ইন্ডিয়ান ইকোনমিক সামিটের সমাপনী

ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৈত্রী গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ৪ দফা প্রস্তাব

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০১৯, ০৮:০২ পিএম ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৈত্রী গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ৪ দফা প্রস্তাব
ইন্ডিয়া ইকোনমিক ফোরামের সমাপনী অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

স্বল্পমেয়াদি লাভের স্বার্থ ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বারোপের পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতা মোকাবেলায় আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মৈত্রী গঠনের আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

শুক্রবার (৪ অক্টোবর) ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়া ইকোনমিক ফোরামের সমাপনী অধিবেশনের কো-চেয়ার হিসেবে দেয়া বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়াকে অবশ্যই সংযুক্ত, বন্ধুসুলভ ও প্রতিযোগিতাসক্ষম অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠতে হবে, যা অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সেতুবন্ধনে সদা প্রস্তুত থাকবে।

এ প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন আমরা আমাদের জনগণের স্বার্থে আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারসাম্য আনি। স্বল্পমেয়াদি অর্জনের জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারি না।

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টিতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেয়া নানা গঠনমূলক নীতির কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

তিনি বলেন, তার সুদূরপ্রসারী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং অভিন্ন দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে অভিন্ন সমৃদ্ধিতে তার বিশ্বাসে পরিচালিত হয়ে বিমসটেক, সার্ক, বিবিআইএন, বিসিআইএমের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিচ্ছি।

পুরো অঞ্চলজুড়ে প্রতিটি মানুষের জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা ও একতা অর্জনে অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং ‘সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু’ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠার ওপর জোর দেন তিনি।

তিনি বলেন, বহুত্ববাদ শত শত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির উৎস। তাই ধর্ম, জাতি ও ভাষার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্যকে আমাদের উদযাপন করতে হবে। এটা মৌলিক।

দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনের সময়ে পুরো অঞ্চলের মধ্যে অসমতা যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’— বঙ্গবন্ধুর এ নীতি অনুসরণ করে আঞ্চলিক সম্পর্ক রক্ষার অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সব সম্প্রদায় ও দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাই প্রধান। আমাদের ভুল ধারণা ও ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তার বক্তব্য অনুসারে, অভিন্ন নদীর প্রবাহমানতা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ এখন কাজ করছে। আন্তঃদেশীয় গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে।

এ ধরনের সহযোগিতামূলক সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজজুড়ে অপরিহার্য। অন্যদিকে, আমাদের বেসরকারি খাতগুলো একে অপরের সঙ্গে স্বচ্ছ ও ন্যায্যভাবে প্রতিযোগিতা করবে।

ডব্লিউইএফ সভাপতি বোর্জে ব্রেন্ডের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্ট ছিলেন সিঙ্গাপুরের উপ-প্রধানমন্ত্রী হেং সোয়ি কিট, সেকুইয়া ক্যাপিটাল ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শৈলেন্দ্র সিং, অ্যাপোলো হসপিটাল এন্টারপ্রাইজের নির্বাহী সহ-সভাপতি শোবানা কারমিনেনি ও বুকিং ডট কম-এর চেয়ারওমেন জিলিয়ান টানস।

দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ ও সৌহার্দ্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ৪ দফা প্রস্তাব

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ৪ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া সংঘবদ্ধ, বন্ধত্বপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক অঞ্চল হিসেবে পারস্পরিক বৈশ্বিক কল্যাণে অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

গত কয়েক দশকে আমরা অনেক মহৎ আঞ্চলিক বিভিন্ন ধারণা ও উদ্যোগ দেখেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু সফল হলেও অন্যগুলো সফল হয় নি। আগামী কয়েক দশকের দিকে দৃষ্টি রাখলে আমি মনে করি এক্ষেত্রে আমাদের কিছু নীতিমালা মেনে চলা উচিত হবে।

