বাঘের মাসি নামে সুপরিচিত প্রাণীটি যে বিড়াল তা বোধ করি নতুন করে জানানোর কিছু নেই। বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, যদি সহে কেহ জ্বালা তো সে মায়ের বোন (মাসি) খালা। অর্থাৎ মায়ের সমতুল্য ভালোবাসা যদি কেউ দিতে পারেন তিনি কেবল খালা বা মায়ের ভগিনী, মাসি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এবারের নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কপালে যা জুটলো হয়তো এরপর তাদের সামনে এই প্রবাদ প্রহসনের প্রলাপ মাত্র।
ক্রিকেট বিশ্বে 'কালো বিড়াল' বা 'ব্ল্যাক ক্যাট' হিসেবে খ্যাত নিউজিল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে সিরিজ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটদলের সদস্যরা এবার যে ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে তা রীতিমত বিস্ময়কর। সম্ভবত এর আগে কখনও কোনো দেশ সফরকালে এতটা বঞ্চিত ও লাঞ্চিত হয়নি টাইগাররা। শেষ অবদি যে পরিস্থিতি তাতে মাসিদের চরম অবজ্ঞা আর অবহেলায় জীবন বিপন্ন হয়ে পড়া বাঘেরা কোনো মতে প্রাণ নিয়ে এ যাত্রা দেশে ফিরে আসুক, কেবল এই প্রত্যাশা বুকে নিয়েই অপেক্ষায় আছে গোটা বাংলাদেশ। মাসিদের এই অনাদরের মূল কারণ জানা না থাকলেও এবারের প্রেক্ষাপটে একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোনো পিতা-মাতা নিজেই যদি সন্তানের অবহেলা করেন তবে তার অনাদরে মাসি পিসীর আর দায় কি?
...................................................................................................................................................
...................................................................................................................................................
সচরাচর একটি দেশের মাটিতে খেলতে যাওয়া অতিথি দলের আতিথ্যে সর্বোচ্চ আয়োজন করে স্বাগতিকরা। অতিথিদের সকল প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে নেয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গণের প্রচলিত এই রীতি বিশ্বমানবতার ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে সুপরিচিত এবং প্রশংসিত। একটি সদ্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশ এ যাবত এমন অনেক প্রতিযোগীতারই আয়োজক হয়েছে যার প্রতিটি ক্ষেত্রে অতিথিদের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আর এ কাজে বাংলাদেশের আয়োজন কতটা প্রশংসাযোগ্য তা সদ্য সমাপ্ত বিপিএল টুর্নামেন্টে খেলতে আসা বিদেশি তারকাদের জিজ্ঞেস করলেই হয়তো জানা যাবে। যাদের মধ্যে বহু কিউই তারকাও ছিলেন। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের এক একটি বহর যখন পথে নামতো তখন তার আগে পিছে যে নিরাপত্তার ঘের নজরে পড়েছে তা এদেশের বহু আমলা মন্ত্রীর ভাগ্যেই কদাচিৎ ছোটে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু সেই বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল এবার নিউজিল্যান্ড সফরের যে অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফেরার প্রতীক্ষায় আছে তা বোধ করি শুধুমাত্র একটি দলের নয় বরং গোটা জাতির জন্য, পুরো ক্রিকেট বিশ্বের জন্য লাঞ্চনার। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে এই লাঞ্চনা যথাযোগ্যদের আত্মসম্মানে লাগে কি না।
