হাইপো থাইরয়েডিজম নিয়ন্ত্রনে খাদ্য ও পুষ্টির ভূমিকা

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০১৯, ০৭:৩৬ পিএম হাইপো থাইরয়েডিজম নিয়ন্ত্রনে খাদ্য ও পুষ্টির ভূমিকা

আমরা যখন সুস্থ থাকি তখন ইচ্ছা করলে যেকোন ধরণের খাবার খেতে পারি।কিন্তু আমরা যখন অসুস্থ থাকি তখন খাবার খেতে হয় বুঝে শুনে।অর্থাৎ,এক এক রোগের জন্য এক এক ধরণের খাবার উপযোগী।আর রোগ আক্রান্ত অবস্থায় আমরা যদি সঠিক খাবারটি না খেতে পারি তবে রোগ থেকে মুক্তি মেলা সহজ নয়। আজ এমন একটি রোগের কথা বলবো যেখানে সঠিক খাবার গ্রহণ করার উপর নির্ভর করে  রোগটি কত খানি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং চিকিৎসা কতটা ফলপ্রসূ হবে।

আর যে রোগটির কথা বলছি সেই রোগটির নাম হলহাইপো থাইরয়েডিজম।একটি কথা মনে রাখতে হবে যে,যেকোন ধরণের হরমোনাল ডিজিস অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভাল হয়না।তবে,নিয়মিত মেডিসিন গ্রহণ,নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন,সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে সুস্থ থাকা যায়।হাইপো থাইরয়েডিজমে খাবার বা পুষ্টির ভূমিকা আলোচনা করার পূর্বে সংক্ষেপে জানিয়ে দেব রোগের লক্ষণ এবং কারণ সমূহ সংক্ষেপে।


হাইপো থাইরয়েডিজমের কারণ

যদি সহজ করে বলি তবে হাইপো থাইরয়েডিজমের হল এমন একটি অবস্থা যখন আমাদের থাইরয়েডগ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন করতে পারেনা।থাইরয়েড হরমোনের প্রধান কাজ হল মেটাবলিজমে সাহায্য করা।সুতরাং,হাইপোথাইরয়েডিজমের আক্রান্ত হলে স্বাভাবিক ভাবেই মেটাবলিজম স্লো হয়ে যায়।ফলাফল,ওজন বৃদ্ধি পাওয়া বা সহজে ওজন না কমা।


এছাড়া,অন্যান্য যে কারণে হাইপো থাইরয়েডিজমের হতে পারে সেগুলো হল-

পুষ্টিকর খাবারের অভাবে বিশেষ করে খাদ্যে আয়োডিন এবং সেলেনিয়ামের অভাব
পিটুইটারি গ্লান্ডের সমস্যা হলে
বংশে বাবা বা মায়ের কারো থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে
গাট বা অন্ত্রের প্রদাহ
গর্ভাবস্থা-গর্ভকালীন সময়ে,কিছু কিছু গর্ভবতী মহিলাদের দেহে খুবই উচ্চ পরিমানে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় আবার খুব দ্রুত কমে ও যায়।

হাইপো থাইরয়েডিজমের লক্ষণ


 
যারা,হাইপোথাইরয়েডিজমের আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে নীচের লক্ষণ গুলো দেখা যায়:


• অতিরিক্ত ওজন- পরিমাণ মত খাওয়ার পরও কারণ ছাড়া ওজন বেঁড়ে যাওয়া বা অনেক চেষ্টার পর ওজন না কমা।
• অতিরিক্ত ক্লান্তি,ঘুম ঘুম ভাব,অলসতা,হতাশা
• ত্বক খস খসে হয়ে যাওয়া এবং চুল পড়া
• কোষ্ঠকাঠিন্য 
• মন মেজাজ সব সময় খিট খিটে থাকা
• স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া
• ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়া
• ক্ষুধা মন্দা হতে পারে
• পিরিয়ডে সমস্যা
• গর্ভধারণে সমস্যা এবং গর্ভপাত হতে পারে 
• পেশীতে প্রায় টান লাগা এবং ব্যথা হওয়া
• ঠাণ্ডাতে সমস্যা বা শীত শীত ভাব
• নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়
• উচ্চ কোলেস্টেরল 
কারো হাইপো থাইরয়েডিজম আছে কিনা,তা উপরের লক্ষণ গুলো বা ফিজিক্যাল এক্সাম থেকে অনেক খানি বোঝা যায়।তবে আরো নিশ্চিত হবার জন্য থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন বা টি এস এইচ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে,আপনি হাইপো থাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কিনা?যদি থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন বা টি এস এইচ উচ্চ মাত্রায় থাকে তবে বুঝতে হবে আপনি হাইপো থাইরয়েডিজমে আক্রান্ত। 
একটি বিষয় উল্লেখ্য যে,হরমোন ঘটিত যেকোন রোগে আক্রান্ত হলে তা আর ভাল হয় না।তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত মেডিসিন এবংসঠিক খাবার গ্রহণ করলে রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখা এবং সুস্থ থাকা উভয় সম্ভব।


হাইপো থাইরয়েডিজম এবং খাদ্য                                                                                                                                                                                        


একজন হাইপো থাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির খাদ্য তালিকা এমন হওয়া উচিত যেন তারোগটিকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করে।
পাশাপাশি,থাইরয়েড ফাংশনকে স্বাভাবিক রাখার জন্য জরুরী পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে পারে।এছাড়া,সুস্থ থাকতে কিছু খাবার আছে যেগুলো অবশ্যয় খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।এবার জানাবো বিস্তারিত। 
 

হাইপো থাইরয়েডিজম যে ধরণের খাবার গ্রহণ করতে হবে
গ্লুটেন ফ্রি খাবার

 


যেসব খাবারে গ্লুটেন রয়েছে সেসব খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।কেনোনা,গ্লুটেন ইমিউন সিস্টেমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।তাই,থাইরয়েড ফাংশনকে ঠিক রাখতে হলে গম এবং গমের তৈরি সব ধরণের খাবার যেমনঃরুটি,নুডুলস,পাস্তা,বিস্কিট,কেক খাওয়া বাদ দিতে হবে।পাশাপাশি, বাইরে থেকে খাবার কেনার সময় ফুড লেভেল পড়ে দেখুন যে খাবারে গ্লুটেন আছে কিনা।
এবার আসি,যারা ভাবনায় পড়েছেন অধিকাংশ কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবারে গ্লুটেন থাকে তাহলে কি খেয়ে বাঁচবো?তাদের কে বলছি সাদা এবং বাদামী চাল,এরারুট,কাসাভা,বাজরা,কাওনের চাল,ফ্লাক্স সীড,চিড়া,খই প্রভৃতি গ্লূটেন ফ্রি খাবার।
নুডুলস,পাস্তা বা বিস্কিট খেতে চাইলে গ্লূটেন ফ্রি।যা,মূলত চালের ময়দা থেকে তৈরি।
 

আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার

 


থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিন অপরিহার্য।যেহেতু,আয়োডিন দেহে তৈরি হয়না তাইখাদ্যের মাধ্যমে আয়োডিন গ্রহণ করতে হয়।এই আয়োডিন আমরা,সামুদ্রিক মাছ,আয়োডিন যুক্ত লবণ,কুসুম সহ ডিম বা সি-উইড প্রভৃতি থেকে পেতে পারি।


সেলেনিয়াম যুক্ত খাবার


থাইরয়েডের যেকোন রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমানে সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।সম্প্রতি,ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এন্ডোক্রাইনোলজিতে,প্রকাশিত এক আর্টিকেলে এই তথ্যটি প্রকাশ পায়।থাইরয়েড টিস্যুতে প্রাকৃতিক ভাবে সেলেনিয়াম থাকে।
সেলেনিয়ামের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উৎস হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান নাটস।প্রতিদিন মাত্র ২ টি নাটস খেলে পূরণ হবে দৈনিক সেলেনিয়ামের চাহিদা।এছাড়া,টুনা,টার্কি মুরগী,চিংড়ি,ডিম প্রভৃতিতে সেলেনিয়াম রয়েছে।


টাইরোসিন যুক্ত খাবার


টাইরোসিন নামক অ্যামাইনো এসিড,আয়োডিনের সাথে যৌথ ভাবে কাজ করে থাইরয়েড হরমোন প্রোডাকশনে কাজ করে।দেহে টাইরোসিনের পরিমান কমে যাওয়া মানে থাইরয়েড হরমোনের পরিমান কমে যাওয়া।এছাড়া,এই উপাদানটির অভাব হলে হতাশা এবং উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়।সুতরাং,হাইপো থাইরয়েডিজমে সুস্থ থাকতে খেতে হবে টাইরোসিন সমৃদ্ধ খাবার।সী উইড,স্প্রিলুনা,ডিমের সাদা অংশ,টার্কি মুরগীর বুকের মাংশ,কটেজ চিজ,মুরগীর মাংস,কলা,স্যালমন ফিস প্রভৃতি টাইরোসিন সমৃদ্ধ খাবার।


জিংক সমৃদ্ধ খাবার

জিংক এমন একটি খনিজ উপাদান যা থাইরয়েড হরমোন সংশ্লেষণের জন্য অপরিহার্য।সুতরাং,মাছ, মাংস,তরমুজের বীচি,রসূন,মাশরুম প্রভৃতি জিংক সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত গ্রহণ করুণ নিয়মিত।

ভিটামিন-এ,ডি,ই সমৃদ্ধ খাবার

 


 
ভিটামিন-এ,ডি,ই এবং কে-২ হল ফ্যাটসলিউবল বা চর্বীতে দ্রবনীয় ভিটামিন।আর এই প্রত্যেকটি ভিটামিন থাইরয়েড ফাংশনকে ঠিক রাখতে খুব কার্যকর।
ভিটামিন-এ থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন এবং নিঃসরনে সাহায্য করার পাশাপাশি টি-৩ কে টি-৪ এ রূপান্তরে সাহায্য করে।গাজর,মিষ্টি কুমড়া,পাকা পেঁপে প্রভৃতি ভিটামিন এ এর উৎস।
দেহে ভিটামিন-ডি এর অভাবে থাইরয়েডের রোগ হতে পারে বিশেষ করে হাইপার থাইরয়েডিজম এবং এর সাথে বর্ধিত হল ঝুঁকি হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া।সুতরাং,ঝুঁকি কমাতেস্যালমন,সার্ডিন, ডিমের কুসুম,ফার্মেন্টেড ডেইরী এবং মাশরুম প্রভৃতি ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খান।
বিভিন্ন গবেষণায়,দেখা গেছে যে ভিটামিন-ই,অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করার পাশাপাশি অটো ইমিউন রেস্পন্সকে হেলদি রাখতে সাহায্য করে।ফলে,হাইপো এবং হাইপার উভয় ধরণের রোগকে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।নারকেল তেল,অলিভ তেল,অ্যাভোকাডো প্রভৃতি ভিটামিন-ই এর উৎস।
তাই,থাইরয়েড ফাংশনকে কার্যকর রাখতে নিয়মিত ভিটামিন-এ,ডি,ই সমৃদ্ধ খাবার খান।


ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার


ওমেগা-৩ 
ফ্যাটি এসিড প্রদাহ এবং টিস্যু ড্যামেজ প্রতিহত করার জন্য কার্যকর উপাদান।সঠিক অনুপাতে যদি ওমেগা-৩ ফ্যাটি গ্রহণ করা না হয় তবে থাইরয়েড ফাংশন ব্যহত হয়।ফলাফল, বিভিন্ন ধরণের থাইরয়েডের রোগ।সুতরাং,থাইরয়েডের রোগ থেকে বাঁচতে হলে নিয়মিত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমনঃ ফ্যাটি ফিস টুনা,সার্ডিন,ম্যাকারেল,ডিম,ফ্লাক্স সীড,সিয়া সীড গ্রহণ করতে পারেন।
এই খাবার গুলো গ্রহণ করার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করা,মেডিসিন গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে করবেন বিশ্রাম নেবেন।নিজেকে চিন্তা মুক্ত রাখার চেষ্টা করুণ।
পরের পর্বে জানিয়ে থাকছে হাইপো থাইরেডিজমে যে খাবার গুলো পরিহার করবেন।সুতরাং,অপেক্ষায় থাকুন এবং ভাল থাকুন।


লেখক : পুষ্টিবিদ, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড