স্মরণ

ইতিহাসের অন্যতম চরিত্র জহির রায়হান: অনল রায়হান

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩১, ২০২১, ০৬:২৯ পিএম ইতিহাসের অন্যতম চরিত্র জহির রায়হান: অনল রায়হান

বাংলাদেশের গেরিলা নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের প্রয়ান দিবস ছিল গতকাল ৩০ জানুয়ারি। দিনটি উপলক্ষে জাগরণ অনলাইন স্টুডিওতে ‘প্রাসঙ্গিক’ অনুষ্ঠানে আসেন জহির রায়হান পুত্র অনল রায়হান। জাগরণ অনলাইন প্রধান বিধান রিবেরুর সঞ্চালনায় তিনি এসময় জহির রায়হান প্রসঙ্গে অনেক কথা বলেন। সেসব কথার কিছু অংশ জাগরণের পাঠকদের জন্য নীচে দেয়া হলো।


পুত্র হিসেবে বাবাকে আমি খুব কমই দেখেছি আসলে। তার একটি কারণ হতে পারে উনার কোন স্মৃতি আমার নেই। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোন অতৃপ্তিও নেই।

তিনি এমন একজন মানুষ যিনি বাংলাদেশের দেশ বিভাগের পর থেকে, বা পাকিস্তান-ভারত হবার পর থেকে শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতির যে চর্চা হতো পঞ্চাশ-ষাট দশকে, সে সময়ের অন্যতম প্রধান পুরুষ। তারপর যখন মুক্তিযুদ্ধ গেল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ এবং অবদান; যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হবার পর দেড়টা মাস তাঁর অংশগ্রহণ এবং অবদান, সব মিলিয়ে তিনি ইতিহাসের অন্যতম চরিত্র হয়ে গেছেন।

এই চরিত্রকে যখন আমি বুঝতে পারি বা বুঝতে শুরু করি, যিনি আমার পিতা ও রক্ত আমার ডিএনএ’র ভিতর রাখা, তাকে আবিষ্কার করার যে মাধুর্য, চ্যালেঞ্জ, বেদনা, আমি বলবো সেটা রোমান্টিসিজম; সেটা এক অসাধারণ জায়গা।

সেটা আমি যখন কৈশোর থেকে তারুণ্যে গেছি, তারুণ্য থেকে যৌবনে পৌঁছেছি, এই প্রত্যেকটা ট্রানজেকশনে আমি উনাকে একেকভাবে দেখতে শুরু করেছি, একেকভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছি। এই শেখা বা গ্রহণ করতে পারা বা দেখতে পারার সঙ্গে আমার মা কী বললো, কলেজ বা স্কুলের শিক্ষক কী বললেন, সমাজ কী বলেছে তার সাথে কোন মিল নেই। কারণ আমি তাঁকে একান্তই নিজের মতো করে দেখেছি, একটা ঘরে রাতেরবেলা শুয়ে ভাবার চেষ্টা করেছি, পুত্র হিসেবে। কিন্তু এইভাবে পাওয়াটা কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি না।

সাধারণভাবে উনার যে চরিত্রটার কথা বললাম, বাঙ্গালির জাতিসত্ত্বা বা মুক্তিযুদ্ধ, এই সময়টা ধরলে এক অসাধারণ চরিত্র। সেভাবেই কিন্তু আমি তাঁকে দেখেছি।

জাতি যেভাবে জহির রায়হানকে দেখতে চায় বা আবিষ্কার করতে চায় আমিও কিন্তু সেভাবে আবিষ্কার করি।

আমার মনে আছে ৮৭ সালের দিকে বাংলা একাডেমিতে স্টল হতো। বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহার্য সামগ্রী সেখানে প্রদর্শন করা হতো। আমি গিয়েছিলাম সাথে ছিল দুই বন্ধুও। আমি কিন্তু জেনে যাইনি সেখানে বাবার স্মৃতি নিয়ে একটি স্টল ছিল। আমি হাটঁতে হাটঁতে দেখি জহির রায়হানের কলম, নোটবুক, কাপড়চোপড় ওই স্টলে রাখা। শোকেস করা আছে।

