৪২ হাজার টাকার ল্যাপটপ দেড় লাখ টাকা

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে লুটপাট

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০১৯, ১২:৪০ পিএম শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে লুটপাট
হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ

আলোচিত বালিশ ও পর্দা  কাণ্ডের পর এবার টেন্ডারবাজি হল হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে। কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে ১৫ কোটি টাকার টেন্ডারের অর্ধেকই লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর বছরেই এমন বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ হওয়ায় হোঁচট খেল কলেজটিকে ঘিরে হবিগঞ্জবাসীর স্বপ্ন যাত্রা।
 
অনুসন্ধানে জানা যায়, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ২০১৮ সালে আহ্বান করা হয় দরপত্র। এ লক্ষ্যে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত আদেশে ফিজিওলজি বিভাগের  প্রভাষক ডা. মো. শাহীন ভূঁইয়াকে সভাপতি করে গঠন করা হয় ৩ সদস্য বিশিষ্ট বাজার দর যাচাই-বাছাই কমিটি। দরপত্রে অংশ নেয় ৭টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মূল্যায়ন রিপোর্টে সদস্যদের স্বাক্ষর ছাড়াই ঢাকার শ্যামলী এলাকার বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের ‘নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ’ ও মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান কে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়।

সূত্র জানায়, বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ৯৭ হাজার ৭শ ৪৮ টাকা। মালামাল ক্রয় বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১শ ৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয়, এমনটাই বলছে দরপত্র প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। বাকি টাকার পুরোটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে।

সূত্র মতে, সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ, কিং জেনারেশন) মূল্য নেয়া হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ টাকা। অথচ ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। 

৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ)-এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জনপ্রতি চেয়ার-টেবিল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যয় পড়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের তার স্টিকার লাগানো নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু তাই নয়, খুব নিম্নমানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, ৫টি স্টিলের আলমিরা ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ লাখ ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র‌্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ও ৬ হাজার ৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬শ ৬৪ টাকা। এছাড়াও বিলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১শ ৪টি প্লাস্টিক মডেলের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩শ ৩ টাকা দেখানোসহ দেশের বাজারে ‘পেডিয়াটিক সার্জারি’ (২ ভলিয়মের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা হলেও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫শ ৫০ টাকা।

এদিকে, মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য দেয়া হয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩শ ২৫ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩শ টাকা। পুনম ইন্টারন্যাশনাল এসির দাম ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টির মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩শ ৯০ টাকা, একই কোম্পানি ও একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইং (ওজন মাপার যন্ত্র) মেশিনের দাম নেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাস্তবে যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা করে।

এছাড়া মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছবি সম্বলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১শ থেকে ৫শ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮শ টাকা দরে। এ রকম ৪৫০টি চার্ট ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। দেশে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায় ‘স্টারবোর্ড‘ নামে হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চির ইন্টারেক্টিভ বোর্ড। কিন্তু একই কোম্পানি ও মডেলের এই ইন্টারেক্টিভ বোর্ডটি কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। এ যেন এক তুঘোলকি কাণ্ড।

কলেজের দু’জন শিক্ষক নাম না প্রাশ করার শর্তে বলেন, যেসব বই কেনা হয়েছে এর কিছু বই এমবিবিএস ক্লাসের ছাত্রদের কোনো কাজে লাগবে না। কারণ এসব বই গবেষণার কাজে লাগে।

তারা বলেন, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখন ৩য় বর্ষে পদার্পণ করেছে। আগামী ২০২২ সালে তারা ৫ম বর্ষে পৌঁছাবে। কিন্তু ২০১৮ সালে ৫ম বর্ষে পড়ানোর জন্য বই কিনতে হবে এর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন সংস্করণের বই থেকে বঞ্চিত হবে।

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে বাজার দর যাচাই-বাছাই কমিটি সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে ঢাকার দুটি প্রতষ্ঠানকে টেন্ডার দিয়েছে। এখানে কোন প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি।

তিনি আরো বলেন, হবিগঞ্জবাসীর স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করাতে আমি ত্যাগ স্বীকার করেছি। হবিগঞ্জের সন্তান হিসেবে আমি চাই প্রতিষ্ঠানটি মাথা উচু করে দাঁড়াক।

একেএস

আরও সংবাদ