ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন

রোহিঙ্গা নিধনের উদ্দেশ্যেই চলে যৌন নিপীড়ন

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০১৯, ০৫:০১ পিএম রোহিঙ্গা নিধনের উদ্দেশ্যেই চলে যৌন নিপীড়ন
বিচারের মুখোমুখি মিয়ানমার সেনাবাহিনী!


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছে। গণহত্যা ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বর্বর যৌন নিপীড়ন পরিচালনায় দেশটির সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষ দল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এসকল মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার দায়ে সেদেশের সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক বিচারের আওতায় আনার তৎপরতা শুরু করা হবে বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘের এই স্বাধীন অনুসন্ধানী দল। দ্য ব্যাঙ্কক পোস্ট

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণকে জাতিগত নিধনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে মিয়ানমার। এ ছাড়া এ অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা চালায়িছে সেদেশের সেনাবাহিনী যার সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া গেছে। এই বিশেষ প্রতিবেদনের অনুলিপি নিরাপত্তার স্বার্থে গোপনভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের প্রধান মিশেল ব্ল্যাচেটের কাছে জমা দেয়া হবে।

এর আগে ২০১৮ সালে এই অনুসন্ধানী দলটি সুনির্দিষ্ট পাঁচটি আলামত উপস্থাপন করে জানায়, রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে যৌন নিপীড়নকে ব্যবহার করেছে সেদেশের সেনাবাহিনী। সেসময়ই একে গণহত্যার আলামত আখ্যা দিয়েছিল তারা। আর এবারের অনুসন্ধানের সাম্প্রতিক তথ্যসমূহ আগের প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে যুক্ত করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন দাবি করেছে, গণহত্যার উদ্দেশ্যেই সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যৌন নিপীড়নকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এজন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বিচারের আওতায় নিতে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা।
 
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার প্রেক্ষিতে দেশটির রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সুপরিকল্পিত ও সুনির্ধারিত প্রক্রিয়ায় বর্বর সহিংসতা চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংস আচরণ ও নিপীড়ন করা হয় যা সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালার লঙ্ঘন। সেসময় দেশটির সামরিক জান্তা কর্তৃক পরিচালিত হত্যা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। 

সেবছর সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ঘটনা অনুসন্ধান করে জানায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নারীরা ধারাবাহিকভাবে সেদেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরবর্তীতে এ ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয় যেখানে এই ঘটনার বীভৎস সত্যতা বেরিয়ে আসে। নিজেদের সর্বশেষ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ষষ্ঠ আলামতটিও এবার প্রতিবেদনে যুক্ত করেছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।

মিশনের সর্বশেষ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ষষ্ঠ আলামত হিসেবে বলা হয়, ২০১৭ সালে পূর্বপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ সহিংসতার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যৌন নীপিড়ন চালানো হয়। নারী ও কিশোরীদের সংঘবদ্ধ হত্যা ও ধর্ষণ, গর্ভবতী নারীদের উপর পরিচালিত যৌন নিপীড়ন, শিশুদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো, যৌনাঙ্গ ও দেহের স্পর্শকাতর স্থানে বর্বরোচিত আঘাতের মাধ্যমে ক্ষত সৃষ্টি করার মতো বীভৎসতা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা যা সুনিশ্চিতভাবেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, অনুসন্ধনী দলটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত এই ষষ্ঠ আলামত থেকে স্পষ্ট হয় যে, গণহত্যা চালানোর উদ্দেশ্যেই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল সেদেশের সামরিক জান্তা।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় এসকল আলামত প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেই জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দলটিকে সেদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। পরে তারা বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এছাড়া ত্রাণ সংস্থা, গবেষণা সংস্থা, সরকারি সংগঠন ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলে অনুসন্ধানের কাজ পরিচালনা করে জাতিসংঘের এই মিশনের কর্মকর্তারা। তারা জানান, মিয়ানমার সরকার গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শত শত রোহিঙ্গা নারী (আনুমানিক ৮২ শতাংশ) ধর্ষণের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ৮০ শতাংশই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের নির্মম অভিজ্ঞতা নিয়েছে। এই ৮২ শতাংশ রোহিঙ্গা নারীর ধর্ষণের জন্য সেদেশের সেনাসদস্যরাই দায়ী।

এই বীভৎস নির্যাতন চালানোর পরও কেন সেদেশের সেনাবাহিনী ও সামরিক নেতারা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় সাজাপ্রাপ্ত হয়নি এবং সরকার কেন বারবার দোষীদের দায় অস্বীকার করে তাদের সমর্থন করেছে সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। মিশনটির কর্মকর্তারা আরও জানান, সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করার আবেদন করা হতে পারে। তদন্তকারী দলের এই বিশেষ প্রতিবেদনের অনুলিপি নিরাপত্তার স্বার্থে গোপনভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের প্রধান মিশেল ব্ল্যাচেটের কাছে জমা দেয়া হবে।

এসকে/ এফসি

আরও সংবাদ