অজ্ঞান পার্টি ও জাল নোটের বিড়ম্বনা

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ২২, ২০১৯, ০২:৪৩ পিএম  অজ্ঞান পার্টি ও জাল নোটের বিড়ম্বনা

গত ১৮ মে  একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ যথাক্রমে ‘অভিনব কৌশলে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা’ এবং ‘ঈদ ঘিরে সক্রিয় জাল নোটের কারবারিরা’ এ সময়ের নাগরিক জীবনের হয়রানির বাস্তব দুটি চিত্র। এ ছাড়া আছে ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহের দুর্ভোগ। উপরন্তু অপেক্ষা করে আছে সড়ক-মহাসড়কের দুর্ঘটনাজনিত অপমৃত্যুর সংকট। আর রমজান মাসজুড়ে অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক খাদ্যে ভেজাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অযাচিত মূল্য আদায়ের যন্ত্রণা। সব মিলে সাধারণ মানুষের কষ্টে অর্জিত অর্থের অপচয়, অনটনের সংসারে অশান্তি আর পারিবারিক জীবনে মানসিক চাপের ভয়ংকর রূপ স্পষ্টতর হওয়ার দৃশ্য মামুলি রূপ ধারণ করে এ সময়।

দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের শত প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও রমজান মাসের বাস্তবতা হচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সীমাহীন দৌরাত্ম্য, বীভৎসভাবে সক্রিয় জাল নোট কারবারিরা। ঈদ-আনন্দ উদযাপনের জন্য এ পরিস্থিতি মানুষ মুখ বুজে সহ্য করলেও প্রত্যেকেই ভেতরে ভেতরে প্রবলভাবে আতঙ্কিত আর ক্রমাগত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ঈদের সময় মানসিক যাতনা ও আর্থিক ক্ষতি, এমনকি জীবননাশের আশঙ্কার চিত্র প্রকাশিত সংবাদেই রয়েছে। ১৭ মে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টির বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা শহরের নিউ মার্কেট, ফকিরাপুল, কুড়িল বিশ্বরোড বাসস্ট্যান্ড এলাকা, ওয়ারী থানাধীন জয়কালী মন্দির এলাকা, গুলিস্তান ও উত্তরা এলাকায় এদের উপদ্রব বেশি।

অন্যদিকে প্রতিবছরই ঈদের আগে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শুধু মে মাসেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট। এ ছাড়া ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরা পড়েছে চার হাজারের বেশি জাল নোট, যার মূল্যমান ৩৪ লাখ টাকার বেশি। সবচেয়ে বেশি জাল হচ্ছে এক হাজার টাকার নোট। টাকা জাল করার অপতৎপরতা প্রতিরোধে আসল ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসংবলিত ভিডিও চিত্র রমজান মাসজুড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ জনসমাগমস্থলে ও রাস্তার মোড়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে প্রচার করা জরুরি।

এ ছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে নোট গ্রহণ ও প্রদানকালে এবং এটিএমে টাকা ফিডিংয়ের আগে আবশ্যিকভাবে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন দ্বারা নোট পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও সক্রিয় থাকে জাল নোটের কারবারিরা। এ জন্য আইনের ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করতে হবে। অপরাধীরা ধরা পড়ার পর যেন শাস্তি নিশ্চিত হয়। বলা হচ্ছে, সাক্ষীর অভাবে জাল নোট মামলার ৬০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এটা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ জাল টাকা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। পৃথক একটি আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধসংক্রান্ত কমিটির সভায় ছয় সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়। এ উপকমিটি আইনের খসড়া প্রণয়ন ও চূড়ান্ত করে এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জানা যায়নি। আমরা মনে করি, দেশে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে নতুন আইনটি দ্রুত পাস হওয়া দরকার।

প্রতিবছরই ঈদকে কেন্দ্র করে হয়রানি, প্রতারণা আর চাঁদাবাজির উপদ্রব সব সীমা অতিক্রম করে। শত প্রচেষ্টার পরও যেমন সব রাস্তা এখনো ঠিক হয়নি, তেমনি ছিনতাই, রাহাজানি বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়েও নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হচ্ছে না জনগণের। উপরন্তু আছে অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতা। প্রতিবছর ঈদের আগে অনেক মানুষ এসব প্রতারকের কবলে পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা প্রস্তুতির মধ্যেও ভয়ংকর প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে মানুষের সর্বস্ব। সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টিসহ সব ধরনের প্রতারকরা ১২ মাসই সক্রিয় থাকে; তবে প্রতিবছর ঈদ মৌসুম ঘিরে তাদের দৌরাত্ম্য অনেক গুণ বেড়ে যায়। গত এক সপ্তাহে শুধু রাজধানীতেই অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। গত বছর ঈদ উপলক্ষে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ পরিষদ। ঈদের সময় যানবাহনে স্বাভাবিক ভাড়ার দু-তিন গুণ আদায় করা হয়।

ঘরমুখো মানুষকে জিম্মি করে যানবাহনের মালিকরা এভাবে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ির ছাদেও যাত্রী পরিবহন করা হয়। নৌপথেও ঈদ সামনে রেখে অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও বেশি ভাড়া আদায় করা তাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। সেসব দমন করতে প্রশাসন কতটুকু সক্ষম হবে সেটা দেখার বিষয়। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটতে কালোবাজারের শরণাপন্ন এখনো হতে হচ্ছে। যদিও এবার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেনার পদ্ধতি চালু হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় টিকিট কম হওয়ায় ভিড় ঠেলে টিকিট না পাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। আবার ট্রেনযাত্রায় একই টিকিট অনেককে বিক্রি করার প্রতারণা দেখা যায়। ফটোকপি করে একই টিকিট একজনের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে আবার আরেকজনকে মূলকপি বিক্রি করা হয়। ট্রেনে উঠে উভয়ে সিট দাবি করলে মূল কপিওয়ালা বসতে পারে, প্রতারণার শিকার যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ রেলস্টেশন ও লঞ্চ ঘাটে রয়েছে দুর্বৃত্তদের আনাগোনা। ছিনতাইকারী বেশে দুর্বৃত্তরা ট্রেনের মধ্যেই লুটে নেয় যাত্রীদের সর্বস্ব। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে যাত্রীদের খুন করে পথিমধ্যে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। লঞ্চ ঘাটে পৌঁছানোর আগেই ব্যাগ নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিনব ছিনতাইও রয়েছে।

ঈদ সামনে রেখে রমজান মাসজুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে এ দেশে। রাস্তাঘাট-দোকানপাটে মানুষের ভিড় অন্য যেকোনো উৎসবের চেয়ে বেশি হয়। এ জন্য জাল নোট ও অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে মানুষের হয়রানি ও দুর্ভোগ কমাতে প্রশাসনের তদারকি বাড়ানো উচিত। সরকারি নির্দেশাবলি বা আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া বাস, বিমান, লঞ্চ ও স্পিডবোটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ঈদে ঘরে ফেরা অনেক শ্রমজীবী মানুষ বাস কাউন্টার-রেলস্টেশন কোথাও টিকিট পায় না। দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে টিকিট সংগ্রহ করা গেলেও পথে পথে ভয়ংকর যানজটে ঈদ মাটি হওয়ার শঙ্কায় তটস্থ হয়ে ওঠে তারা।

সড়ক-মহাসড়কগুলো শুধু ঈদ নয়, সব সময়ের জন্য সংস্কার করে চলাচল উপযোগী রাখতে হবে। সড়কগুলোতে চলাচলরত আনফিট বা লক্কড়ঝক্কড় মার্কা যানবাহন অবশ্যই বাতিল করা দরকার। অধিকাংশ চালকেরই থাকে না বৈধ লাইসেন্স ও গাড়ির আসল কাগজপত্র। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে গাড়ির মালিক ও চালকরা যে অনিয়ম করে, তা নির্মূল করা জরুরি। সিসিটিভির মতো প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিধি বৃদ্ধি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী  বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো এবং তাৎক্ষণিক অপরাধীর বিচার করা গেলে মানুষের হয়রানি ও দুর্ভোগের অবসান ঘটবে।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়