প্রধানমন্ত্রী সামিটের সমাপনী অধিবেশনে প্রস্তাব (চিন্তা-ভাবনা) দিয়ে বলেন, বিগত দশকগুলোতে আমরা অনেক উচ্চাকাঙ্খী চিন্তা-ভাবনা ও উদ্যোগ দেখেছি। এর কিছু সফল হয়েছে, অন্যগুলো বাস্তবতায় আসে নি। আমার দৃষ্টিতে আগামী দশকগুলোর জন্য নিম্নোক্ত চিন্তা-ভাবনা অনুসরণ করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আমি বলতে চাই একটি সংযুক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়া অন্য অঞ্চলের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রথমত আমাদের সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সৌহার্দ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যুগ যুগ ধরে বহুত্ববাদ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি। এর মাধ্যমে আমরা ধর্ম, জাতি ও ভাষাগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্যের উদযাপন করতে পারে। এটি হচ্ছে মৌলিক বিষয়।

দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধির সময়ে সমাজে যেন বৈষম্য আরও বেড়ে না যায় তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সম্পদ হতে হবে অন্তর্ভুক্তমূলক এবং তা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে হবে।

তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত সম্প্রদায় বা দেশ পেছনে পড়ে থাকবে না। আমাদের যুবকদের আকাঙ্খা ও চাহিদা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অন্যদের হাত ধরতে হবে।

সম্প্রদায় ও দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা হচ্ছে চাবিকাঠি। আমাদের ভ্রান্ত ধারণা থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অব্যাহত অবদান রেখে চলছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে সহায়তা করছে।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি বন্টনের সমাধান করেছি। আমরা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এখন ভারতের সঙ্গে আন্তঃনদী নাব্যতা উন্নয়নে কাজ করছে। আমরা ভারত থেকে ইন্টার গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কিনছি।

আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের জন্য এ ধরনের সহযোগিতাপূর্ণ সংস্কৃতি প্রয়োজন। অপরদিকে আমাদের বেসরকারি খাত স্বচ্ছ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।

চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অবশ্যই বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করবো। আমাদের জনগণের স্বার্থে ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক বাস্তবতার আমরা প্রশংসা করবো। আমরা স্বল্প মেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থ বন্ধ করে দিতে পারি না।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমার বাবা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে তাদের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন এবং তাদেরক ভালবাসতেন। তিনি উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন বজায় রাখতে হলে তাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিরে এসে তিনি কলকাতায় ঘোষণা দেন, প্রতিবেশি দেশগুলোর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং আমাদের জনগণের স্বার্থে গঠনমূলক নীতিমালা প্রনয়নে আমরা সহযোগিতা করবো।

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীপূর্ণ চিন্তা-ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা বিমসটেক, সার্ক, বিবিআইএন ও বিসিআইএমের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।

সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে সংযোগ প্রতিষ্ঠার ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

তার সরকার ১৯৬৫ সালের পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া সংযোগগুলো পুনরায় চালু করার জন্য চেষ্টা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সবসময় এ নিয়ে চিন্তা করি। আমরা এ অঞ্চল এবং এর বাইরের অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধন প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়ে ও এশিয়ান রেলওয়ে প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করছে।

দারিদ্র্যকে এ অঞ্চলের অভিন্ন শত্রু অভিহিত করে তিনি বলেন, আমাদের এ অঞ্চলের সকল দেশের এই হুমকির বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করা উচিত। আমাদের এটি করার সামর্থ্য রয়েছে এবং আমরা নিশ্চই এটি করবো।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির জন্য সংযোগ বৃদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন।

রোহিঙ্গা ইস্যু প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে দেশ স্বাধীন করেছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরেন।

সিঙ্গাপুরের উপ-প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্য বিমোচন ও সহযোগিতা বিনিময়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য একযোগে কাজ করতে শেখ হাসিনার ধারণার প্রশংসা করেন।

এসকে/এসএমএম

আরও সংবাদ