জন্মতিথির প্রনাম

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে সমাজ ও শ্রেণী

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ৭, ২০১৯, ০৬:০৩ পিএম রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে সমাজ ও শ্রেণী

সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লিরিক্যাল কবি। খেয়া থেকে আরম্ভ করে গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি হয়ে বলাকা পর্যন্ত কবি আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেছেন।.....বলাকার পরে পলাতকায় দেখছি কবি ধুলামটির পৃথিবীতে ফিরে আসছেন, এই বাস্তব জগতের মানুষকে দেখছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। তবে কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ মানবচরিত্র ও সমাজ বিশ্লেষণ করেছেন। রক্তকরবীর মতো নাটকে সাংকেতিক ফর্মে হলেও তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধনলিপ্সা ও মানুষকে যন্ত্র বানানোর ব্যবস্থাকে কষাঘাত করেছেন (যদিও পুঁজিবাদ কথাটি উচ্চারিত হয়নি)। অচলায়তন, মুক্তধারা প্রভৃতি নাটকে নিছক সৌন্দর্যই নাই, আরো আছে সামাজিক উদ্দেশ্য।

রবীন্দ্রনাথকে তাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন অল্প কয়েকজন বিদগ্ধ লোকের সম্পদ মনে করা ভুল হবে। তার গল্পে বিশেষত আমরা শ্রেনীচরিত্রের বিষয়টি পরিস্কার করে দেখতে পাই। সে অতিথি গল্পের তারাপদ বা একরাত্রি গল্পের সুরবালা বা পোস্টমাস্টার গল্পের রতন কিংবা কাবুলিওয়ালা গল্পের রহমত সবই শ্রেনীর সূতোয় বাঁধা। এখানে বুর্জোয়া শব্দটি ব্যবহার হয়নি, শ্রেনী শোষন, শ্রেনী চরিত্র ব্যবহার হয়নি। কিন্তু গল্প পড়লে পাঠকের ভেতরে যে চেতনার জন্ম হয় সেটা শ্রেনী চরিত্র,বা শ্রেনী শোষণ সম্পৃক্ত।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

বাঙালির চিরায়ত ভক্তিরসে নিষিক্ত ছিলেন তিনি, ছিলেন মানবতাবাদী। তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দিয়ে তিনি মানুষের অন্তর্গত জগৎকে যেমন নাড়া দিয়েছেন, তেমনি তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের উঠোনে পা রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। ছোটগল্পকে গণমুখী ও গণমানুষের ভেতরে নেওয়ার একক কৃতিত্ব তাঁর। রবীন্দ্রনাথের আগে যে গদ্য লেখা হয়নি, তা নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত বাংলা গল্পের চৌহদ্দীর বিস্তৃত ছিল না। এককথায় বলা যায়, অল্পদস্তুর ক্ষমতা অর্জন করেছিল বাংলা গল্প।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা তিনজনই সংস্কৃতপ্রবণ বাংলা লিখতেন। বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা তো দুর্বোধ্য ছিল সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এসে বাংলা সাহিত্যের, তথা বাংলা গল্পের রুদ্ধ দুয়ার একেবারে খুলে দিলেন। রবীন্দ্র-বিরোধিতা থাকলেও এ কথা সত্য যে, সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে বিশ্বকবির লেখনীর পরশ লাগেনি।

আমরা তাঁর ছোটগল্পে যে বাস্তবতা দেখতে পাই, সেটা রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্যান্য ধারা থেকে আলাদা। বিশ্বসাহিত্যের যে কয়জন হাতেগোনা শ্রেষ্ঠ গল্পকার রয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে আসন পেয়েছেন। তাঁর লেখার প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে যে বাস্তবতা দেখা যায়, তাতে মানুষ মনুষ্যত্ব, প্রকৃতি পরিবেশ, প্রবাহিত জীবন থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষের কথা বারবার প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে শিল্প সুষমার সৃষ্টি রসের ধারায়। সাহিত্যের জগৎটাকে বিশ্বকবি অবারিত সৃষ্টিতে এমনভাবে প্রস্ফুটিত করে গেছেন, যাতে প্রত্যূষে রবির উদয় আর গোধুলির সব রং মিশে নতুন সৃষ্টির বিজয় কেতন উড়িয়েছে, যার সবটাই বিশ্বকবির হাতের ছোঁয়ার পরশে ধন্য।

‘রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসে ও ছোটগল্পে সমগ্র বঙ্গদেশকে যেন নগরবঙ্গে ও পল্লীবঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছেন। একথা আগেই বলিয়াছি। তাহার ছোটগল্পের ক্ষেত্র পল্লীবঙ্গকেও যেন আবার দুটি ভাগে ভাগ করা সম্ভব। পল্লীবঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে আছে মানুষ ও প্রকৃতি, জনপদ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য; একদিকে গ্রাম ও ছোটখাট শহর আর একদিকে নদ-নদী, বিল-খাল,শস্যহীন ও শস্যময় প্রান্তর, আর সবচে বেশি করিয়া আছে রহস্যময়ী পদ্মা। মোটের উপর বলিলে অন্যায় হইবে না যে এই পর্বে লিখিত কাব্য-কবিতার রসের উৎস এই প্রকৃতি। আর ছোটগল্পগুলির রসের উৎস এইসব জনসপদ। কবিতায় প্রতিধ্বণি নদ-নদীর, ছোটগল্পে প্রতিচ্ছবি জনপদগুলির। এই স্থল ভাগ সত্য হইলেও একেবারে ওয়াটার-টাইট বা জল-অচল ভাগ নয়। এক ভাগের রেশ অপরভাগে আসিয়া পড়িয়াছে। তাই ছোটগল্পে পাইব প্রাকৃতিক স্পর্শ আর কবিতায় পাইব মানবিক স্পর্শ।রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন যে, তাহার সাহিত্যে যেন দুটি আকাঙ্ক্ষা আছে- সুখদুঃখ বিরহমিলন পূর্ণ মানব সমাজে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা, আবার নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যলোক উধাও হইয়া পড়িবার আকাঙ্ক্ষা। পূর্বোক্ত ভাগ যেন দুটি আকাঙ্ক্ষার আশ্রয়। ছোটগল্পগুলির মধ্যে পাই সুখদুঃখ বিরহমিলন পূর্ণ মানব সমাজে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা’ (রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প/প্রমথনাথ বিশী, পৃষ্ঠা ৯-১০)।

অন্যদিকে মার্কসীয় শ্রেণি চরিত্রের বিচারে যদি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে দেখি, তাহলে স্পষ্ট হয় যে, ‘প্রথম দিক, মধ্য দিক বা শেষ দিকের রচনা যাই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে ভাববাদ বা আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নাই। আছে মানুষ, সামাজিক মানুষ, সাধারণ গরীব মধ্যবিত্ত নরনারী। একেবারে দরিদ্র্য ও সাধারণ মানুষ