• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১, ১১:০৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১, ১১:১২ পিএম

নটর ডেমের ফাদার পিশোতোর চলে যাওয়া

নটর ডেমের ফাদার পিশোতোর চলে যাওয়া

প্রায় সারা জীবন (১৯৬২ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত) এ দেশের মায়ায় কাটিয়ে ফাদার পিশোতো চলে গেলেন আজ (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। নটর ডেম কলেজের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় (২৪ বছর) ধরে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, Father J. S (Joseph Stephen) Peixotto, CSC, নামে যাঁর বিপুল পরিচিতি।

আমাদের সময়ও (১৯৮৬-৮৮) তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন, আবার ক্লাসরুমে পেয়েছি তাঁকে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে। অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে তাঁকে নিয়ে। দু-একটা বলা যাক। ইংরেজি ছিল তাঁর মাতৃভাষা কিন্তু বাংলা বলার জন্য একধরনের একরোখা জেদ ছিল তাঁর। শুনতে মিষ্টিও লাগত। তিনি পড়াতেনও দারুণ সুন্দর কিন্তু সমস্যা হতো ফিজিকসের টার্মগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে। তিনি নিশ্চয়ই ইংরেজিতেই পড়েছিলেন, কিন্তু বলতে চাইতেন বাংলায়। তা নিয়ে ক্লাসে হাস্যকৌতুকও কম হয়নি। যেমন ইংরেজি টার্ম Horse Power-এর বাংলা প্রতিশব্দ বইতে লেখা ছিল ‘অশ্বক্ষমতা’, তাঁর অনুবাদে সেটি হলো ‘ঘোড়াশক্তি’ আর তাঁর উচ্চারণে সেটি দাঁড়াল ‘গোড়াশক্তি’! হর্স পাওয়ার বললেই আমরা সহজে বুঝে যাই, কিন্তু তিনি বলবেনই না, বলবেন ‘গোড়াশক্তি’। আমরা বুঝতে না পেরে যখন জিজ্ঞেস করতাম তখন বোঝতে চেষ্টা করতেন ঘোড়া জিনিসটা কী আর তার শক্তি বলতেই বা কী বোঝায়; অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর বুঝতে পেরে সঠিক শব্দটি আমরা তাঁকে বলে দিতাম আর তাঁর মুখ শিশুর সারল্যমাখা হাসিতে ভরে যেত। এ রকম শিক্ষককে ভালো না বেসে পারা যায়? কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা নটর ডেম কলেজ, আমরা আবার গ্রুপ-ওয়ানের ছাত্র, মানে এলিটের মধ্যে আরেক এলিট।

ক্লাসে কিছু আঁতেল ছাত্র তো সব সময় থাকেই, সে রকম কয়েকজন বাকিদের বোঝাল - এভাবে চললে আমাদের ফিজিকসের সিলেবাস শেষ হবে না, পরীক্ষায় পাব লবডংকা। কী করা যায়? কী আর করা, শিক্ষক বদলানোর আবেদন করতে হবে! কিন্তু সেই আবেদন তো যাবে অধ্যক্ষের কাছে, মানে, স্বয়ং ফাদার পিশোতোর কাছেই, কেমন হয়ে যাবে না ব্যাপারটা? তাতে কি, আমরা তো যৌক্তিক দাবি করছি - আঁতেলরা বোঝাল আমাদের। অতঃপর সত্যিই শিক্ষক বদলানোর আবেদনপত্র নিয়ে যাওয়া হলো এবং পরদিন থেকে তিনি আর ক্লাসে এলেন না, এলেন সুশান্ত স্যার। জানি না, এই আবেদনপত্র পেয়ে কতটা দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আমাদেরকে কোনোদিনই স্নেহবঞ্চিত করেননি ফাদার। কথা বলতে গেলে গভীর দরদ নিয়ে শুনতেন, বলতেন, তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকত স্মিত-মায়াময় হাসি।

দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ক্লাস শেষ হতো বিকেলের দিকে। আমরা যখন ক্লাস শেষ করে বেরোতাম, দেখতাম ফাদার কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছেন, তাঁর হাতভরতি চকলেট-বিস্কুট-কেক, নানা রঙের বল এবং বেলুন আর তাঁকে ঘিরে রয়েছে টোকাইরা। পথশিশুদের তিনিই ডেকে আনতেন - কেউ তাঁর কোমর ধরে ঝুলত, কেউ তাঁর হাত থেকে চকলেট/বল/বেলুন নেওয়ার জন্য লাফালাফি করত, কেউ সামনে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াত, তিনি হাসিমুখে সব সহ্য করে ওদেরকে মাঠের মাঝখানে নিয়ে যেতেন। সবাইকে এটা-ওটা উপহার দিয়ে খেলতে নামিয়ে দিতেন, নিজেও খেলতেন ওদের সঙ্গে। যেন এক বিরাট শিশু, খেলছেন আপনমনে।

আমার দু-বছরের কলেজজীবনে এ দৃশ্যটিই ছিল সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য। সন্ধ্যা পর্যন্ত পথশিশুদের সঙ্গে খেলতেন তিনি, আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখভরে-মনভরে সেই দৃশ্য দেখতাম। বুঝতেই পারতাম না, দেশের সবচেয়ে অভিজাত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েও তিনি এত সরল হয়ে যেতেন কীভাবে?

ফাদার পিশোতোকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। গভীর দরদভরা মন নিয়ে তিনি এ দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। একটা জীবন তিনি ভালোবেসেই কাটিয়ে দিলেন। কেবল নটর ডেম কলেজেই নয়, তিনি শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্কুলেও। সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষার আলো, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তাঁর ছাত্রদের জীবন। মমতা, দরদ, ভালোবাসা আর সেবা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। আপনার অনন্তজীবন মর্যাদাপূর্ণ হোক ফাদার। জীবনভর যতটা ভালোবেসেছেন তা কোটিগুণ বর্ধিত হয়ে ফিরে যাক আপনারই কাছে।