তবুও রোজাদারদের ভাজাপোড়াই প্রিয়

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ১৫, ২০১৯, ০৩:৪৩ পিএম তবুও রোজাদারদের ভাজাপোড়াই প্রিয়

ইফতার মানেই তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়ার সমাহার। রমজান মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইফতার সামগ্রী বিক্রয় কেন্দ্র ও ইফতারের থালায় ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত হরেক রকম খাবারের রাজত্ব চলে। এসব যেন বাধ্যতামূলক, এসব ছাড়া যেন ইফতারের মেন্যু পূর্ণতা পায় না!

শেষরাত্র থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত টানা খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকার পর এসব ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তা দেশের রোজাদারদের অনেকেই জানেন। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছেন না তারা। এটাকে অনেকে সহজপ্রাপ্য, সহজে ভক্ষণযোগ্য আখ্যা দিচ্ছেন। কেউ ঐতিহ্য, পূর্বপুরুষের দোহাইও দিয়ে থাকেন। আবার কেউ অর্থসাশ্রয়ীও মনে করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার দৈনিক জাগরণকে বলেন, ইফতারে এই যে আমরা ভাজাপোড়া খাই, বেগুনি-পেঁয়াজু-আলুচপ, রান্না করা ছোলাবুটসহ বিভিন্ন আইটেম, এসব অতিরিক্ত তেলের আইটেম গ্রহণ বাদ দিতে হবে। সারাদিন রোজা থাকার পর এসব খাদ্যগ্রহণ পাকস্থলী স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেবার আশঙ্কা বাড়বে।

পুরান ঢাকা, নতুন ঢাকার যেসব স্থানে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করা হয়, সেসব স্থানে তেলবিহীন বা কম তেলের কোনো আইটেম নিখুঁতভাবে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। সবার কাছে ভাজাপোড়া খাবারের রাজকোষ। লোভনীয়ভাবে সাজিয়ে রাখা এসব খাদ্যের প্রতি খুব সহজে আকৃষ্ট হচ্ছেন রোজাদাররা। শুধুমাত্র পানীয় সামগ্রীগুলোই ভাজাপোড়ার বাইরে। 

চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতারি বাজার ভাজাপোড়ার রাজ্য। এখানে বিক্রি করা যেসব ইফাতারি সামগ্রীকে পুরান ঢাকার খানদান বলা হয়, তার সবই অতিরিক্ত তেলে স্নান করা ও ভাজা। বিক্রিও হচ্ছে ব্যাপক। এখানকার ইফতারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মুসাল্লম, বটিকাবাব, টিকাকাবাব, কোপ্তা, চিকেন কাঠি, শামিকাবাব, শিকের ভারী কাবাব, সুতিকাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, জিলাপি, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা, আলাউদ্দিনের হালুয়া, হালিম, দইবড়া, পুরি এবং ৩৬ উপকরণ মিলিয়ে তৈরি ‘বড়বাপের পোলায় খায়’সহ আরও কয়েক পদ। সৌদি পানীয় লাবাং, কাশ্মীরি সরবত, ইসবগুলের ভুসি, ফালুদা, দইয়ের মতন পানীয়জাত সামগ্রীও আছে।
 
নতুন ঢাকায়ও এসব আইটেমের অনেক কিছুই মিলছে, একটু ভিন্ন স্বাদে ও ভিন্ন পরিবেশে। বেইলি রোডের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট প্রায় ৫০ ধরণের ইফতার সামগ্রী তৈরি করে। শাহি টুকরা বক্স, বাসমতির জর্দা বক্স, চাটনি, দইবড়া, খাসির হালিম, মুরগির হালিম, গরুর চপ, খাসির চপ, খাসির কোর্মা, আস্ত মুরগি রোস্ট, খাসির পায়ের রোস্ট, শিক কাবাবসহ আরও বহু সামগ্রী।

বেইলি রোডের ক্যাপিটাল ইফতার বাজার, গুলশান এভিনিউর সেয়েস্তা রোজ রেস্টুরেন্ট, বনানীর স্টার কাবাব অ্যান্ড চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, মহাখালীর সিন্যামন রেস্টুরেন্টসহ নতুন ঢাকার বেশকিছু ইফতার সামগ্রী বিক্রির স্থানেও তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবারের সমাহার দেখা যায়।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা কাজী ইমদাদুল রসিকতা করে দৈনিক জাগরণকে বলেন, আসলে কম খাইয়া বাঙালির পেট ভরব না ভাইজান। ফলফাল যদি খাই তাইলে তো ডেলি একজনেরই ১ হাজার টেকার ফল লাগব। পোশাইব না। সব মাইনসের পক্ষে তো এই দাম দিয়া ফল খাইয়া পেট ভরা সম্ভব না। এইসব ভাজা পোড়াই বাঙালির ভরসা।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হেদায়েত হোসেন দৈনিক জাগরণকে বলেন, ইফতারে ভাজাপোড়া খাওয়াটা আসলে আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে। আমরা হয়ত মনে করি, ভাজাপোড়া না হলে ইফতারি-ই হয় না। আমিও একসময় ইফতারের মেনুতে প্রচুর ভাজাপোড়া রাখতাম। এখন বাদ দিয়েছি। কিন্তু পুরোপুরি বাদ দিতে পারিনি।

ভ্যানগাড়ি চালক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আমার এমনেই আছে। রোজার মাসে আরও বাড়ে। বুঝি ভাজাপোড়া খাইয়া এইটা বাড়ে। কিন্তু কী করুম, কয় টাকা কামাই যে ফল কিননা খামু? ভাজাপোড়া খাইয়া গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট খাইয়া ফালাই।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাফিউল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে বলেন, আসলে কথা একটাই। আমাদের অভ্যাস একবারে বেশি খেয়ে পেট টুইটুম্বুর করতে হবে। ফলফলাদি দিয়ে এই চাহিদা পূরণ করা দেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। এজন্য হয়ত ভাজাপোড়া খাবারই অগ্রাধিকার পায়।

তবে একবারে বেশি খাওয়া স্বাস্থ্য হানিকর বলে মনে করেন বিএসএমএমইউ’র পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার। তিনি বলেন, কোনোভাবেই একটানা বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করা করা উচিত নয়। এই নিয়ম রমজান মাসের জন্যও প্রযোজ্য, রমজান মাস ছাড়াও প্রযোজ্য। একটানা বেশি পরিমাণ খাদ্যগ্রহণের ফলে পাকস্থলির উপর চাপ পড়ে, হজমে ব্যাঘাত ঘটে।

তিনি বলেন, ইফতারে খাদ্যগ্রহণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ- যখন আমি রোজা ভাঙব। এসময় শরবত, খেজুর, মৌসুমি ফলমূল গ্রহণ করা যেতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, স্থুলকায়জনিত সমস্যা আছে, তারা এই শরবত গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। কেননা, শরবতে চিনি থাকে, যেটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। তারা ডাবের পানি, বিভিন্ন ফলের জুস গ্রহণ করতে পারেন। এরপর নামাজ আদায় শেষে ইফতারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করা যায়। এসময় দই-চিড়া, সবজি খিচুড়ি খাওয়া যায়, আলু চপ না রেখে ডিম চপ খাওয়া যায়। রান্না করা ছোলা যদি খেতেই হয়, সেটা খুব অল্প তেলে রান্না করে পেঁয়াজ-মরিচ-টমেটো কুচি দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। এটা অনেক সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। তরুণ-তরুণী ও শিশুরা ঘরে তৈরি মুখরোচক খাবার গ্রহণ করতে পারেন।

ইফতারির মেন্যুতে দই রাখার পরামর্শও দেন তিনি।

পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার বলেন, সারাদিন না খেয়ে থাকায় দেহে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়। একবারে বেশি খাদ্য গ্রহণ করলে গ্লুকোজের পরিমাণ খুব বেশি বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ইফতারের পর রাত ১০টার দিকে রুটি বা ভাত, সবজি, অল্প মাছ-মাংস, একগ্লাস দুধ গ্রহণ করা যায়। পারলে ডিম ভর্তাও রাখা যেতে পারে। এসময়ও এমন পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ উচিত নয়, যার কারণে পাকস্থলিতে বাড়তি চাপ পড়ে। তবে ডায়াবেটিস রোগীরা লাল আটার রুটি গ্রহণ করতে পারেন।


আরএম/টিএফ