• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ০৭:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৩, ২০২২, ০৭:২৭ পিএম

জন্মদিন

তিনি ছিলেন শতাব্দীর ছবি

তিনি ছিলেন শতাব্দীর ছবি

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন। আশপাশের সবাইকে তিনি ছাপিয়ে ছাড়িয়ে উঠতেন হৃষ্টপুষ্ট দেহের কারণে। আর মনের দিক থেকে ছিলেন আরও হৃষ্টপুষ্ট, আরও বড়, সংবেদনশীল এবং অনমনীয়। তিনি কখনো  মাথা নত করেননি। তার মেরুদণ্ড ছিল অত্যন্ত শক্ত। এটা সবাই জানতেন। 

বিশেষভাবে জানতেন তার প্রতিপক্ষ, যাদের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন। দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল তার সরব উপস্থিতি। এই দীর্ঘ সময়ে বহু মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, গড়ে উঠেছে সখ্য, তাদের সবার ভাই ছিলেন তিনি। ভাই বলে ডাকলেই তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। যেকোনো মানুষকে ভাই হিসেবে আপন করে নেওয়ার প্রবণতাটা ছিল তার সহজাত। তাই তো বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত রফিক উদ্দীনের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে তার মনে প্রথমেই যে বাক্যটি গুমড়ে কেঁদে উঠেছিল তা হলো- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।’ 

গাফ্ফার ভাই দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে বিচরণ করেছেন। গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। লিখেছেন কবিতা ও গান। তার রাজনৈতিক কলাম ছিল তুমুল জনপ্রিয়। তবে প্রথম যৌবনে লেখা একুশের গানটিকে তিনি কোনো কিছুর মাধ্যমেই অতিক্রম করতে পারেননি। সবকিছু ছাপিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন অমর একুশের গানের লেখক হিসেবে। এই গানটিই তাকে দিয়েছে অমরত্ব। 

গাফ্ফার ভাই ছিলেন শতাব্দীর ছবি। প্রায় সাত দশক সময়সীমায় এই বদ্বীপ রাষ্ট্রের জীবনধারায় যেসব ধারা ও প্রবণতা কার্যকর ছিল, অবস্থান ছিল যেসব চড়াই-উতরাইয়ের, উদ্যোগ ও আকাক্সক্ষার, এর অনেকগুলোই স্পর্শ করেছে তার জীবনকে। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল তার জীবন। অনেক বিচিত্র ঘটনা, পরিস্থিতি এবং মানুষকে তিনি জানতেন। তার ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, গল্প বলার নিপুণ ক্ষমতা ও সদাপ্রফুল্ল কৌতুকবোধ। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত সংগ্রহশালা। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের ঐতিহাসিক ৬ দফা, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ জীবন্ত হয়েছিল তার স্মৃতিতে। তিনি নিজেও জীবন্ত ছিলেন এই স্মৃতিগুলোকে ঘিরে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি তিনি জীবন্ত আমাদের স্মৃতিতে, যারা তার সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম কোনো না কোনোভাবে। 

 কৈশোরেই প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাকে ধারণ করেন। এরপর জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে তার বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতার নানামুখী বিস্তার ঘটছে। কিন্তু অঙ্গীকারটি কখনো ভাঙেননি, আদর্শ থেকে একটুকু বিচ্যুত হননি । তার সব লেখা এবং সব কাজেই দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল একজন স্বচ্ছ প্রগতিবাদীর। গাফ্ফার ভাইয়ের যখন প্রথম সন্তানের জন্ম হয় তখন তিনি তার সেই পুত্রসন্তানের জন্য একটি সুন্দর নাম খুঁজছিলেন। ওই সময় প্রকাশ হয় প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘অনুপম দিন’। 

এই নামটি তার খুব পছন্দ হয়। তাই উপন্যাসের নামানুসারে তিনি তার ছেলের নাম রাখেন অনুপম। ওই সময় গাফ্ফার ভাই দৈনিক আজাদে চাকরি করতেন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ। গাফ্ফার ভাইয়ের ছেলে হওয়ার পর অফিসে যেতেই মওলানা আকরম খাঁ তাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার নাকি ছেলে হয়েছে। আর তুমি নাকি তোমার সেই ছেলের হিন্দু নাম রেখেছ।’  সবাই তাকে হুজুর বলতেন । উত্তরে গাফ্ফার ভাই বলেন, ‘হুজুর, অনুপম তো বাংলা শব্দ। আমি যদি আমার ছেলের নাম দুর্গা প্রসন্ন কিংবা কার্তিক চন্দ্র রাখতাম তাহলে হিন্দু নাম হতো। আপনি নিজেও তো আপনার ছেলেদের বাংলা নাম রেখেছেন। একজনের নাম মুকুল, আরেক জনের নাম বকুল, এগুলো কি হিন্দু নাম।’ 

গাফ্ফার ভাইয়ের মতে, ‘আকরম খাঁ রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক ছিলেন। কিন্তু মনের দিক থেকে ভীষণ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। আমাদের দেশে এখনও অনেক মানুষ আছেন, যারা সাম্প্র্রদায়িক রাজনীতি করেন। কিন্তু মনেপ্রাণে এবং জীবনাচরণে তারা অসাম্প্রদায়িক।’
 
গাফ্ফার ভাই সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। প্রথম যৌবনে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, শফিক রেহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়ীদ আতিকুল্লা, ফজলে লোহানী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জামালুদ্দীন প্রমুখ। পঞ্চাশের দশকে তাদের আড্ডা ছিল সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের বাড়িতে। পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে অবস্থিত ‘লয়্যালস্টিক’ নামের ওই বাড়িতেই ছিল সওগাতের অফিস। অফিসের পাশে গুদামঘরে বসত তাদের সাহিত্যের সভা। সওগাতের অফিস সহকারী রওশন এবং মোসলেম নামের দুই বালক তাদের সবাইকে চা এবং শিঙাড়া খাওয়াত। আর এই চা ও শিঙাড়ার বিনিময়ে গাফ্ফার ভাইকে বেগম পত্রিকার জন্য মেয়েদের নামে কবিতা লিখে দিতে হতো। হাসান হাফিজুর রহমান তখন বেনামে বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। মেয়েদের নামে তাকে স্যুয়েটার বুননের কলাকৌশলসহ বিভিন্ন ফিচার লিখতে হতো। তাদের আড্ডায় একমাত্র নারী ছিলেন রাবেয়া খাতুন। তিনি একবার সবাইকে একটি রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন। গানটি ছিল- ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে/ দিসনে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে।’

রাবেয়া খাতুনের ‘ভোরে’ উচ্চারণ নিয়ে ফজলে লোহানী খুব হাসাহাসি করতেন। এই রাবেয়া খাতুনই হলেন পরবর্তী সময়ের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। কয়েক বছর আগে রাবেয়া খাতুনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গাফ্ফার ভাই তাকে বাংলাদেশের আশাপূর্ণা দেবী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। 

গাফ্ফার ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। কিন্তু গাফ্ফার ভাই সৃজনশীল লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেননি। ফলে তার সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন শফিক রেহমান। তার সঙ্গে শফিক রেহমানের যখন দেখা হতো তখন গাফ্ফার ভাই একগাল হাসি দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। সেই সঙ্গে বলতেন, ‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি’। শফিক রেহমান আমার সম্পাদক ছিলেন। তাকে আমরা শফি ভাই বলে ডাকতাম। অফিসের আড্ডায় গাফ্ফার ভাইয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই শফি ভাই বলতেন, ‘গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন একজন সাহিত্যিক। কিন্তু তিনি কখনোই সেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন না। তার অপার সম্ভাবনা ছিল সাহিত্যে। আজকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে সবাই চেনে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের লেখক আর কিছু রাজনৈতিক কলামের জন্য। কিন্তু সে তো আসলে একেবারেই ভিন্ন কিছু হতে পারত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণের মতো লেখকদের পঙ্ক্তিতে জায়গা করে নিতে পারত। আমার দুঃখ লাগে যে, এটা সে করল না।’

এই ব্যর্থতার কারণ বিষয়ে গাফ্ফার ভাইয়ের ভাষ্য হলো- প্রথম কারণ ওই সময় গল্প-উপন্যাসের বাজার ছিল ভারতীয় লেখকদের দখলে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল একচেটিয়া বাজার। এমনকি ভারতীয় লেখক শশধর মুখোপাধ্যায়ের বইও তখন খুব বিক্রি হতো। অন্যদিকে বাংলাদেশি লেখকের ১২শ কপি বই বিক্রি হতে সময় লাগত কয়েক বছর। অন্য কারণটি বৈষয়িক। বিয়ের পর দেখলেন, একটি উপন্যাসের জন্য প্রকাশকরা একশ টাকা দেয়। এই একশ টাকা দেয় কয়েক মাস ঘুরিয়ে এবং কয়েক কিস্তিতে। এতে সংসার চলে না। কিন্তু খবরের কাগজে রাজনৈতিক কলাম লিখলে তখন মাসে চারশ টাকা পাওয়া যেত। ওই যে রাজনৈতিক কলামের দিকে তিনি ঝুঁকে পড়লেন এরপর আর ফেরা হয়নি।

গাফ্ফার ভাইয়ের আরও একটি ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ২০০৬ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৭ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। লন্ডন থেকে ঢাকায় এলে তিনি উঠতেন তার বন্ধু মোনায়েম সরকারের ২৩ চামেলীবাগের বাসায়। ওই বাসাতেই সবাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে যেতেন। সেখানেই গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে জমে উঠত আড্ডা। 

গাফ্ফার ভাই খ্যাতিমান কলামিস্ট ছিলেন। সেদিক থেকে অত্যন্ত সফল তিনি। তার কলামে সমালোচনার ক্ষেত্রে কাউকে কোনো দিন এতটুকু ছাড় দেননি। যদিও তিনি ভীষণ নরম মনের মানুষ ছিলেন ভেতরে ভেতরে। ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ ও বন্ধুবৎসল। সে পরিচয় প্রকাশ পেত অল্প পরিচয়েই। দিনে দিনে এই সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতো এবং তিনি সবাইকে সবসময় একটা স্থায়ী সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতেন। দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় তিনি প্রবাসে ছিলেন। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি কখনো ছেড়ে থাকেননি। এ দেশের মানুষের ক্রান্তিলগ্নে তিনি কঠোর হাতে কলম ধরেছেন। সময়ের প্রয়োজনে সশরীরে হাজির হয়েছেন। পেশাগত জীবনে প্রবেশের পর তিনি কখনই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হননি। 

তবে তিনি কখনই নিরপেক্ষ ছিলেন না। বরাবরই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে। তার চরিত্রের একটি দুর্লভ গুণ তিনি রাজনৈতিক কলামিস্ট হওয়ার পরও সব দলের, সব মতের লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখলেও সাংবাদিক সততাকে ক্ষুণ্ন করেননি। তবুও এ দেশে তার লেখার নিন্দা ও সমালোচনা করার লোকের অভাব ছিল না। গাফ্ফার ভাইও তাদের সমালোচনাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলে নেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘আমি যা তার জন্য আমি নিন্দিত হতে রাজি আছি। কিন্তু আমি যা নই তার জন্য আমি প্রশংসিত হতে রাজি নই।’

 

লেখক: সাংবাদিক