এর ঘাতক ও তাদের দোসররা নিজেদের নারকীয় অপকর্মকে আড়াল করতে নগ্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে সপরিবারে জাতির পিতার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সমগ্র বিশ্বই সেদিন একরকম থমকে গিয়েছিল। সমগ্র বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ একইসঙ্গে শোকাভিভূত হয়েছিলেন এবং ঘাতকদের নৃশংস আচরণের জন্যে বাঙালি জাতির ওপর ঘৃণাও বর্ষণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সেদিন একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের কূট ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের শিকার হয়েছিল বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ এবং চেতনা। পরবর্তীতেও আমরা সর্বদাই একই চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি যে ষড়যন্ত্রকারী স্বাধীনতাবিরোধীরা এই আগস্ট মাসকেই কোনো না কোনো অজুহাতে বেছে নিয়েছেন তাদের নানা রকমের ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতা পরিচালনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্যে। এবং আগস্ট আসলেই তাদের সেই হিংস্র ও ঘৃণ্য অপকর্মকে ঢেকে রাখতেই শুরু করে বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট একবার বলেছিলেন, ‘‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজই করতে পারে।’’ হ্যাঁ, সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জাতিকে চিরকাল সেই কলঙ্কের চিহ্ন বয়ে বেড়াতেই হবে। পরিতাপের বিষয় হলো ষড়যন্ত্রকারীরা কিন্ত তারপরও থেমে থাকেনি। তারা বারবার হামলে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে নিচিহ্ন করার অপচেষ্টায়। ২০০৪ সালের এই আগস্টেরই ২১ তারিখ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনই একটি ভয়াবহ কলঙ্কময় দিন। সেদিন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল এই জঘন্য ও পৈশাচিক আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস করে দিতে হামলে পড়েছিলো সেই ১৫ আগস্ট-এর ঘাতকেরা এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রেতাত্মারা। সুপরিকল্পিত এই হামলা করেছিল যারা তারা কখনই বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি, যেমনটা আজও পারেন না। এবং সেই ঘটনা ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার ধারাবাহিক চেষ্টার এক চূড়ান্ত রূপ কিন্ত সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় ও চোখ তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অলৌকিকভাবে এই যাত্রায়ও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তিনি। সেদিন অসংখ্য নেতা-কর্মী হতাহত হন এবং সেই বীভৎস ক্ষত ও যন্ত্রণা আহতরা তাদের শরীরে আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই।

এর পূর্বেও এই আগস্ট মাসেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সারা দেশে এক যোগে এই ষড়যন্ত্রকারীদের সংঘটিত সিরিজ বোমা হামলার মতো পৈশাচিক হামলার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ এবং তারা তাদের হিংস্র চরিত্রের সাক্ষী হয়েছেন নানাভাবে।

বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারানোর সেই শোকাবহ ও বেদনাবিধুর আগস্ট মাস যখন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পারছি সেই ৭৫-এর ঘাতকেরা বরাবরের মতোই আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আজ যারা নির্বাচনকে সামনে রেখে যেকোনো রকমের ইস্যুর অবতারণার নাটক মঞ্চস্থ করার খেলায় মত্ত হয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য একটাই। তা হলো- ৭৫-এ সংঘটিত ঘাতকদের অপকর্মকে যেকোনোভাবে আড়াল করা। আর সেই নাটকের ক্ষেত্র প্রস্ততের তৎপরতার অংশ হিসেবেই তারা ভোলায় ঘটে যাওয়া গতকালের ঘটনাটিকে ব্যবহার করছেন। তারা দাবি করছেন, গতকাল ভোলায় বিএনপির সহিংস বিক্ষোভে নিহত ব্যক্তি তাদের অঙ্গসংগঠনের লোক যদিও তার সত্যতা নিয়ে বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে। এসমস্তই ৭৫-এর ঘাতক বিএনপি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুরনো কৌশল; যা তারা সব সময়ই করে থাকেন।

