ঈদ কেন কোথাও এগিয়ে আসে কোথাও এক দিন পিছিয়ে যায়

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ৫, ২০১৯, ০১:২৯ পিএম ঈদ কেন কোথাও এগিয়ে আসে কোথাও এক দিন পিছিয়ে যায়

ইসলামী উৎসবের, বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের বৃহত্তর গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে তার উৎসবমুখরতায় অভিন্ন, অখণ্ড সমাজের অংশগ্রহণ। যেমন শহরে, তেমনি গ্রামেও। এবার ঈদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুসলিম কর্মচারীদের জন্য বোনাস ঘোষণা করেছে। করপোরেট সেক্টর ঈদের বাণিজ্যিক পরিসরকে সুনজরে দেখছে। বুঝতে পেরেছে, এ বাজার নিছক ফেলনা নয়। একে স্পর্শ করতে হবে। তবে বাণিজ্যের এই ঝোঁক সীমাবদ্ধ। হয়তো ভবিষ্যতে ঈদ ঘিরে বিকিকিনির বহর সামাজিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে প্রতিবেশী সমাজেরও উৎসব হয়ে উঠবে, আমাদের বহুত্ববাদী, মিশ্র সংস্কৃতির পথকে আরো প্রশস্ত করে তুলবে।

প্রাচীন আরবে ঈদ শুধু মুসলিমদের উৎসব ছিল না। রমজানের উপবাস ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও বিরাজ করত। ১০ মহররমের আশুরা দিবসে ইহুদিরা, একসময়ে পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টানরা, মুহাম্মদ (সা.)-এর সমকালে ‘হানিফ’রা আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস পালন করতেন। সামাজিক নৃতত্ত্বের (সোশ্যাল অ্যানথ্রোপোলজি) পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কালিক ও স্থানীয় প্রভাব ইসলামের কিছুসংখ্যক অনুষ্ঠানও পার্বণকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। রোজা কিংবা ঈদ নিঃসন্দেহে এর ব্যতিক্রম নয়।

বারবার প্রশ্ন ওঠে, নির্দিষ্ট দিন নির্ণয়ের পরেও ঈদ কেন কোথাও পিছিয়ে যায়? কেন শাস্ত্রবিদরা এ বিষয়ে একমত হতে পারেন না? সাধারণ মানুষের উৎসবময়তার সামনে এটি এক স্থায়ী সমস্যা। বিষয়টির নতৃাত্ত্বিক বৃত্তান্ত এখানে আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব এবং তার ভেতরে ও বাইরে পুরাকালের কৃষিজ আচার-অনুষ্ঠানের চিহ্ন কিভাবে ছড়িয়ে আছে তা ভেবে দেখব।

ইসলামের উৎসব অনেকটাই অনাড়ম্বর, সরল তার আচার-অনুষ্ঠান। সংখ্যায়ও অল্প। প্রধান পার্বণ বলতে দুটি ঈদ। দুই ঈদের সঙ্গে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক কারণে যুক্ত হয়ে আছে রমজান ও হজ। আর রমজানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপবাস আর শবেকদরের মহিমাময় রাত। এ ছাড়া হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম-মৃত্যুর দিনটি, মুহাম্মদ (সা.)-এর ( মেরাজের) নৈশভ্রমণের রাত এবং শাবান মাসের শবেবরাত সামাজিক পর্ব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দুই ঈদের যে মর্যাদা এবং শিয়া মতবাদে বিশ্বাসীদের কাছে মহররম যে গুরুত্ব পায়, তার তুল্য হতে পারে না অন্য কোনো পর্ব। এই তিন প্রধান পর্বের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে সাধারণের ভাবাবেগ ও বিশ্বাস। তিন পর্বের ভেতর-বাইরের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান যদি খতিয়ে দেখা হয়, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে—নৃতত্ত্বের আলোকে—তাহলে খানিকটা স্পষ্ট হবে যে ঈশ্বর ও ব্যক্তি কালে নিহিত সেমিটিক ও ইরানি লোকজ বিশ্বাস। বলা বাহুল্য, প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস খতিয়ে দেখাটাই আমাদের লক্ষ্য, কারো বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। প্রশ্নহীন আনুগত্য থেকে যেখানে যাত্রা শুরু করেন একজন বিশ্বাসী, সেখানে লোকজ বিশ্বাস ও ধর্মের আচার-আচরণের উৎস, বিবর্তন ও ক্রমপরিণতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে হয় ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব আর নৃবিজ্ঞানের ছাত্রকে। অতএব দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মবিশ্বাস এবং নৃতত্ত্বের ছাত্রের গন্তব্য ভিন্ন; কিন্তু যেকোনো বিষয়ে স্বাস্থ্যময় মতভেদে আপত্তি নেই। থাকার কথাও নয়। কেননা সবাই অশেষের খোঁজে ছুটছি। ছুটতে হচ্ছে রহস্যের প্রকৃত উন্মোচনে।

