শ্বেত জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় এসে গেছে

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ২৩, ২০১৯, ০১:৫৭ পিএম শ্বেত জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় এসে গেছে

সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের সংঘটিত রক্তাক্ত বর্বরতার শিকার অসহায় নিরপরাধ মানুষদের নিয়ে সংবাদপত্র মহলেই নয়, রাজনীতিসচেতন মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে—বেশ কিছু লেখালেখিতে তার প্রকাশ ঘটেছে। প্রশ্ন উঠেছে জাতীয়তাবাদ নিয়ে, বিশেষ করে শ্বেত জাতীয়তাবাদের অমানবিক ঘাতক ভূমিকা নিয়ে।

ঘটনা আকস্মিক হলেও এর ইতিহাস সময়ের অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আবেগ ও জাতিরাষ্ট্রের উত্থান যেমন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের পটভূমি তৈরি করে। প্রসঙ্গত মনে রাখার দরকার যে মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে অনিষ্টকর দুর্বৃত্তপনায় শ্বেতাঙ্গ-সন্ত্রাসের ইতিহাস দীর্ঘ। উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় বহিরাগত শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা স্থানীয় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যে শ্বেতাঙ্গ-সন্ত্রাস তৈরি করেছিল তাতে স্থানীয় জনস্রোত রক্তাক্ত হয়েছিল।

শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের সেই বসতভূমি জবরদখল রক্তাক্ত আধিপত্যের এক অবিশ্বাস্য রক্তাক্ত ইতিহাস বা স্থানীয় আদিবাসীদের ক্রমে গভীর অরণ্যে ঠেলে দিয়েছে—ঝরনার জলে বিষ মিশিয়ে তাদের হত্যা করতেও মার্কিন বর্বরতার বিবেকে বাধেনি। সমঝোতা ও বহুত্ববাদের হিসাব তাদের মাথায় ছিল না। তদুপরি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের ধরে এনে চরম নিষ্ঠুরতায় দাসপ্রথার প্রচলন মানবসভ্যতাবিরোধী এক কর্মকাণ্ড।

সূচনা শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদের। মূলত উত্তর আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায় এবং গণতন্ত্রের প্রচারক ইউরোপে। ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলোর শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরে ধামাচাপা ছিল অযৌক্তিক ও নির্মম জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠত্ববোধ। কয়েক শতকের ইতিহাস তার প্রমাণ ধরে রেখেছে।

আধুনিকতা, রেনেসাঁস ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রার কল্যাণে জাতীয়তাবাদী জাতিরাষ্ট্রের শক্তিমান বিস্তার ইউরো-আমেরিকায়। সেই সঙ্গে বর্ণবাদ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। কৃষ্ণাঙ্গ নিগৃহ, কৃষ্ণাঙ্গ পীড়ন, শোষণ—এমন বেহিসাবি হত্যার নায়ক হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত কে-কে-কে নামক কুখ্যাত সংগঠন। সেসব এক দীর্ঘ ইতিহাস—সভ্যতার অভিশাপ।

দুই.

আধুনিক বিশ শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যদিও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, ক্ষমতার লড়াই—তবু এর নেপথ্যে ছিল জাতীয়বাদী চেতনার শক্তিমত্তার প্রভাব। গোটা ইউরোপীয় ভূখণ্ড ভেঙেচুরে বিভাজিত। ইউরোপের এই শক্তিমত্তার অনুসরণে এশীয় দেশ জাপানও উগ্র জাতীয়তাবাদের পথ ধরেছিল দুর্বল চীনের ওপর আক্রমণ চালিয়ে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতেও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিরল প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল। আর বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে জাপান ও আমেরিকা সফর শেষে বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে মানব নিগ্রহের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে লেখেন তিনটি প্রবন্ধ। তিনটিই জাতীয়তাবাদী আদর্শের নেতিবাচক দিক নিয়ে।

তাঁর মতে, এই রাজনীতি মানবতাবিরোধী, বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতাবিরোধী। উদাহরণ হিসেবে তিনটি দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। উদ্দেশ্য যেহেতু আন্তর্জাতিক, তাই প্রবন্ধগুলো ইংরজি ভাষায় লেখা, যাতে লক্ষ্যভেদ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। এবং তা হয়েছিলও বটে। তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। ইউরোপীয় মনীষীদের কেউ কেউ যেমন রোঁমা রোঁলা এ বক্তব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

প্রবন্ধ তিনটির শিরোনাম—‘ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট’, ‘ন্যাশনালিজম ইন জাপান’ ও ‘ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া’। বাদ দেননি নিজের দেশটিকেও। জাতীয়তাবাদ যে শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য বিপজ্জনক হুমকি—এ মূল সত্যটি রবীন্দ্রনাথ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন তাঁর প্রবন্ধগুলোতে। সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ছিল রবীন্দ্রবিরোধী, এমনকি তাঁর প্রিয় জাপান থেকেও।

ইংল্যান্ডে ক্ষণিক বিরতি এবং আমেরিকায় দীর্ঘ সফরে রবীন্দ্রনাথ পদে পদে উপলব্ধি করেছেন এই রচনার প্রতিক্রিয়ায় তাঁর প্রতি ব্যবহারের তারতম্য। বিশেষ করে আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোতে। নিউ ইয়র্ক থেকে শিকাগো—কমবেশি সবখানেই। ব্যতিক্রম সামান্য—তা-ও ব্যক্তিচরিত্রের ভিন্নতায়। জাপানে বিরোধিতা ছিল মূলত শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে, আমন্ত্রক এলিট শ্রেণির পক্ষ থেকে নয়। তবে স্বদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল সর্বাধিক—যেমন তীব্রতায়, তেমনি রাজনৈতিক চরিত্র বিচারে। হঠাৎ করে অনেকের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ অপ্রিয় রবীন্দ্রনাথে পরিণত হলেন। এমনকি খোদ তাঁর নিজ হাতে গড়া শান্তিনিকেতন শিক্ষায়তনের বড়সড় একাংশে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হননি; ক্রুদ্ধ হননি, এঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেননি।

