• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৭, ২০২১, ০৯:০০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৭, ২০২১, ১০:৫৩ এএম

এখনো বিশ্বাস হয় না সুবীর নন্দী নেই

এখনো বিশ্বাস হয় না সুবীর নন্দী নেই

এখনো বিশ্বাস হয় না সুবীর নন্দী নেই। অথচ দুবছর ধরে এটাই বাস্তব সত্য। যেদিন রাতে যখন খবরটা দেখলাম, আমার বিশ্বাস হয়নি। আর যাই হোক বাংলাদেশি মিডিয়াদের ওপর সব সময় বিশ্বাস রাখা চিন্তাশীল লোকদের কাজ নয়। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মানুষ সমানে তার গান শেয়ার দিচ্ছে, তকে নিয়ে কথা বলছে। সুতরাং মৃত্যুটাই সত্য। 

আমার অবশ্য ধারনা ছিল উনি ফিরে আসবেন। কারণ এরকম প্রাণ শক্তিতে প্রাচুর্যময় মানুষরা অনেক কিছুকেই পরাজিত করতে পারে। এইজন্য তাকে নিয়ে তেমন ভাবিনি, জানতাম ফিরে তো আসবেই। কিন্তু ফিরে আসলেন মৃত্যুর খবর নিয়ে। অবশ্য বিখ্যাত সত্য সাহা অনেক দিন আগেই উনাকে বলেছিলেন, ‘আজ যে তোমাকে মাইক্রোফোনের সামনে গাইতে ডাকছে, কাল নাও ডাকতে পারে, হতে পারে এটাই তোমার শেষ গান।’ এই কথাটাকে তিনি আত্মস্থ করে রেখেছিলেন। মিউজিক ডিরেক্টর মকসুদ জামিল মিন্টু বলেছিল সুন্দর কথা— প্রত্যেক সুরকার নিজস্ব একটা ভাবনা থাকে, সুবীর নন্দী সেই শিল্পী সুরকার যেমন আশা করে তেমনই গায়।

ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আর পড়েননি। নিয়েছিলেন ব্যাংকে চাকরি। ছোট ভাই বোনদের জন্য বোঝা হতে চান নাই। গান শিখেছেন ওনার পারিবারিক এক ওস্তাদ ছিল তাঁর কাছে। এখনো ওনার বাড়ির পাশে সেই স্কুলটা আছে। ভালো গাইতেন, কচিকাঁচার আসর থেকে শুরু করে ৬৯-এর উত্তাল সময়ে গান গেয়েছেন। বটগাছের নিচে স্কুল ছাত্রদের এনে গেয়েছেন সবাই মিলে—আমার সোনার বাংলা। মুক্তিযুদ্ধে পালিয়েছেন, আগরতলা এরপর আসাম। সেখানেও গান গেয়েছেন। অসমীয়া লোকজন বুঝতো না বাংলা, তাদের গানের মানে বুঝিয়ে দিতেন। সিলেটে ব্যাংকে চাকরি করার সময় ওনার ম্যানেজার বলেছিলেন, ‘আপনি এত ভালো গান করেন, ঢাকায় না গেলে তো আজীবন এই হবিগঞ্জ-সিলেট করেই কাটাতে হবে।’ সেই ম্যানেজার ভদ্রলোকই ওনাকে ঢাকায় ট্রান্সফার করে দেন।

রেডিওতেও তখন এক ভুত চেপেছিল, যারা নতুন শিল্পী তাদের প্রতিষ্ঠিত বাইরের সুরকার গীতিকার দিয়ে গান করাবে। সবার গানই প্রচার হবে, দেখা যাক কারটা ভালো হয়। সেই সুবীর নন্দীর অগ্রযাত্রা শুরু। রেডিওতে তার গান শুনে সঙ্গীত পরিচালক আলী হোসেন ভাবলেন, এই ছেলেকে দিয়ে ট্রাই করা যায়। উনি ভাবছিলেন গজল ধরনের একটা বাংলা গান সিনেমায় দেবেন। নার্ভাস ছিলেন প্রথমে শুনে, কিন্তু ঠিকই কাজটা সঠিকভাবে করেছেন। রেডিওতে, টিভিতে সবখানেই তিনি গেয়ে চলেছেন সমান তালে। গান তাকে বড়লোক বানায় নাই, কিন্তু গান গেয়ে গেয়ে তিনি পেয়েছেন এ দেশের মানুষের ভালোবাসা। জগন্নাথ হলের এক রুমে থাকতেন, সব টাকা বাড়িতেই দিতে হতো। ওনার পকেট ফাঁকা। ক্যান্টিন মালিক ওনাকে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার দিতেন আর বলতেন, ‘মিয়া খায়া লন, না খাইলে গলায় আওয়াজ পাইবেন কেমতে?’ এই যে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এইটা উনি আজীবন পেয়েছেন এবং লালন করেছেন। ছোট একটা ঘটনা বলেছিলেন এক অনুষ্ঠানে, উনি খুব পান খেতেন। তাতে জিহ্বা ভারি হয়ে যেত, গান গাইতে সমস্যা হতো। শুধু গানের জন্যই পান ছেড়ে দেন। ওস্তাদ আল্লাহরাখা খান, ওস্তাদ আকবর আলী খান, পণ্ডিত রবিশংকরের মতো লোকেরা ওনার গান শুনে তারিফ করেছেন। ভারতেও অনেক লোক ওনাকে চিনে, একটা সময় আসামে গিয়ে হোটেল না পেলে ওনার নাম বললে ব্যবস্থা হয়ে যেত।

কী গান তিনি গেয়েছেন, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘তুমি এমনি জাল পেতেছো সংসারে’, ‘আমার এ দুটি চোখ’। সংগীত তাকে সব দিয়েছে, মানুষের ভালোবাসা, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আর একুশে পদক। আর উনি আমাদের দিয়েছেন, শিল্পীর বিনয় আর নতুনদের শেখানোর চেষ্টা। অনেক টেলিভিশন রিয়েলিটি শোতে উনি কাজ করেছেন, গান তোলা শিখিয়েছেন প্রতিযোগীদের, মেন্টর ছিলেন। আমি বিরক্ত হতাম, ওনার মতো মানুষের এই সব কাজ না করলেই কি নয়। এখন বুঝি উনি কেন করতেন। একটা সুবীর নন্দী চলে গেলে আর কোনো দিন আরেকটা পাওয়া যাবে না। তাই নিজেকে সব সময় উজাড় করে দেওয়া। শুধু যদি তিনি সুরকার হতেন তাও তিনি অমর হয়ে যেতেন। শাকিলা জাফরের জন্য উনি কিছু সুর করেছেন কি দারুণ। ওনার সুর করা একটা অজনপ্রিয় গানের কথাই ধরি, ‘এ কোন ফাগুন হৃদয়ে আমার বিরহের আগুনে পোড়ে নিশিদিন’। আহ! কী বানী কী সুর। মান্না দে ইচ্ছে থাকা পরেও স্ত্রীর অনুরোধে গানটা গান নাই। সেই গানটা ছিল, ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে’। পরে কিশোর কুমার গেয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য এখন এটাই, আমাদের সামনে দিয়ে আমাদের প্রিয় সব মানুষেরা চলে যাচ্ছে। বাংলা গানের এমনিতেই দুঃসময়, সুবীর নন্দীর মতো মানুষদের না থাকা আমাদের আরও পিছিয়ে দেয়।