আমি ওখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দেখলাম আমার চোখ থেকে পানি পড়তে শুরু করছে। এমন না যে আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। আমি কাদঁতে শুরু করলাম। আমি প্রথম অনুভব করলাম যে, এই যে মানুষটা আমার পিতা, এই পিতার সন্তান আমি, আমি উনার রক্ত বহন করছি। কিন্তু উনার দর্শন আমাকে বহন করতে হবে, উনি লেখক ছিলেন, আমাকে লেখক হতে হবে, উনি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, আমিও ফিল্মমেকার হবো, এইসব ভাবনার মধ্যে, বিশ্বাস করেন, আমি কখনোই ঢুকিনি।

ওই যে, ডিএনএ বললাম, ওটা আমার পিছু ছাড়েনি। আমি কখন বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম, আমার ডানপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। আমি ওইদিকে হাঁটিনি, আমি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। তাঁর সমগ্র সত্ত্বা যেন আমার মধ্যেই রয়েছে। …

আপনাদের মধ্য দিয়ে, আমি একটা দাবি করে যাই। সেটা হচ্ছে, জহির রায়হান শহীদ হয়েছিলেন মিরপুরে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। এই সময়টাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন বলা হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার দেড় মাস পর মিরপুর মুক্ত হয়। ওইখানে এই মানুষটা শহীদ হয়েছিলেন। সেইখানে শহীদ হয়েছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সেনা এবং বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্য। এটা নতুন প্রজন্মের কাছে যদি আমি তুলে ধরবার সুযোগ না পাই, তাহলে এই জায়গাটা সব সময় একটা কনফিউশান তৈরি করবে। এরশাদ যেমন আমাদের বাড়ি উচ্ছেদের সময় বলেছিলেন, জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হননি, কারণ তিনি নিহত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দেড় মাস পরে, এরকম নানান প্রশ্ন পরবর্তীকালে আমরা শুনেছি।

এটি জহির রায়হান বলে না, কথা হচ্ছে এটা একটা ইতিহাস এটা সংরক্ষণ করা উচিত। মিরপুর এলাকাটা পুরোটাই গণকবর। এত হত্যাকাণ্ড ওখানে ঘটেছে। এর মধ্যে ক্রিকেট স্টেডিয়ামটাও আছে। ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এখনকার তরুণ প্রজন্ম যায়, ২০ বছর পরে তরুণ প্রজন্মই যাবে খেলা দেখতে। ক্রিকেটের সাথে এর কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। কিন্তু আপনি যদি ইতিহাস সংরক্ষণ করতে চান তাহলে সম্পর্ক তৈরি করতেই পারেন। এটা আমাদের দায়।

আমার প্রস্তাব ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে করে দিন না জহির রায়হানের নামে। জহির রায়হানের নাম না দিতে চাইলে, সেটার নাম হতে পারে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এই নামটা রাখলে একটা ছেলে, একটা মেয়ে ভাববে এর নাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন? আর ওখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেবেন, শহীদদের ছবি দেবেন, কেন এর নাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সেটার তথ্য দেবেন, ওখানে জহির রায়হানের ছবিও বড় আকারে থাকলো।

আপনি মাশরাফিকে দেখতে যান, সাকিবকে দেখতে যান। আজকের মাশরাফি, সাকিব সম্ভব ছিল না, যদি ওই জায়গাটিতে হাজার হাজার লোক গণকবরে শুয়ে না থাকতো। ওই জানগুলো গেছে বলেই আজকের মাশরাফি, সাকিব। তো সরকার যদি এর নাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট রেখে দিতেন তাহলে এটা একটা অসাধারণ সিদ্ধান্ত হতো। জহির রায়হান স্টেডিয়ামও নাম রাখা যায়। আমি জাগরণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটা ভেবে দেখার জোর দাবি জানাচ্ছি।

(শ্রুতিলিখন: সানজিদা শহীদ শম্পা)