নাগরিক স্মরণসভা

সাংবাদিকতা জগতে প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন গোলাম সারওয়ার

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০১৯, ০৯:৪৫ পিএম সাংবাদিকতা জগতে প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন গোলাম সারওয়ার
নাগরিক স্মরণসভা

পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসা ভরা হৃদয়ে কথামালায় স্মরণ করা হলো দৈনিক সমকাল এর প্রয়াত সম্পাদক ও বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারকে। 

শুক্রবার (৩০ আগস্ট) বিকালে রাজধানীর ৩৮৭, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় টাইমস মিডিয়া ভবনের প্রধান মিলনায়তনে নাগরিক স্মরণসভার আয়োজন করে ‘গোলাম সারওয়ার নাগরিক স্মরণ পরিষদ। 

একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ১৩ আগস্ট (মঙ্গলবার)। গত বছরের ওই দিনে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হন তিনি। গত ১৩ আগস্ট তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মরহুমের কবরে সমকাল পরিবারের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সে সময় ঈদুল আজহার ছুটি থাকায় স্মরণসভার আয়োজন করা হয় শুক্রবার।

জাতীয় অধ্যাপক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সাংবাদিকতার বাতিঘরখ্যাত বরেণ্য এই সাংবাদিকের স্মরণসভায় অংশ নেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী, জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ও সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা, চিকিৎসক নেতা, ব্যবসায়ীক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, কবি-সাহিত্যিকসহ সমাজের বিভিন্নস্তরের নেতৃবৃন্দ। 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বক্তারা বলেন, মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার গোলাম সারওয়ার এ দেশের সাংবাদিকতা জগতে প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে সাংবাদিকতা শুরু করার পর একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এ পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে এবং দেশের সংবাদপত্রকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পক্ষ অবলম্বনকারীদের মধ্যে একমাত্র শক্তিমান, সাহসী, নিরহঙ্কার, উচ্চ ধারণা পোষণকারী ও নীতিবানসহ বহু অসাধারণ গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। যা এ কালের সাংবাদিকতায় বেশ বিরল।

স্মৃতিচারণ করে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তেমনি শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার প্রচেষ্টায় তার এলাকায় স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার দেখানো পথ নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করবে। 

দৈনিক জাগরণ এর প্রকাশক-সম্পাদক এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান আবেদ খান বেশ আবেগঘন ভাষায় স্মৃতিচারণ করেন গোলাম সারওয়ারকে নিয়ে। তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ারকে জানা বড়ই প্রয়োজন। সত্যি বলতে কী, আমার চোখের সামনে গোলাম সারওয়ার তৈরি হয়েছেন। আমি বিভিন্ন দিকে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। কিন্তু গোলাম সারওয়ার একদিকে নিবদ্ধ ছিলেন, সেটা তার পেশাগত জীবন। এত অসাধারণ তার গদ্য, এত অসাধারণ কাব্যিক তার রচনা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল গোলাম সারওয়ারের। অনেক বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। তোয়াব খানের সঙ্গে কাজ করেছি, সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে কাজ করেছি, আরও অনেক বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু পরিপূর্ণ বার্তা সম্পাদক হয়ে পরিপূর্ণ সম্পাদকে পরিণত হওয়া এবং কেবল সম্পাদকে পরিণত হওয়া শুধু নয়, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মধ্যে নিবেদিত প্রাণ হওয়া একমাত্র গোলাম সারওয়ারের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে।

গোলাম সারওয়ারের মতো মানুষদের প্রয়াণ সাংবাদিকতার জগতে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে আবেদ খান বলেন, আমরা দিনের পর দিন ভালো মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলছি, শক্তিগুলোকে হারিয়ে ফেলছি। যিনি চলে যান তিনি সব নিয়ে চলে যান, যিনি চলে যান তিনি তার সব অঙ্গীকার নিয়ে চলে যান, রেখে যান শুধু কর্ম। আজ গোলাম সারওয়ার যে জিনিসটি রেখে গেছেন সেটি হচ্ছে কর্ম। যতদিন যুগান্তর থাকবে, সমকাল থাকবে, সাংবাদিকতা থাকবে, বার্তা সম্পাদকের প্রতিষ্ঠান থাকবে; সম্পাদকীয় কার্যক্রম থাকবে, তত দিন গোলাম সারওয়ারও থাকবেন।

তিনি আরও বলেন, এখন সাংবাদিকতা স্থবির হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। গোলাম সারওয়ারকে অনুসরণ করে তা যদি সার্বিকভাবে ক্যামেরা এবং ভাষায় প্রয়োগ করতে পারা যায় তাহলেই এই ক্ষয়রোধ সম্ভব। 

২০১৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান গোলাম সারওয়ার। তার মৃত্যুতে পদটি শূন্য হবার পর আবেদ খানকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। 

