সুস্থ থাকুন আজীবন

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০১৮, ০৪:৫৩ পিএম সুস্থ থাকুন আজীবন

 

কর্মক্ষম জীবনই জীবন। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই সুপ্ত ইচ্ছা, দীর্ঘদিন নীরোগ, সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা। কিন্তু  বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোটি কোটি ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে শরীর নীরোগ রাখা সত্যিই কঠিন বিষয়। শরীর অসুস্থ থাকলে মন খারাপ থাকে, কাজে অনীহা তৈরি হয়, জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই জীবনকে সুন্দর ও সুখীময় করতে শরীর সুস্থ বা নীরোগ রাখা একান্ত আবশ্যক। যাপিত জীবনে কিছু অভ্যাস, কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে নিজেকে নীরোগ রাখা যায়; সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন লাভ করা যায়। নিয়মিত শরীরচর্চা এর মধ্যে অন্যতম। বুদ্ধিমানেরা বলে থাকেন, রোগের প্রতিকারের চেয়ে আগেভাগেই তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। আর যদি রোগ হয়েই যায়- সেই রোগের প্রকোপ কমানো, আর যতটা সম্ভব সেই অবস্থাতেও কর্মক্ষম থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। বৈজ্ঞানিকভাবে বহুল পরীক্ষিত, নিয়মিত শরীরচর্চাই কেবল রোগবালাই থেকে শরীরকে রক্ষা করতে পারে। শরীরের মেদ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে, বাড়তি মেদ থাকলে তা ঝরাতে সহায়তা করে। 

মোটরগাড়িতে যেমন পেট্রল পুড়ে শক্তি উৎপন্ন হয়, তেমনি আমাদের শরীরেও খাদ্য ‘পুড়ে’ শক্তি উৎপন্ন হয়। আমরা যে খাদ্যই খাই না কেন, শরীরের কোষগুলো মূলত তা গ্লুকোজ হিসেবেই পায়। সমস্ত খাদ্যকে তাই আমাদের যকৃৎ বা লিভার গ্লুকোজে পরিণত করে। আর রক্তের মাধ্যমে তা কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যায়াম করলে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিক থাকে বলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। 

রোগ প্রতিরোধে শরীরচর্চা 
শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। হৃদরোগের অন্যতম কারণ শরীরচর্চার অভাব। অথচ এ কাজটা আমরা সারা জীবনই অবহেলা করে থাকি। ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতার মতো শরীরচর্চার অভাব হৃদরোগ ডেকে আনে, কিন্তু শরীরচর্চার গুরুত্ব কেউই আমরা সেভাবে দেই না। অথচ নিয়মিত শরীরচর্চা যেমন হৃদরোগ আটকায়, তেমনি মেদ বা স্থূলতা কমিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

যারা নিয়ম করে ব্যায়াম করেন না, কিন্তু পরিশ্রমসাধ্য জীবনযাত্রা করেন- তাদের হৃদরোগ ও সেরিব্রাল স্ট্রোকে মৃত্যুর হার ৩০% কম। ২২টি উচ্চমানের সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হার্টঅ্যাটাকের পর নিয়ন্ত্রিত শরীরচর্চা করলে শতকরা ২২ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং ২৫ ভাগের হঠাৎ-মৃত্যু আটকানো যায়। শরীরচর্চার ফলে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের ক্রিয়ার উন্নতি হয়। ব্যায়ামের সময় হৃদযন্ত্র এক-একবার সংকোচন-প্রসারণ করে বেশি পরিমাণ অক্সিজেন পাঠাতে পারে। এতে পেশিতে রক্ত আহরণের ক্ষমতাও বাড়ে। ফলে রোগীর কর্মক্ষমতা বাড়ে।

ওষুধ হিসেবে ভাবলে ব্যায়ামের রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা বিস্ময়কর। নিয়মিত ব্যায়ামে সর্দি-কাশির মাত্রা কমে যায় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। নিয়মিত ব্যায়ামে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে ২৭ শতাংশ, ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমে ৫০ শতাংশ, উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি কমে প্রায় ৪০ শতাংশ, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ৫০ শতাংশ, কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ৬০ শতাংশেরও বেশি, আলঝেইমারস হওয়ার ঝুঁকি কমায় ৪০ শতাংশ। 

কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে শরীরচর্চা
আমাদের শরীর যেন একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। শরীরে যত ক্যালরি জমবে, দেহের ওজনও ততই বাড়বে। ক্যালরি বা শক্তি আসে খাদ্য থেকে। আর ক্যালরি খরচ হয় শারীরিক পরিশ্রমে। যত দিন যাচ্ছে একেবারে ছোটবেলা থেকেই উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি আমরা। অন্যদিকে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা কমানোর উপায় যেমন টাকা খরচ করে ফেলা, তেমনি মেদ ঝরানোর উপায় হলো ক্যালরি-খরচ, অর্থাৎ শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম। এর কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু লাভের মৌলিক অনুষঙ্গ হিসেবে এর কোনোই বিকল্প নেই। এমনকি বয়োবৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত ব্যায়াম জরুরি। মার্কিন গবেষকরা জানিয়েছেন, সপ্তাহে কমপক্ষে ৬ মাইল হাঁটলে বৃদ্ধ বয়সেও মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে। নিয়মিত ব্যায়াম অনুশীলনের ফলে শারীরিক সুস্থতা, মানসিক সচেতনতা, রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও আরও কত বিষয়ে যে উপকার লাভ করা যায়, তার ইয়ত্তা নেই। 

