মানবেতর জীবনে শ্রমিক পরিবারগুলো

খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো চালুর অপেক্ষায় বছর পার

খুলনা প্রতিনিধি প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২১, ০৪:৫৮ পিএম খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো চালুর অপেক্ষায় বছর পার

খুলনা-যশোর অঞ্চলসহ দেশের ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের উৎপাদন গত বছরের ১ জুলাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাটকলগুলোর উৎপাদন বন্ধের পর লিজের মাধ্যমে আবারও চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি। কিন্তু এসব পাটকলের চাকা আর ঘোরেনি। কবে চালু হবে সেটিও অনিশ্চিত।

এদিকে, বন্ধের পর টানা এক বছর ধরে পাটকলগুলো চালুর অপেক্ষায় রয়েছেন শ্রমিকরা। এমনকি কাজ হারিয়ে শ্রমিক পরিবারগুলো মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এ অবস্থায় খুলনার খালিশপুর শিল্পাঞ্চল ছেড়ে অনেক পরিবার বিভিন্ন জেলায় গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।
অপরদিকে, দীর্ঘদিন ধরে মিলের যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর শ্রমিকদের বসবাসের মিল কলোনিগুলো এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ঘর-বাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাছগুলোতে ফল ধরে রয়েছে, তবে যারা গাছ লাগিয়েছিল খাবার জন্য আজ তারা সেখানে নেই।

পাটকল শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, মিল কলোনিতে ছোট থেকে বড় হয়েছি। আজ সেই কলোনির অবস্থা দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারি না। মিল চালু হবে সেই আশায় এখনো রয়েছি।

প্লাটিনাম জুট মিল কলোনি গেটের নিরাপত্তাকর্মী মোঃ রফিক মিয়া বলেন, কলোনিতে প্রতিদিনই দু-একজন খবর নিতে আসে। তাদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান দেখতে আসে। অনেকে এসে চোখের পানিও ফেলে।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক মাহফুজ হোসেন বলেন, মিলে এখন শুধুই হাহাকার। তবে আমরা কয়েকজন এখানে রয়েছি। কারণ মিল কর্তৃপক্ষ বলেছিল ঘর ছাড়লে টাকা নিতে পারবো। কিন্তু আমি এখনো পাওনা টাকা নেইনি। এখানে জন্ম, এখানেই শৈশব, কৈশোর কেটেছে। এখানেই বিয়ে করেছি। এখন ছেলেও ইন্টারে লেখাপড়া করছে। স্মৃতি বিজড়িত জায়গা ছেড়ে যেতে চাই না। সবাই গেলেও আমি যাবো না। এখানেই মরতে চাই।

শ্রমিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্লাটিনাম জুট মিলে অবসায়নের পর পাওনা ছিল ৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ টাকা নগদ পেয়েছেন, বাকি টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে পারছেন না। লকডাউনের কারণে গাড়ি বন্ধ। ছেলে ও জামাই গাড়িও চালাতে পারছে না। এক মেয়ে বদলি শ্রমিক ছিল। সেও টাকা পায়নি।

তিনি বলেন, বন্ধের পর সরকার বলেছিল ৬ মাসের মধ্যে মিল আবার পিপিপি’র মাধ্যমে চালাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত  কোনো খবর নেই। এখন আমরা কি করে খাব- এ প্রশ্ন করেন তিনি।

তার স্ত্রী রেখা বেগম বলেন, কখনো চিন্তাও করিনি কারও বাড়িতে কাজ করতে হবে। কিন্তু এখন পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। অনেক কষ্টে দিন কাটছে। মেয়ে জোসনা প্লাটিনাম জুট মিলের বদলি শ্রমিক ছিল। কিন্তু মিল বন্ধের এক বছর পার হলেও বদলি শ্রমিকদের ভাগ্যে একটি টাকাও জোটেনি।

শুধু জাহাঙ্গীর, জোসনা আর হাফিজুর নয়, তাদের মতো দুর্ভোগে রয়েছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের প্রায় ৪১ হাজার শ্রমিক পরিবার।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার আলীম, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন, প্লাটিনাম ও স্টার এবং যশোরের কার্পেটিং ও জেজেআই জুট মিলে স্থায়ী শ্রমিক ছিল ১৪ হাজার ৯৮৭ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪ জন তাদের পাওনা নগদ প্রায় ৪৩ কোটি টাকা এখনও পায়নি। এছাড়া ৯ হাজার ৪৮১ জন শ্রমিক তাদের পাওনা প্রায় ৪৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এখনও পায়নি। শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা নগদ এবং অর্ধেক টাকা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি। এছাড়া এ ৭টি পাটকলের ২১ হাজার ৩৫১ জন বদলি শ্রমিকের পাওনার পরিমাণ ১১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কিন্তু বদলি শ্রমিকদের কেউ এখনও কোনো টাকা পায়নি। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত খালিশপুর জুট মিলের ৪ হাজার ৪৭৪ জন ও দৌলতপুর জুট মিলের ৩৫০ জন শ্রমিক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন। মিল বন্ধ হওয়ার কারণে তারা কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না।

পাটকলের বদলি শ্রমিক নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, মিল বন্ধের পর ইজিবাইক চালানো শুরু করি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনে এখন ইজিবাইক চলাচলও বন্ধ। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে।

প্লাটিনাম জুট মিলের প্রকল্প প্রধান মোঃ মুরাদ হোসেন বলেন, মিলের স্থায়ী শ্রমিক ৩ হাজার ৯৮৩৬ জন। এর মধ্যে মামলা রয়েছে ৩৬ জনের। মামলার কারণে তাদের টাকা ঝুলে রয়েছে। অন্যদের টাকা প্রায় পরিশোধ। ৯৯ শতাংশ স্থায়ী শ্রমিকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। মিলে ৬ হাজার ২০০ বদলি শ্রমিক রয়েছে।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর রউফ বলেন, লিজের মাধ্যমে পাটকলগুলো আবার চালু করা হবে, তবে সে জন্য আরও সময় লাগবে।