রপ্তানি আয় কমছেই

জাগরণ প্রতিবেদক প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২১, ১১:৪৩ পিএম রপ্তানি আয় কমছেই

রপ্তানি আয় কমছেই। গত তিন মাস ধরে টানা কমছে অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ৩১৯ কোটি ২১ লাখ ডলার আয় করেছে। এই অংক গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রায় ৫ শতাংশ।

২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আয় কমেছিল ৫ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে কম এসেছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আয় কমেছিল ৬ দশমিক ১১ শতাংশ; লক্ষ্যের চেয়ে কমেছিল প্রায় একই ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারীতে গত এপ্রিলে রপ্তানি আয় তলানিতে পৌঁছলেও এরপর ধীরে ধীরে বাড়ছিল, তবে ডিসেম্বরে এসে ধাক্কা খায়। সেই ধাক্কা অব্যাহত রয়েছে।

টানা তিন মাসের এই ধাক্কার কারণে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সার্বিক রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশের মতো।

ইউরোপ-আমেরিকায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের যে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, তার প্রভাবেই রপ্তানি আয় হোঁচট খেয়েছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির গবেষকরা। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ এর টিকা দেওয়া শুরু হওয়ায় সবার মধ্যে ভয় কেটে যাওয়ায় আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি আয় বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মঙ্গলবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ২ হাজার ৫৮৬ কোটি ২৩ লাখ (২৫.৮৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে।

এই আট মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ২ হাজার ৬৮৩ কোটি ১০ লাখ ডলার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয়  হয়েছিল ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলার।

এ হিসাবেই জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রপ্তানি আয় কমেছে ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।

ইপিবি’র তথ্যে বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে দুই হাজার ১০৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

এই আট মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ১৩৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে ওভেন পোশাক রপ্তানিতে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই  খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৬৯ কোটি ১২ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।

হিসাব করে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছিল; ওই মাসে সবমিলিয়ে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩৬ কোটি ডলার।

বিধি-নিষেধ শিথিলে কারখানা খোলার পর মে মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ে, জুনে তার চেয়ে অনেক বাড়ে।

এরপর চলতি ২০২০২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও (জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর) সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ওই তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় দেশে আসে।

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ৫৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

জুলাই মাসের ওই আয়ের মধ্য দিয়ে সাত মাস পর রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় মাস অগাস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ কমলেও নভেম্বরে দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছিল। তবে ডিসেম্বর মাসে আগের বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।

রপ্তানি আয়ের আট মাসের এই চিত্র বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জাগরণকে বলেন, “আমাদের রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউয়ে ফের ধাক্কা লেগেছে। ওই দেশের মানুষ এখন আর খুব প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য কিনছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।”

“তবে আমাদের কিন্তু একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতে হবে। আর সেটা হলো—গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ১৭ শতাংশ। তখন কিন্তু কোভিড-১৯ ছিল না। অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, রপ্তানি খাতে নেতিবাচক ধারা কিন্তু মহামারীর আগে থেকেই ছিল।”

“এই কঠিন সময়ে প্রবৃদ্ধি হওয়াটাকেই আমি অনেক বড় অর্জন বলে মনে করি। আট মাসে ১ শতাংশ রপ্তানি আয় কমা খুব বেশি বিচলিত হওয়ার মতো বিষয় নয়। অর্থবছর শেষে যদি সামান্য প্রবৃদ্ধিও থাকে, সেটাকেই আমি বড় অর্জন বলে মনে করবো।”

“টিকা দেওয়া শুরু হওয়ায় সবার মধ্যে এক ধরনের সাহস ফিরে আসছে। বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যাও কমে আসছে। আমার মনে হয় আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়াবে। সে অবস্থায় অর্থবছর শেষে সামান্য হলেও প্রবৃদ্ধি থাকবে।

আট মাসেই পাট থেকে আয় গত বছরের সমান

এই সঙ্কটের মধ্যেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৮৬ কোটি ২৭ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৩  শতাংশ।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছিল, যা ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

অন্যান্য পণ্য রপ্তানি

মহামারীকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ। হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।

তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে প্রায়  ১৩ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি কমেছে দশমিক ৪০ শতাংশ।

হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে চলতি অর্থবছরে ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০ কোটি) ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করে, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় কম ছিল ২৬ শতাংশ।