প্রথম শুনানিতে গাম্বিয়া

হিটলারের মতো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ০৯:১৩ পিএম হিটলারের মতো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন
নেদারল্যান্ডসে হেগে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি - ছবি : আল জাজিরা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদিদের ওপর হিটলার যে ধরনের নির্যাতন করেছিল, মিয়ানমার নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর একই ধরনের গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে হেগে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে মামলার প্রথম শুনানিতে এ অভিযোগ করেছে গাম্বিয়ার আইনি দল। মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণসহ ভয়াবহ নিপীড়নের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১১ নভেম্বর মামলাটি দায়ের করে গাম্বিয়া।

আজ মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হওয়া এ মামলার শুনানি চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টায় বিচারের শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উপস্থাপনের পর গাম্বিয়ার আইনজীবীরা মিয়ানমারে এখনও থাকা ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি এদিন গাড়িবহরে করে হেগের পিস প্যালেসে যান। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি। আদালতে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত বর্ণনার সময় সু চিকে অনেকটাই ভাবলেশহীন দেখা গেছে।

আদালতের বাইরে এসময় ন্যায়বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করে রোহিঙ্গারা। শুনানি শেষ আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সু চি বিক্ষোভের মুখে পড়েন। গণহত্যার জন্য ‘শেইম অন ইউ সু চি’ স্লোগানে মুখরিত বিক্ষোভকারীদের সামনে দিয়ে তার গাড়ির বহর বেরিয়ে যায়। বিক্ষোভকারীদের অবশ্য পুলিশ আলাদা করে রাখে। মিয়ানমারের সমর্থনে তখন কোনো জমায়েত চোখে পড়েনি। অন্যদিকে, মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে সু চির সমর্থনে সমাবেশ করে হাজার হাজার মানুষ। ‘দেশের মর্যাদা রক্ষায় মাদার সু য়ের পাশে দাঁড়াও’ বলে স্লোগান দিয়েছে তারা।

আদালতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং স্টেট কাউন্সিলরের সমালোচনা করে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা জানান, এসব রোহিঙ্গাকে রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত যদি অন্তবর্তীকালীন আদেশ না দেয় তবে এটি প্রমাণিত হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেকোনো অপরাধকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে।

এ মামলায় অন্য যে বিষয়গুলোর জন্য গাম্বিয়া অন্তবর্তীকালীন আদেশ চেয়েছে সেগুলো হচ্ছে গণহত্যা বন্ধের জন্য মিয়ানমার অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবে; সামরিক, আধা সামরিক ও বেসামরিক অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা যেন কোনো ধরনের গণহত্যা সংঘটন না করে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; মিয়ানমার যেন সংঘটিত গণহত্যার কোনো প্রমাণ নষ্ট করতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও বেশি জটিল ও খারাপ হতে পারে এমন ধরনের কাজ থেকে মিয়ানমারের বিরত রাখা।

জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, রোহিঙ্গা শিশু ও নারীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল। এ কারণে দেশটির সেনাবাহিনীকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর সময় রোহিঙ্গা শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে এবং আছাড় মেরে হত্যা করেছে যা সুস্পষ্টভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাদের দ্বারা রোহিঙ্গা নারীরা নির্বিচারে ধর্ষণ ও গণধর্ষণেরও শিকার হয়েছে। পুরুষদের নানা ধরনের নিপীড়ন করে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধেও দেশটির সেনাবাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানান তারা।

এদিন শুনানির শুরুতে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবেদ্যু তার বক্তব্য বলেন, রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত শত শত গ্রামে গণহত্যা চালানো হয়েছে এবং তাদের রক্ষায় মানবজাতি ব্যর্থ হয়েছে। তবে এখনও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের হাত থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা সম্ভব।

তিনি বলেন, জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে দুই বছর ধরে তদন্ত করে এক হাজারের বেশি ক্ষতিগ্রস্তের সাক্ষাৎকার নিয়েছে এবং ফটো ও ভিডিও পর্যালোচনা করেছে।

মিয়ানমার ওই মিশনকে সহযোগিতা না করলেও তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করেছে ।

দলের অন্য একজন সদস্য এন্ড্র লয়েনস্টেইন বলেন, মিয়ানমার বর্ণবৈষম্যে বিশ্বাস করে এবং তাদের এ ধরনের কাজের হাজার হাজার প্রমাণ আছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৩৯২টি গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে।

একটি গ্রামের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মংডুর একটি গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা প্রতিটি মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছে, শুধুমাত্র ওই গ্রামেরই ৭৫০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অন্য আরেকটি গ্রামে ঢুকে ১০০ জনের মতো হত্যা করা হয়েছে এবং এরমধ্যে প্রায় ৩০ জন ছিল ১৮ বছরের নিচে।

তিনি বলেন, চক্ত নামের একটি গ্রামে ৩৫৮ জনকে হত্যা করা হয় এবং এর মধ্যে ১২৭ জন শিশু এবং মিয়ানমার সরকার এর কোনো কিছুই স্বীকার করে না এবং প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে প্রশংসা করে থাকে। 

দলের আরেক সদস্য আরসালান সুলেমান বলেন, গাম্বিয়া যে অভিযোগ করেছে সেটি পরিষ্কার এবং এ বিষয়ে আদেশ দেয়ার এখতিয়ার আছে আদালতের। তিনি বলেন, গাম্বিয়া ও মিয়ানমার উভয়ই জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এবং গণহত্যা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে এখন আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাদীপক্ষের আরেক সদস্য পায়াম আকাভান তার বক্তব্যে আদালতকে বলেন, রোহিঙ্গারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘৃণা বক্তব্য ছড়ানো হয়।

মিয়ানমারের যে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল সেই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তার রিপোর্টে বলেছে এর পেছনে সাতটি কারণ আছে। আদালতে সেসব কারণ তুলে ধরেন তিনি।

আদালতের কার্যক্রম আজকের মতো মুলতবি করা হয়েছে । কাল মিয়ানমার তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে।

এফসি

আরও সংবাদ