হয়তো দেশের পরাধীনতা ও শাসকচক্রের আপত্তিকর চরিত্রের কথা ভেবে। তা সত্ত্বেও মতাদর্শগত দিক থেকে শ্রদ্ধেয় গান্ধীর সঙ্গে লড়াইটা জারি রেখেছিলেন। এক যুগ আগে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ আবেগঋদ্ধ স্বদেশি গান রচনা করে দেশবাসীর চিত্ত জয় করেছিলেন। আবার স্বদেশি আন্দোলনের অবাঞ্ছিত যাত্রা দেখে সেখান থেকে সরেও এসেছিলেন। তাতে তখন সমালোচিত হয়েছিলেন, যেমন হয়েছিলেন পরবর্তীকালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকালে। কিন্তু অটল ছিলেন নিজ বিশ্বাসে ও যুক্তিতর্কে।

তিন.

রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবিষয়ক বিচার-ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন ভুল ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুগের আধিপত্যবাদী শাসন ও আগ্রাসী জবরদখল তার আশঙ্কা-ভয় বারবার প্রমাণ করেছে। জার্মান ও ইতালির বর্বর ফ্যাসিবাদী চরিত্রের জাতীয়তাবাদ বারবার বিশ্বমানবের রক্ত ঝরিয়েছে, মৃত্যু ঘটিয়েছে কয়েক কোটি মানুষের। তাই তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ নামীয় পুস্তিকাটি পাঠের প্রয়োজনীয়তা বারবার উপলব্ধি করেছেন সচেতন মানুষ। রবীন্দ্রযুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখা গেছে, ইউরোপের একাধিক দেশে জাতীয়তাবাদের মানববিরোধী ভূমিকা। জার্মানিতে ‘স্কিন হেড’ তরুণ গোষ্ঠীকে হিটলারের নামে জয়ধ্বনি দিতে শোনা গেছে, আক্রান্ত হয়েছেন শান্তিবাদী মানুষ। বিশেষ করে বহিরাগত বাদামি রঙের মানুষ, অন্যত্র কৃষ্ণাঙ্গরা তো বটেই।

দক্ষিণ আমেরিকার ভয়াবহ বর্ণবাদী সন্ত্রাস ইউরোপীয় সমাজেও কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে। ধনবাদী দেশের চাপে মাঝারি ও গরিব দেশের তারুণ্যে দৃশ্যমান অভিবাসন তথা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্বের পাপ নতুন করে দেখা দিতে শুরু করেছে, শান্ত নিউজিল্যান্ড অশান্ত হয়েছে। বাদ যায়নি অনুরূপ একাধিক দেশ।

জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিক রক্ষণশীল, ডানপন্থী প্রেসিডেন্টের মতোই বর্ণবাদকে উসকে দিয়েছেন। ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়ের পেছনে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের প্রচারণা। যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল দক্ষিণি অঙ্গরাজ্য বর্ণবাদী অপসংস্কৃতিতে জ্বালানি যোগ করেছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুই-ই হয়েছে।

কিন্তু জয় হয়েছে বর্ণবাদী সন্ত্রাসেরই। একই বাধার মধ্যমণি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নানাভাবে জাতীয়তাবাদী অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতিতে বাতাস দিয়েছেন, এখনো দিয়ে চলেছেন। ইউরোপ শুধু শ্বেত ইউরোপীয়দের জন্য—এমন স্লোগান এরই মধ্যে না উঠলেও খুব বেশি দেরি নেই। ক্রাইস্টচার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণি অঙ্গরাজ্যে তা উঠলে অবাক হব না। হব না জার্মানিসহ সেখানকার জাতিরাষ্ট্রে।

শ্বেতাঙ্গ ইউরোপ-আমেরিকা বিশ্ব শাসন করবে, এমন স্লোগান সরাসরি না উঠলেও বাস্তব কার্যক্রমে তেমনটিই প্রতিফলিত হচ্ছে।

এদের বৈধতা মানবতাবাদী বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ ও একাত্ম হতে হবে। এটা বাস্তবিকই একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি রক্ষার লড়াই। গণতন্ত্রী ও শান্তিবাদী প্রতিটি দেশকে এ লড়াইয়ে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, লড়াইটা সার্বক্ষণিক চালিয়ে যেতে হবে। শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী চেতনা যেমন বর্ণবাদী পাপ, তেমনি গণতন্ত্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী সংস্কৃতিরও প্রতিফলন। শান্তিবাদ ও বহুত্ববাদের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে বিশ্বমানবতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে। কারণ এরই মধ্যে মানববিরোধী অশুভ সংকেত দেখা দিতে শুরু করেছে।

সবশেষে একটি ভিন্ন কথা—জাতীয়তাবাদ চরিত্রগুণে দ্বিমাত্রিক এর নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিক নিয়ে। নেতির ভারটাই বেশি, যা এরই মধ্যে আলোচিত। তবু অনস্বীকার্য যে পরাধীনতার বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে জাতীয়তাবাদ এক গভীর প্রেরণা। কিন্তু সমস্যা হলো সংগ্রাম শেষে অর্জিত বিজয়ের পর গণতন্ত্রী আদর্শ রক্ষা প্রায়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। চরিত্র বদল ঘটে যায় জাতীয়তাবাদী শাসনব্যবস্থার—অদ্ভুত এক চক্র পরিবর্তন—যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তাতেই আত্মসমর্পণ—সে জন্যই আহ্বান ওঠে সমাজবদলের, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী