• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০১৯, ০৯:৩৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০১৯, ০৯:৩৬ এএম

বেদখলের পথে নাটু বাবুর জমিদার বাড়ি

বেদখলের পথে নাটু বাবুর জমিদার বাড়ি

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বরিশালের বাকেরগঞ্জের শ্যামপুর গ্রামের নাটু বাবুর জমিদার বাড়ি। ১৯৯১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর এই বাড়ি ও জমিদার পরিবার প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। শুধু তাই নয়, ২৫ শে মার্চের পর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছিল জমিদার বাড়িটি। এখানে বসেই হতো মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা।

কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী আদৌ সংরক্ষিত হয়নি মহান স্মৃতি বিজড়িত এই জমিদার বাড়িটি। বরং কালের সাক্ষি হয়ে থাকা জমিদার পরিবারের সম্পত্তি দখল পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগে সম্প্রতি বাকেরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও হয়েছে।

জমিদার কুমুত বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবুর ছোট ছেলে লন্ডন প্রবাসী বিপ্লব বন্ধু রায় চৌধুরি বাদি হয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন শান্তি কমিটির অন্যতম সহযোগী মৃত কাঞ্চন মাস্টারের পুত্র নিজামুল কাদির, মো. রফিক হাওলাদারকে অভিযুক্ত করে ডায়েরি করেছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৬শ শতকের দিকে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন প্রসন্ন কুমার রায় চৌধুরী। ১৯ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত জমিদারির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তাদের পঞ্চম বংশধর কুমোদ বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবু। তবে ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতাবিরোধীরা হত্যা করে। এরপর থেকে হারিয়ে যায় জমিদার বাড়িটির সোনালী ইতিহাস।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজন্ম বিপ্লবী জমিদার নাটু বাবু ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সহচার্যে এসে বাঙালির মুক্তির নেশায় বিভোর ছিলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষটি। 

তবে মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য অবদান রাখা নাটু বাবু বেশিদিন বাঁচতে পারিনি। স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৭৩ সালে তাকে হত্যা করে স্থানীয় রাজাকার হাশেম আলী ও তার সহযোগীরা ।

নাট বাবুর স্ত্রী ছায়া রায় চৌধুরী বলেন, ৭৩ সালে তার স্বামীকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। এসময় বঙ্গবন্ধু নাটু বাবুর হত্যার বিচারের আশ্বাস দেয়। পাশাপাশি সাথে থাকা পাঁচ মাস বয়সী শিশু পুত্র বিপ্লবকে কোলে তুলে নিয়ে চার সন্তানেরই ভরন পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতার এমন সহায়তার আশ্বাস পেলেও তা টিকে থাকেনি বেশি দিন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যার পর আবারো অন্ধকার নেমে আসে জমিদার পরিবারটিতে।

ছায়া রায় চৌধুরী আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠে স্বাধীনতাবিরোধীরা। নানাভাবে হয়রানি শুরু হয় আমার পরিবারের উপর। যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ছায়া রায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে পরিবারটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সব থেকে ভরসার স্থল। যে বাড়িতে শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না হয়েছে আমারই হাতে। সেই আমিই আজ এই পরিবারটিকে টিকিয়ে রাখতে ঘুরছি দ্বারে দ্বারে। স্বাধীনতাবিরোধীরা এতটাই ক্ষমতাবান যে তাদের কাছে মুখ খুলে সত্য কথা বলতে সাহস পায় না গ্রামবাসীরা। তাই তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, পরাধীন বাংলাদেশে যে পরিবারটি স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। সেই পরিবারটি স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে নিগৃত।

এ ব্যাপারে বাকেরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে ভুলু বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া তৎকালীন ছাত্রনেতা ও বর্তমানে কৃষক লীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি খান আলতাফ হোসেন ভুলু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জমিদার নাটু বাবু পরিবার প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তাদের বাড়িটি ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধার খাবার থেকে শুরু করে আবাসনের সকল ব্যবস্থাই করেছিল নাটু বাবু। যুদ্ধকালীন সময়ে নভেম্বরের ১৫ তারিখ, স্থানীয় রাজাকারদের সাথে নিয়ে ওই বাড়িটিতে আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী। সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। আর পাকবাহিনীর ২১ জনকে নিহত করে মুক্তিযোদ্ধারা। তবে ওই যুদ্ধে ৩৫ নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে পাকবাহিনী।

তিনি আরো বলেন, এত কিছুর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ থেকে সড়ে যায়নি শ্যামপুরের এই জমিদার পরিবার। তবে দুঃখজনক এটাই যে মুক্তিযুদ্ধে অসমান্য অবদান রাখা এই মানুষটিকে হত্যা করা হয় স্বাধীনতার পরপরই। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি যেন সরকার সংরক্ষণ করে। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে উপস্থাপন করে।

বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও বরিশাল মহানগর সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম’র সাধারণ সম্পাদক কাজল ঘোষ বলেন, এই পরিবারটি বরিশাল অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছে। সেই পরিবারের সহায় সম্পত্তি দখল করার পাঁয়তারা এটি দুঃখজনক ঘটনা। তিনি সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে এই পরিবারের পাশে দাড়ানোর আহবান জানান।

বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী সালেহ মুস্তানজির বলেন, বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের নজরে এসেছে। তাই এরই মধ্যে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগও নেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে ওই পরিবারটিকে সহযোগিতা করছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কোন স্থাপনা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্পত্তি দখল পাঁয়তারায় প্রশাসন সম্মতি দিবে না। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষই উপজেলা প্রশাসনের কাছে এসেছে। এ ব্যাপারে  বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কেএসটি