ইয়োগা বা যোগব্যায়াম
ইয়োগা বা যোগব্যায়ামও দেহকে নীরোগ, সুস্থ, সবল ও কর্মঠ রাখতে সাহায্য করে। মানুষ প্রশান্ত ও প্রাণবন্ত থাকলে, স্বাস্থ্যসম্মত-প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করলে নীরোগ ও দীর্ঘজীবনের অধিকারী হতে পারে। তখন দেহ-মন নিজেই ওষুধ সৃষ্টি করতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। ইউরোপ বা উন্নত বিশ্বের ডাক্তাররা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ এড়িয়ে চলেন। ব্যথা-জ্বর-ঠাণ্ডা প্রভৃতিতে তারা শুধু বিভিন্ন পথ্যের পরামর্শ দেন। সেখানকার সমাজ-সংস্কৃতিতে মনে করা হয় যে, ছোটবেলা থেকে মামুলি অসুখজনিত বিভিন্ন কষ্ট সহ্য করতে শিখলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, শরীর-মন শক্ত ও সুগঠিত হয়, সামান্যতে মুষড়ে পড়ে না। 

আমেরিকার বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হার্বাট বেনসন তার বিখ্যাত বেস্ট সেলার গ্রন্থ ‘রিলাক্সেশন রেসপন্সে’ বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ডাক্তারদের কাছে যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন, তাদের ৮০ শতাংশই টেনশন ও মানসিক চাপগ্রস্ত। ওষুধ বা অপারেশনে এসব রোগ সারে না; বরং মনোদৈহিক চিকিৎসা যেমন মেডিটেশন, সাইকো থেরাপি, ইয়োগা, রেইকি ইত্যাদিই হচ্ছে এসব উপশমের একমাত্র ওষুধ। মেডিটেশন বা ধ্যানে শ্বাসতন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দ ফেরে। ফলে কমে মানসিক চাপ, টেনশন, উৎকণ্ঠা, ভয়, রাগ, ক্ষোভ, রক্তচাপ। মনে জাগে একাগ্রতা, আনন্দ ও প্রশান্তি। দৈনিক ৩০ মিনিট মেডিটেশন আপনাকে দেবে সুস্থ জীবনে, শরীর-মনে প্রশান্তি আসবে। আপনি হয়ে প্রাণবন্ত এক নতুন মানুষ। 

ভেষজ বা হারবাল 
শরীরচর্চার পাশাপাশি প্রকৃতিতে রোগ প্রতিরোধে যেসব উপকরণ রয়েছে, তাও নিয়মিত গ্রহণ করা উচিত। প্রকৃতিতেই আছে রোগ নিরাময়ের নানা উপকরণ। প্রয়োজন শুধু প্রকৃতির সেসব নিয়ামকের সঙ্গে মানুষের যথাযথ ও নিবিড় সম্পৃক্ততা। অর্জুনের ছালে হৃদরোগ নিরাময় হয়; নিয়মিত করলা খেলে ডায়াবেটিস হয় না; এলাচে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়; ওলকচুতে এনিমিয়া সারে; গাজর রাতকানা থেকে রক্ষা করে; ঘৃতকুমারীর শরবত খেলে ক্যান্সার ও বাতব্যথা নিরাময় হয়; চীনাবাদাম খেলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে; ঝুমকো লতা খেলে ভালো ঘুম হয়; টমেটোতে আছে ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধী ওষুধ; কাঁঠাল খেলে শক্তি বাড়ে; ডুমুর হজমশক্তি বাড়ায়; ঢেঁড়স মূত্রজ্বালা দূর করে; তুলসী পাতায় কাশি নিরাময় হয়; থানকুনি পাতা ও বেলের শরবতে আমাশয় সারে; দারুচিনি গুঁড়াতে ত্বক উজ্জ্বল ও লাবণ্যময় হয়; পেঁপে পাকস্থলীর ক্ষমতা বাড়ায়; সজিনা ক্যান্সার ও আলসার প্রতিরোধী খাদ্য ও পথ্য ইত্যাদি। এসব অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপথ্যের মধ্যে রয়েছে মানবশরীরের মৌলিক প্রয়োজনীয় এবং রোগ প্রতিরোধী বিভিন্ন উপাদান।

গড়ে তুলুন পজিটিভ জীবনদর্শন
‘সরল চিন্তা’ জীবনযুদ্ধের জ্বালানিরূপে কাজ করে। এ ‘জ্বালানি’ সর্বদাই শক্তিতে পরিণত হয়ে লক্ষ্য অর্জনকে করে তোলে সহজ ও নিশ্চিত। ইতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সুস্থতা ও শতায়ু লাভের পথকে করে সহজ। সংশয় নয়, সন্দেহ নয়- আনন্দ করো, শুধুই আনন্দ। সর্বদাই ভালোকে হ্যাঁ এবং মন্দকে না বলে নিজের বিবেক-ভুবনে ও সর্বসত্তায় সত্যের দীপশিখা চিরন্তন ও নিশ্চিত করে ফেলো। এতেই সৃজনশীল ও মেধাবী হয়ে উঠবে। পজিটিভ দর্শনে জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে শুধু রোগবালাই-ই নয়, যে কোনো দুঃখ-শোকের পরিস্থিতিতেও আপনভূমে শক্তিমান বা বীর বলীয়ান থাকা যায়। কোনো কিছুতে কখনো টেনশন করবেন না। টেনশন করলেন তো অসুস্থ হয়ে গেলেন; আর ফুর্তি করলেন তো সুস্থ ও সুখী থাকলেন।

জিএম