প্রতিটি ইসলামী পার্বণ চান্দ্রমাস ও চান্দ্রবর্ষের নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। চান্দ্রবর্ষ গণনার নিয়মানুসারে স্থির হয় পর্ব পালনের তারিখ ও মাস। এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন বছরে হেরফের ঘটে তিথি পালনের দিনটিতে। নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের মতভেদ ও পার্থক্য দেখা দেয়। চান্দ্রবর্ষ গণনার ভুলভ্রান্তির জন্যই এই বিভ্রাট ও বিভ্রম। প্রাচীন আরবরা চান্দ্র ও সৌরবর্ষের নিয়মানুসারে বছরের দিন গুনত। তাদের ঋতু নির্ধারণে প্রভাব ছিল চান্দ্রবর্ষের। প্রতি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে ১২ মাসের সঙ্গে যোগ করত আরেকটি মাস। জ্যোতির্বিদ্যার (ইলমুন নুজুম) সঙ্গে তাদের খুব একটা পরিচয় ছিল না। জ্যোতির্বিদ্যার প্রভাবে পর্ব-পার্বণের তারিখ স্থির হতো বলেও মনে হয় না। প্রতিটি পর্বের দিন-মাস স্মরণে রাখতেন গোত্র পিতারা।

এটা খুব একটা কষ্টকর ছিল না। কেননা স্থির ঋতুতে বছরের বিশেষ সময়ে পালিত হতো সামাজিক উৎসব ও ধর্মীয় পার্বণ। নবীর মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রত্যাদেশে বছর গণনার আরবপ্রথা নির্মূল করে দেওয়ার নির্দেশ এলো। চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী স্থির হলো ১২ মাসের বছর। এক বছরে মোট দিনের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৫৪। এ কারণে তাদের ৩৩ বর্ষের সমান হলো ৩২টি সৌরবর্ষ। নিয়মমাফিক বর্ষ গণনা শুরু হওয়ার পর থেকে চান্দ্রবর্ষের নিয়মানুসারে ইসলামী পর্ব-পার্বণ সময়ের স্থিরতা হারাল এবং পৌত্তলিকতাদুষ্ট আরবের পর্ব পালনের সঙ্গে ধর্মীয় উৎসব পালনের সময়ের যে নৈকট্য ছিল, তা দূর হয়ে গেল।

এই দূরত্বের জন্য আজ উৎসবে প্রাচীন আরব লোকবিশ্বাসের প্রভাব নির্ণয় করা খানিকটা কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রসংগত প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর আগে চান্দ্রবর্ষ গণনা চালু করার নির্দেশ এসেছিল? এর পেছনে কি কাজ করেছে কোনো যুক্তি? বছর গণনাকে নিয়মতান্ত্রিক করার জন্য কি কায়েম হলো চান্দ্রবর্ষ, না বর্ষকে তার পর্ব পালনের দিনক্ষণকে প্রাচীন আরবের লোকবিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য প্রত্যাদেশের মাধ্যমে স্থির হলো ৩৫৪ দিনের বছর? কারণ যা-ই হোক না কেন, চান্দ্রবর্ষ চালু হওয়ার ফলে নিয়মমাফিক বছর গণনা শুরু হলো। পর্ব পালনেও তার ঋতুনির্ভরতা হারাল। কৃষিনির্ভর উৎপাদনমুখী সমাজের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ইসলামী উৎসবের স্থায়ী দূরত্ব তৈরি হলো এবং একই নিয়মে ১২ মাসে বছর গণনা শুরু করল মুসলিমরা। এ জন্যই কোথাও উৎসবের দিন এগিয়ে আসে, কোথাও পিছিয়ে যায়।

 

লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক