পাপিয়ার বিলাসী জীবন, অপকর্মের সঙ্গী স্বামী সুমন

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২০, ১০:১৭ পিএম পাপিয়ার বিলাসী জীবন, অপকর্মের সঙ্গী স্বামী সুমন

শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ-  যুব মহিলা লীগের এই নেত্রীর ছবিতে এখন সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কোনো ছবিতে চুল উঁচু করে বেঁধে নরম সোফায় বেতের লাঠি হাতে বসে আছেন। আবার কোনো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।  রাজনীতির মাঠে তিনি সক্রিয়। দলীয় সব কর্মসূচিতে তাকে দেখা যেত।

অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত পাপিয়া ফাইভ স্টার হোটেল ওয়েস্টিনের বিলাসবহুল কক্ষ ‘প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট’ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালাতেন। যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটির টাকার উপরে। গত ১২ অক্টোবর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি- এই ৫৯ দিনে তিনি ৮১ লাখ ৪২ হাজার টাকা নগদ পরিশোধ করেছেন। ব্যবহার করতেন ৫টি গাড়ি। তার কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়া ও একটি ভিজেল কার আছে। 

র‌্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা, মাদক-অস্ত্র চোরাচালান, জমি দখল করিয়ে দেয়া, হোটেলে নারীদের দিয়ে যৌন বাণিজ্য থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আসত ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের এই নেত্রীর হাতে। 

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ভারত যাওয়া সময় বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন পাপিয়া, তার স্বামী নরসিংদীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং তাদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২)। সেসময় তাদের কাছ থেকে ৭টি পাসপোর্ট, ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট, ৩১০ ভারতীয় রুপি, ৪২০ শ্রীলঙ্কান রুপি ও ৭টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

জানা গেছে, সব পাঁচ তারকা হোটেলেই ছিল পাপিয়ার এসকর্ট ব্যবসা। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরাই এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে এসকর্ট সার্ভিস খুলে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। 

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাপিয়া শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে তাদেরকে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করতেন পাপিয়া। এরইমধ্যে পাপিয়ার কাছ থেকে গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তির অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করেছেন র‍্যাব কর্মকর্তারা। গোপন ক্যামেরায় মেয়েদের ছবি ধারণ করে তাদের নিয়মিতভাবে ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি। পাপিয়ার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়- পাপিয়া বসে আছেন বাইজিবাড়ির সর্দারনির মতো। তার হাতে মোটা একটি বেতের লাঠি। তার কব্জায় থাকা মেয়েরা কথা না শুনলে পেটাতেন।

র‌্যাব-১ এর উপঅধিনায়ক সাফাত জামিল ফাহিম জানান, ভারতে যাওয়ার সময়ও পাপিয়া ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেনসিয়াল  স্যুইটের বুকিং বাতিল করেননি। যার একটি কক্ষের প্রতি দিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকার বেশি। গত বছরের ১২ অক্টোবর তিনি প্রথম হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইটটি ভাড়া নেয়। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তার নামেই ছিল এই স্যুইট। তবে মাঝে বেশ কিছুদিন ছিলেন না।

সাফাত জামিল জানান, এই স্যুইটে মোট চারটি কক্ষ। তবে আরও দুটো কক্ষ ভাড়া নেয়া ছিল পাপিয়ার নামে।

পাপিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার বিবরণ অনুযায়ী মোট ৫১ দিন তিনি ওই কক্ষ ছিলেন। আর এ জন্য বিল মিটিয়েছেন ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭ টাকা। আর এই হোটেলে এই সময়ের জন্য অবস্থানকালে বারবার ব্যবহারের জন্য ব্যয় করেছেন ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিদিন হোটেল বেয়ারাদের টিপস দিতেন নগদ ৮-১০ হাজার টাকা।

র‍্যাব জানায়, পাপিয়া এবং তার স্বামীর মালিকানায় ইন্দিরা রোডে দুটি ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে দুটি ফ্ল্যাট ও ২ কোটি টাকা দামের দুটি প্লট, তেজগাঁওয়ে এফডিসি ফটকের কাছে ‘কার এক্সচেঞ্জ’ নামের গাড়ির শোরুমে ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও নরসিংদী জেলায় ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামের প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে। নরসিংদী শহরের ভাগদী এলাকায় পাপিয়াদের দোতলা বাড়ি। সুমনের বাড়ি পশ্চিম ব্রাহ্মন্দী এলাকায়।

স্থানীয়রা জানান, ২০০৬ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় পাপিয়ার সঙ্গে সুমনের সম্পর্ক হয়। ২০০৯ সালে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকেই তারা স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০১০ সালে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয় পাপিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাঁকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তার স্বামী সুমন চৌধুরী। সুমন বেশিরভাগ সময় থাইল্যান্ডে অবস্থান করলেও গত থার্টিফার্স্ট নাইটে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অবস্থান করেন। ওই রাতে তার কক্ষেও চার-পাঁচ জন সুন্দরী নারী ছিল বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। 

নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের দ্বারা রাজনীতিতে হাতেখড়ি। শৈশব থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুমন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই হত্যাকাণ্ডের এজাহারভুক্ত আসামি সুমন ওরফে মতি সুমন। হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে তার উত্থান।

বছর দশেক আগে প্রেমের সম্পর্কের পর পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করেন সুমন। লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। মেয়রের ক্যাডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বছর তিনেক পর পাপিয়া চৌধুরীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই সময় পাপিয়াকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এরপর তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এর পর থেকে পাপিয়া ও  সুমন রাজধানীর সাবেক এক সংরক্ষিত এমপির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই এমপির সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসা আছে বলে জানা গেছে।

নরসিংদীতে রয়েছে সুমন ও পাপিয়ার বিশাল কর্মীবাহিনী। নরসিংদী কলেজ শাখা ছাত্রলীগ ও জেলা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী যারা তার অনুসারী তারা ‘কিউ অ্যান্ড সি’ ট্যাটু ব্যবহার করেন। মাঝেমধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে। মাস্টারমাইন্ড সুমনের সন্ত্রাসের পাশাপাশি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পাপিয়াকে গ্রেফতারের পর সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা, অনৈতিক কাজ, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার অভিযোগে পাপিয়াসহ ৪ জনের প্রত্যেককে ৩ মামলায় ১৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। দলীয় পরিচয়ের কারণে তিনি ছাড় পাবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি এসেছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে।

এফসি