দি ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ গোলাম সারওয়ার। এই সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তার অবদান অনস্বীকার্য।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, চলে যাবেন বলেই হয়তো সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নিজের জন্মদিন উদযাপন করেছিলেন, সেখানে আমাদের সবাইকে, দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে ডেকে সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করেছিলেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, হজে যাবার সময় সারওয়ার ভাইয়ের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, বয়সের ভারে নুব্জ্য মানুষটি কত সাহস করে হজব্রত পালনের জন্য ছুটে এসেছেন। আমি প্রাণ ভরে দোয়া করেছিলাম, মানুষটি যেন সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারেন। আমি সৌভাগ্যবান, তার মতো খ্যাতিমান সাংবাদিককে সেদিন খুব কাছে একান্তে পেয়েছিলাম।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য গোলাম সারওয়ার অনেক কাজ করে গেছেন। তিনি অত্যন্ত উদার ও নরম মনের মানুষ ছিলেন। খুব কাছ থেকে তাকে জানি। বর্তমানে দেশের অবস্থা ভালো না। আমি আশা করি- ভবিষ্যতে এমন দিনে গোলাম সরওয়ারকে স্মরণ করব, যেদিন দেশে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতা থাকবে।

নাট্যজন মামুনুর রশিদ বলেন, গোলাম সারওয়ারদের শূন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, এমন মানুষের শূন্যতা আমরা অনুভব করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আক্তারুজ্জামান বলেন, কৌশল এমন একটি শিল্প, আপনি কাজ করবেন কিন্তু শত্রু তৈরি হবে না- এই আদর্শের সার্থক মানুষটি ছিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি কাজ করেছেন সারাজীবন, কিন্তু কারও বিরাগভাজন হননি। তিনি শুধু সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সংবাদ প্রকাশ, উপস্থাপন এবং সৃজনশীল শিরোনাম দেয়ার ক্ষেত্রে গোলাম সারওয়ার ছিলেন অনন্য।  

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তর এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনকে তৈরি করা মানুষ গোলাম সারওয়ার।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুল মালেক বলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পিআইবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন গোলাম সারওয়ার। সেই সুবাদে গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে সখ্য ছিল। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তার সুবিশাল ব্যক্তির স্নেহ ভালবাসা পেয়েছি। 

বিএনপির নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তিনি ছিলেন সাদা মনের মানুষ।

কবি কামাল চৌধুরী বলেন, তিনি দেশের সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বাঙালিয়ানার ধারক ছিলেন তিনি।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন বলেন, সারওয়ার ভাই আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, তা যথাযথভাবে পালনই হবে তার প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন।

দৈনিক সমকাল এর প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, আপাতমস্তক পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন গোলাম সারওয়ার। সবচেয়ে কঠিন পেশা সাংবাদিকতা করেছেন সাহসের সঙ্গে। কোনও সংবাদ কারও পক্ষে গেলে, তা তার প্রাপ্য মনে করে। কিন্তু বিপক্ষে গেলে যেভাবে পারে সংবাদপত্রের মালিককে দেখে নেয়। গোলাম সারওয়ার সংবাদে আপস করতেন না। গোলাম সারওয়ার যে আদর্শ রেখে গেছেন, তা বেঁচে থাকুক। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে এর অভাব রয়েছে। আপস আপস করতে গিয়ে সাংবাদিকতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, মানুষ আর পত্রিকা পড়তে চায় না।

অনুষ্ঠানে সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, গোলাম সারওয়ারের মতো একজন ছাত্র পেয়ে আমি শিক্ষক হিসেবে গর্বিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক ষাটের দশকের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৬৩ সালে বাংলা বিভাগ বাংলা ভাষা, সাহিত্যের হাজার বছরের উৎসব পালন করে। সে সময়ে যে ক’জন ছাত্র এতে অগ্রণী ভূমিকা  পালন করে, তাদের অন্যতম গোলাম সারওয়ার। সারওয়ার নেই তা মনে হয় না। সে ছিল, আছে, থাকবে। কারণ গোলাম সারওয়ার একজন মানুষ। 

এর আগে স্মরণসভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সমকাল এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পান পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক ও কবি মুস্তাফিজ শফি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ার পরিণত বয়সেই চলে গেছেন। কিন্তু তার চলে এ যাওয়া আরও পরে হলে তার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আলোকিত যাত্রাপথটি আরও দীর্ঘ হত। তিনি নেই, কিন্তু এখনও তার সহযাত্রী হয়ে, তার দেখানো পথেই চলছে সমকাল। সে পথেই চলবে। 

স্মৃতিচারণ করেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, তথ্য সচিব আবদুল মালেক, সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক এম ইকবাল আর্সলান, অভিনেতা আজিজুল হাকিম, এসিআই লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর, অর্থনীতিবিদ কাজী করিমুজ্জামানসহ আরও অনেকে।

আরএম/এসএমএম