তাদের পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ীই ভোলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির সারা দেশে তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়ার উদ্দেশ্য এখন পরিষ্কার। যেকোনো প্রকারে মানুষকে উস্কে দিয়ে একটি নৈরাজ্যকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করাই এখন তাদের প্রধান কাজ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ শোকাবহ আগস্টের ইতিহাস থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া এবং তাদের কৃতকর্মকে অনোউন্মোচিত রাখার জন্যেই এ নাটকের অবতারণা; যা তারা সুদীর্ঘকাল ধরে করে আসছে নানা  অজুহাতে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে যে কলঙ্কিত ইতিহাস রচনা করেছিলেন; তাদেরকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন; দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেছিলেন; চূড়ান্তভাবে ক্ষমতায়িত করেছিলেন এবং বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, মির্জা ফখরুল সাহেবরা কিন্ত সেগুলো কোনোক্রমেই বিস্মৃত হননি। আর ভুলে যাননি বলেই এই আগস্ট মাস তাদের গলার কাঁটা। প্রত্যেক বছর এই শোকের মাসের আবির্ভাব হওয়ার পূর্বেই তাদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত করতে হয়। নতুন নতুন নাটকের জন্ম দিতে হয় যেন আগস্টের প্রকৃত ঘটনা এবং নেপথ্যের কুশীলবদেরকে সাধারণ মানুষের মন থেকে আড়াল করা যায় বা বিস্মৃতি ঘটানো যায়।

কিন্ত ‘রাজনীতির কবি’ মানুষের মানসপটে চিরস্থায়ী জায়গা দখল করে নিয়েছেন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো করেই, বাংলার মাটি-জল-প্রকৃতি যাঁর গান করে, সবুজ শস্যের মাঠে যাঁর রক্ত প্রোথিত তাঁকে কোন শক্তি আছে নিশ্চিহ্ন করে, বিস্মৃত করে। কবি রফিক আজাদ তাঁর কবিতায় বলেছেন-- 

“এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-
বত্রিশ নম্বর থেকে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।”
 

মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় এঁকেছেন মহানায়কের এমন অসাধারণ চিত্র-- 

“..কিন্তু এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল
শাপলা-পদ্ম-গোলাপ সেই গোলাপের বুক জুড়ে
ফুটে আছে মুজিবের মুখ
এদেশের প্রতিটি পাখির গানে মুজিবের প্রিয় নাম শুনি,
মনে হয় এরা সকলেই আমার চেয়ে আরো বড়ো কবি।
শেখ মুজিবের নামে প্রতিদিন লেখে তারা নতুন কবিতা।”  

বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ শ্রী চৌধুরী একবার বলেছিলেন, ‘‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।’’  আজ সময় এসেছে বাঙালি জাতির এই কলঙ্কের জন্যে দায়ী চক্রান্তকারী ও তাদের দোসরদেরকে ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলার; সুস্পষ্টভাবে এদের সঙ্গ পরিত্যাগ করার। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন দিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’’

টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করে, ‘বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে মনে রাখবে।’ ৭৫-এর আগস্টে ঘাতকেরা সেদিন যেমন ইতিহাসের নৃশংসতম ও নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞে উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো; ইতিহাসের এক মহানায়কের বুকের রক্তে যেমন সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল শ্যামল বাংলার মাটি, আজও আগস্ট আসলেই তাদের নগ্ন পদধ্বনি শোনা যায় সর্বত্র। জিয়া-খালেদা-এরশাদ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা যেমন ছিনিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানের হত্যার দিনে শোক করার অধিকারকে, আজও তাদেরই উত্তরসূরি ও অনুসারী নখদন্তহীন প্রেতাত্মারা পাকিস্তানি ভাবাদর্শের দেশ গঠনে প্রচণ্ডভাবে সোচ্চার রয়েছেন।

 

 

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ ও দৈনিক কালবেলা।