এবারের নিউজিল্যান্ড সফরকালে বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স বিশেষ সুবিধার ছিলো না। এর অন্যতম কারণ সদ্য সমাপ্ত বিপিএল টুর্নামেন্টের ডানপিটে চার-ছক্কার উন্মাদনার তাল ছেড়ে হঠাৎ সুবোধের মত টেস্টের ময়দানে নামা। সেই সাথে টানা ম্যাচের ঝক্কিতে টাইগার শিবিরে আছড়ে পড়া ইঞ্জুরির প্রলয় বাণ। সব মিলেয়ে একেবারে বিধ্বস্ত টাইগার শিবির। তবে অপ্রাপ্তির এই সফরে টাইগারদের বাজে পারফর্মেন্সের চেয়ে কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা দিলো স্বাগতিকদের অবজ্ঞা আর অবহেলায় ভরা দুটি ঘটনা। যার দ্বিতীয়টির জেরে আজ হয়তো পুরো বিশ্ব ক্রিকেটের প্রাঙ্গণ জুড়ে চলতো শোকের মাতম, হারিয়ে যেত বাংলাদেশের এক ঝাঁক বাঘা বীর। হয়তো আর কোনোদিন ব্যাটে-বলে মাঠ কাঁপাতো না ওরা ১১ জন।
হ্যামিল্টনে প্রথম টেস্ট শেষে দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে যখন ওয়েলিংটন যাওয়ার পালা ঠিক সেই সময় যা ঘটলো তা বাংলাদেশ দলের অধিকর্তারা কিভাবে হজম করেছেন তা রীতিমত আশ্চর্যের বিষয়! হ্যামিল্টন থেকে দীর্ঘ ২৪৩ মাইল দুরত্বের পথ পাড়ি দিয়ে দ্বিতীয় টেস্টের ভেন্যু ওয়েলিংটনে আসে দুই দল। তবে সেক্ষেত্রে স্বাগতিক কিউই দল বিমানের বিলাসী ভ্রমনের স্বাদ গ্রহণ করলেও ইঞ্জুরি জর্জরিত অতিথি বাংলাদেশ দলকে আসতে হয় বাসে চড়ে, দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি আর ধকল সয়ে! বিশ্ব্বের অন্য কোনও দেশ হলে স্বাগতিকদের পক্ষ থেকে এমন আচরণ প্রদর্শন সম্ভব হতো কি না বা সেটা করা হলে যে চরম জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হতো তা পেশাদার ক্রিকেট খেলুড়ে নিউজিল্যান্ড দল ও টিম মেনেজমেন্ট ভালই জানেন। সেক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হলো সে প্রশ্নের উত্তর জানা বোধ করি অত্যন্ত জরুরি।
একটা কথা তো পরিষ্কার যে একেবারে যাচ্ছে তাই পর্যায়ের কোনো দল নয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের মঞ্চসহ একাধিকবার কিউইদের হারের স্বাদ দিয়েছে তারা। সেই সাথে টাইগারদের বাংলাওয়াশে কালো বিড়ালের বিবর্ণ হবার অভিজ্ঞতাও আছে। তাহলে কেনো এমন বৈষম্যে মাঠের প্রতিপক্ষের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শনে পরোক্ষভাবে তাদের লাঞ্চিত করা।? নাকি স্বাগতিকরা নিশ্চিত ছিলো যে তেমন কিছু হলে বাংলাদেশ দলের টিম মেনেজমেন্ট কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না, জবাব্দিহিতারও দরকার পড়বে না।?
দ্বিতীয় যে ঘটনার শিকার হতে গিয়ে আজ নেহায়েত ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলো বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তার বীভৎসতা চিন্তা করতেই গা শিউড়ে উঠে। শুক্রবার (১৫ মার্চ) তৃতীয় টেস্টের প্রস্তুতি পর্বে নিউজিল্যান্ডের হেগেল স্টেডিয়ামে অনুশীলন সেরে দলের একাধিক তারকা খেলোয়াড়েরা জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য নিকটবর্তী ক্রাইস্টচার্চের মসজিদ আল-নূর প্রাঙ্গণে পৌছানো মাত্র অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার মুখোমুখি হন। মসজিদের বাইরে লুকিয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলা তাদের হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে জানান যে, মসজিদের ভেতরে এক নরপিশাচ ইবাদতরত মুসলমানদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। সাথে সাথে তামিম ইকবালসহ সেখানে উপস্থিত খেলোয়ড়দের কানে ভেসে আসে মূহুর্মূহু গুলির শব্দ, সেই সাথে 'আল্লাহু আকবার' বলে আর্তনাদ করতে থাকা গুলিবিদ্ধ মুসল্লিদের কন্ঠ। সাথে সাথে উন্মাদের মত দৌড়ে পালান তারা। কাঁপা কন্ঠে একে অন্যের সাথে ঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছিলেন না তামিম, মুশফিকরা। খেলোয়াড়দের ব্যাপারে তথ্য দিতে প্রকাশিত একটি ভিডিও ক্লিপে সেটা নজরে পরে। সেই সাথে চোখে পড়ে আরো একটি বিষয়, খেলোয়াড়দের সাথে সেই সময় একজন নিরাপত্তাকর্মীও উপস্থিত ছিলেন না! পরে জানা যায় তাদের নিরাপত্তার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাই নাকি ছিলো না।! স্বাগতিকদের এমন খেয়ালিপনার জেরে আজ কি হতে পারতো তা একবার ভাবতেও রক্ত হিম হয়ে আসে! সাধারণ প্রটোকল অনুসারে আমন্ত্রিত দলের নিরাপত্তার নূন্যতম ব্যবস্থার বিষয়টিও একেবারে আমলে নিলেন না তারা এ কেমন! আর এ কথাটা আমাদের অভিভাবকেরা এমন নির্বিকারভাবে বললেন যেন কিছুই হয়নি! উনাদের 'এমনটি আর হবে না' বলায় মনে হলো প্রাথমিকে পড়া কোনো শিশু বাড়ীর কাজ না করায় শিক্ষকের কাছে সৌজন্যতামূলক ভুল স্বীকার করছে! একটা শক্ত কথায় কিউইদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য নেই? এমন কিছুই কি বলার ছিলো না যাতে আমাদের ছেলেরা এটুক অন্তত বুঝে নিতে পারতো যে ওদের জন্য উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ!
কি আর হবে মরে গেলে? দু'দিনের শোক? নগদ টাকা শোকার্ত পরিবারের জন্য? এরপর অতীত ভুলে এগিয়ে যাওয়া? আগামীতে ঘটা করে মৃত্যুবার্ষিকী পালন? শেষ! শুধুই কি ক'টা টাকার জন্যে ওরা পরিবার পরিজন, আনন্দ আয়োজন ছেড়ে দেশের পতকা হাতে ছুটে যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে? শুধুই কি কটা টাকার জন্য ভাঙা হাত নিয়ে দুর্জয় বীরের মত এক হাতে ব্যাট ধরে প্রতিপক্ষের সামনে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তামিমরা? আঘাতে লুটিয়ে পড়া মুশফিকরা মাথা ঝাড়া দিয়ে ক্রিজে নামে? আহত হাতেও স্পিনের বিষবাণে প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করে সাকিবরা? বার বার ইঞ্জুরির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বল হাটে ছোটে মাশরাফি, রুবেলরা? মনে হয় না। ওরা জানে ওরা জিতলে হাসে বাংলাদেশ, প্রতিটি বিজয়ে শ্রেণীভেদ ভুলে আলিঙ্গন করে একে অপরকে উদযাপনে।
সেই একবার রেসকোর্সের মাঠে একটি ৭ই মার্চে আপামর বাঙালিকে এক পতাকার রঙে রাঙিয়ে ছিলেন সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর পেরেছে ওরা। ওরা মাঠে নামলেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল সব ভুলে লাল-সবুজের অভিন্ন রঙে রেঙে উঠে বাংলাদেশ, বীরের মত বুক চিতিয়ে ওরা লড়াই করে আর তাতে রোমাঞ্চিত বাঙালির শত কষ্টের মেঘ কাটে, বিজয়ের হাসিতে।
মাসিদের দেয়া অবহেলা ভুলে ঘরে ফিরে এসো সোনার ছেলেরা। হয়তো পুরো বিশ্বের জন্য তোমরা শুধুই একটা দল কিন্তু আমাদের জন্য তোমরাই একটা বিশ্ব। তোমাদের জন্য কোটি বাঙালির চোখে মুখে অশ্রুসিক্ত উৎকন্ঠা। আজকের রাতটা যেন বাঙালির জীবণে আরো একটি দীর্ঘ অভিশপ্ত রজনীর মত। তোমাদের শুভ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় আছে বাংলাদেশ।
লেখক: সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বার্তা ডেস্ক, দৈনিক জাগরন।