• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২০, ০৭:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৪, ২০২০, ০৭:০১ পিএম

শেকড়ের টানে বাঙালির পাশে-২

মহিলাদের প্যারামিলিটারি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন ড. ফুলরেণু

মহিলাদের প্যারামিলিটারি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন ড. ফুলরেণু
ড. ফুলরেণু গুহ

মু ক্তি যু দ্ধে র  সু হৃ দ

একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিন। গোটা ভারতের লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর‍া সোচ্চার আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ‘মানবিক বোধ’ এর টানে। আবার অনেকের হৃদয়ে এই বোধের সঙ্গে ছিল মাটি ও শেকড়ের টান। এবারের অগ্নিঝরা মার্চে তাদের নিয়েই দৈনিক জাগরণ এর বিশেষ আয়োজন। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কিস্তি। লিখেছেন জাকির হোসেন

.......

মুক্তিযুদ্ধ চলছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে অগনিত মানুষ জীবনের নিরাপত্তায় পাড়ি জমিয়েছে ভারতে। কংগ্রেস, সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, বাংলা কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে সোচ্চার কোলকাতার মানুষ। সবাই একাত্ম আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি। সবাই বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের পরম বন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তখন নিখিল ভারত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা ও অভাব অভিযোগ সমূহ খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী, প্রখ্যাত সমাজসেবী ও রাজনীতিক, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী ড. ফুলরেণু গুহকে। এই কমিটির সদস্য করা হয় বিভিন্ন রাজ্যের সাংসদ ও বিধায়কদের। ড. ফুলরেণু গুহ তখন বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশ দেখতে ছুটে যান ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও গারো পাহাড়ী অঞ্চলে। জীবনের ঝুকি নিয়ে তিনি ঘুরে দেখেন বিভিন্ন আশ্রয় শিবির। তারপর প্রতিবেদন পাঠান শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। শরণার্থীদের দেখতে ড. ফুলরেণু গুহ যখন বনগাঁ সীমান্তে যান, ওই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দূর থেকে তাদের ‘ফলো’ করেছিলে এবং গুলি চালিয়েছিলো। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ড. ফুলরেণু গুহ। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও বাংলাদেশের মুক্তিযু্দ্ধ এবং এসব ঘটনা তাঁর স্মৃতিতে জীবন্ত ছিল।

ড. ফুলরেণু গুহ শুধু শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিবেদন তৈরি করেই থেমে থাকেননি। তিনি  শরণার্থী মহিলাদের জন্য প্যারা মিলিটারি ট্রেনিং ক্যাম্পেরও ব্যবস্থা করেন। আর অসহায় মহিলাদের জন্য হাতের কাজ এবং সেলাই শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। আর এটা তিনি করেছিলেন আমাদের দুজন জাতীয় নেতার প্রস্তাবের ভিত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন ড. ফুলরেণু গুহ’র পূর্ণদাস রোডের ‍বাড়িতে যান বাংলাদেশের তৎকালীণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও বেগম সাজেদা চৌধুরী। তারা দুজন ফুলরেণু গুহকে তাঁর ‘কর্মকুঠি’তে বাংলাদেশের মহিলাদের জন্য একটি ক্যাম্প করার প্রস্তাব দেন এবং প্যারা মিলিটারি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও বেগম সাজেদা চৌধুরী’র এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ড. ফুলরেণু গুহ তাঁর কর্মকুঠীর মাধ্যমে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন ঢাকুরিয়া জঙ্গলের ভেতর একটি বাড়িতে। প্রথম ব্যাচে একশ’ জন, দ্বিতীয় ব্যাচে আরো একশ’ জনের ট্রেনিং সমাপ্ত হওয়ার দিনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

ড. ফুলরেণু গুহ’র আদিবাস বরিশালের বাটাজোর। দত্ত পরিবারের মেয়ে তিনি। জন্ম ১৯১১ সালের ১৩ আগস্ট। বিএ পাশ করেন বরিশাল বিএম কলেজ থেকে। রাজনীতির হাতেখড়িও বরিশালেই। এম এ করেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আর ডক্টরেট করেন ফ্রান্স থেকে। ফুলরেণু গুহ অধ্যাপনা করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত ১৯২৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে, যুগান্তর পার্টির একজন কর্মী হিসেবে। পরবর্তী তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন।  তিনি লোকসভা এবং রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  

বাংলাদেশের পরম বন্ধু ড. ফুলরেণু গুহ  ২০০৬ সালের ২৮ জুলাই বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৫ বছর। ড. গুহ  নিঃসন্তান ছিলেন। স্বামী ছিলেন ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. বিরেন্দ্র চন্দ্র গুহ। স্বামী মারা যান ১৯৬২ সালে। ড. ফুলরেণু গুহ তাঁর স্বামীর ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের সমুদয় সম্পত্তি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছেন।   

জেডএইচ/ এমইচবি/এসএমএম