মহম্মদ মমিন : রিক্সার চাকায় বোনে কথাশিল্প

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ১১, ২০১৯, ০২:৪৩ পিএম মহম্মদ মমিন : রিক্সার চাকায় বোনে কথাশিল্প

বিশাল এ নগরীতে চলতে গেলে কত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তার ঠিক নেই। চারদিকে কত অভিজ্ঞতার মানুষ ছড়িয়ে আছে ক্লান্ত এ শহর তার খবর রাখে না।পথ চলতে চলতে কত শত চরিত্রের সাথে দেখা হয়। যারা সবাই মেহতী মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ- জীবনের প্যাঁচে পড়ে আর চলতে পারেনি। মেধার বিকাশ ঘটেনি অন্যান্যদের মতো। কাজের মধ্য দিয়ে  কখনো হয়তো পরিচিতির প্রকাশ হয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপ্রকাশিতই থেকে যায়।  সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে  বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসায় ফেরার সময় একজন রিক্সাওয়ালার কথায়, ভাষা ব্যবহারে বুঝতে পারি সে আর দশজন রিক্সাওয়ালার মতো নয়।

কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি তিনি মূলত একজন লেখক। একজন কথাশিল্পী। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে বাসায় গিয়ে লিখতে বসেন। কাজ শেষে যতদূর পারেন উপন্যাস লেখেন। ইতিমধ্যে  প্রকাশিত হয়েছে তার তিনখানা উপন্যাস । রাত ১০ টা গড়িয়ে গেছে ,বৃষ্টি পড়ছে , মনে হয় আকাশটা ছিড়ে গেছে। তারপরও ঝরছে বৃষ্টি। তবুও এক ভবনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্বল্প আলোয় তার  কথা শুনতে থাকি। বেটে-খাটো লোক। পেটানো শরীর। গেঞ্জি পরা,ঘাড়ে গামছা। নাম মহম্মদ মমিন (৫০)। বাড়ি উত্তর জনপদের দিনাজপুর জেলার বিরামপুরে। এইচ.এসসি পাস করেছিলেন স্থানীয় কলেজ থেকে। বাবা কৃষক হারেছউদ্দিনের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় তিনি। শৈশব থেকে এলাকায় বাবার সাথে কৃষিকাজ করতেন। কাজের ফাঁকে পড়াশুনা করতেন। ছোট বেলা থেকেই ছিলো বই পড়ার ঝোঁক। তাই সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময় বই পড়তে যেতেন স্থানীয়  নুরুন্নবী লাইব্রেরিতে।

 সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,নজরুল ইসলাম ,শরৎচন্দ্র ,বঙ্কিমসহ বাংলা সাহিত্যের বড় বড় কবি-সাহিত্যিকদের বই পড়তে পড়তে একসময় নিজের লেখার শথ জাগে। শুরুতে স্থানীয় পত্রিকায় লিখতেন। এক সময় তাও বাদ দিতে হয় সংসারের কারনে। বিশেষত ১৯৯৪ সালে বিয়ে করার পর সংসারের খরচ-বেড়ে যায়। যে জমি , তা চাষ করে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে তার সংসারে আসে দুই মেয়ে। তখন তিনি বগুড়ায় এসে রিক্সা চালাতে থাকেন। এর মধ্যেও রাতে চলে লেখা।  ১৯৯৫ সালে বগুড়ার একটা প্রেসে টাকা দিয়ে প্রকাশ করেন তার প্রথম উপন্যাস  ‘শেষ দেখা’ তারপরে বের হয় ‘কাঁচের দেয়াল’ ।

এরপর আরো একটা বই বের হয়। তারপরে তিনি ২০১৬ সালে এক আত্মীয়ের পরামর্শে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে চাকরি নেন গার্মেন্টসে। তিনি বলেন, ‘ গার্মেন্টসে এস আমার চোখ খুলে যায়। মানুষ কত পাশবিক হতে পারে তা আমি গার্মেন্টসে এসে বুঝেছি। মানুষ ধনী হওয়ার জন্য কিভাবে  গরিব শ্রমিকদের ঠকায় তা আগে বুঝতাম না। এসব মানুষ জোকের চেয়েও খারাপ। জোক মানুষের রক্ত খেয়ে পেট ভরলে শরীর থেকে ঝরে পড়ে । আর মানুষ শরীরে রক্ত থাকা পর্যন্ত ছাড়ে না। গার্মেন্টসে যান বুঝবেন। পরে গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে রিক্সা চালাই কত ভালো আছি ।’ এসব নিয়েও তার একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। এখন লিখছেন ‘স্বপ্না তুমি কার?’। এ উপন্যাসের বক্তব্য সামাজিক অবক্ষয়ের  মানুষের বিকৃত রুচির যে  যে প্রকাশ ঘটছে সেসব নিয়ে।

সমাজে টাকাওয়ালা মানুষের সংখ্যা বাড়ার কারনে সমাজে অস্থিরতার বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন। সে বিষয়েই লিখছেন উপন্যাস।
 মহম্মদ মমিনের বড় মেয়ে দিনাজপুর মেডিক্যালে নার্সিং-এ পড়েন। ছোট মেয়ে এসএসসি পরিক্ষার্থী। রিক্সা চালিয়ে তাদের পড়ার খরচ চালান। সংসারের খরচ,নিজের খরচ। তারপরও ভালো আছেন। বিদায় নেয়ার আগে আমি আমার বাসার নিশানা দেখিয়ে বলি, এখানে এলে আমাকে পাবেন। তিনি আমার নম্বর নিয়ে বললেন,আমার একটা বিশাল শখ আছে,আপনি পূরন করতে পারবেন? তার বিনয়ের সাথে করা এ প্রশ্নটি আমি জানতে চাই। তিনি বললেন, ‘আগামী বই মেলায় আমার দুখানা বই কোন স্টলে রাখার ব্যবস্থা করতে পারবেন?’ আমি বলি তা পারা যাবে। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, ‘এটা আমার বহুদিনের শখ।’ আমি আশ্বস্ত করায় তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই আবার প্যাডেলে ধাক্কা দিতে দিতে বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।