জাঁ দিলিল্লে ও জুডিথ উডসওয়ার্থ

অনুবাদের চৌরাস্তায় ভারত

জি এইচ হাবীব প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২১, ০২:০৩ পিএম অনুবাদের চৌরাস্তায় ভারত

(জাঁ দিলিল্লে ও জুডিথ উডসওয়ার্থের লেখা ‘অনুবাদক যুগে যুগে’ প্রথম প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। প্রকাশের পরই বইটি অত্যন্ত প্রভাবসঞ্চারী এবং উদ্ভাবনকুশল কাজ হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। অনুবাদকরা যুগে যুগে, দেশে দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। অত্যন্ত প্রশংসিত এ গ্রন্থে বলা হয়েছে বিভিন্ন ভাষার বিকাশে, নানা সাহিত্যের আবির্ভাবে, জ্ঞান বিতরণে ও মূল্যবোধ বিস্তারে এ অনুবাদকদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজনের অমলিন অবদানের কথা, যা হয়ে উঠেছে বিশ্বসংস্কৃতিরই একটি অনুপম কাহিনী। জাগরণ অনলাইনের জন্য বইটির ৪র্থ অধ্যায় এখানে অনুবাদ করে দেয়া হলো। অধ্যায়টির নাম ‘অনুবাদকগণ এবং জ্ঞানের পরিব্যাপ্তি: অনুবাদের চৌরাস্তায় ভারত’।)

 

বহুসংস্কৃতিবাদ ও বহুভাষাবাদের শক্তিশালী ঐতিহ্যের দেশ ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিম-লে অনুবাদ সব সময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। আলোচনার এই অংশটি জ্ঞানের প্রসারে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এমন কিছু অনুবাদের ওপর জোর দেবে, বিশেষ ক’রে বৈজ্ঞানিক অনুবাদকর্মগুলোর ওপর।

৬ষ্ঠ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে ভারত ভূমধ্যসাগরীয় জাতিগুলোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বা বন্ধন তৈরি করে ফেলেছিল। এবং আরো ছয়শত বছরের মধ্যে টলেমীয় মিশর এবং বাইজেন্টিয়ামের সঙ্গে বাণিজ্য করতে শুরু করেছিল। তার ফলে উভয় দিকেই ফলপ্রসূ  ক্রস-ফারটিলাইযেশনের একটি কালপর্ব শুরু হয়েছিল — পুব ও পশ্চিমমুখী। প্লেটোর Timaeus-এ রোমক চিকিৎসক ও বিশ্বকোষপ্রণেতাবৃন্দের নানান রচনায়, এবং গ্রীক চিকিৎসক দিওস্কোরিদেস ও গ্যালেনের লেখায় লভ্য চিকিৎশাস্ত্রীয় তত্ত্বে ভারতীয় চিন্তার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

{দিওস্কোরিদেস (আনুমানিক ২০-৭০) ছিলেন বিভিন্ন ওষুধ-পত্র এবং সে-সবের ব্যবহার সম্পর্কিত—আমাদের জানামতে — বিদ্যমান প্রাচীনতম টেক্সটের রচয়িতা; গ্যালেন (আনুমানিক ১৩০-২০০) শরীরসংস্থানবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর কাজের জন্য বিখ্যাত।}

১৫০ সালে, একশ বছর আগে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রীক ভাষাতে রচিত একটি জ্যোতিষশাস্ত্র সংক্রান্ত রচনা মধ্য ভারতের উজ্জয়িনীতে যবনেশ^র সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেন। প্রকৃতপক্ষে, গ্রীক ভাষা অধ্যয়নের একটি ফল হিসেবে ভারতে জ্যোতিষশাস্ত্র উদ্ভূত হয়, এবং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান তিব্বতে পরিবাহিত হয়েছিল, আর সেখান থেকে তা মোঙ্গলদের মধ্যে চারিয়ে যায়, সেই সঙ্গে চীন, জাপান, ইন্দোচায়না ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে।

আমরা আগেই দেখেছি, তৃতীয় এবং চতুর্থ শতকের মধ্যে অসংখ্য চীনা ও বৌদ্ধ পণ্ডিত ভারতে রচিত জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভেষজবিজ্ঞান, এবং যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত রচনা অনুবাদ করেন। এসব অনুবাদের বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে কিন্তু এই অনুবাদ কর্মকাণ্ডের কথা নথিভুক্ত হয়েছে এবং  সং  ও ট্যাং রাজবংশের সময় সংকলিত ক্যাটালগে সেসবের শিরোনাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সপ্তম শতক থেকে মালাবার উপকূল বরাবর আরব বণিকদের সঙ্গে সংস্পর্শের ফলে ভারতীয় এবং আরবদের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান বিনিময় হয়। পারস্য বংশোদ্ভূত একজন আরব চিকিৎসক ও দার্শনিক রাজেস (Rhayes)-এর রচনায় ভারতীয় উৎসবিশিষ্ট চিকিৎসাশাস্ত্রীয় রেফারেন্স পাওয়া যায়। মধ্যযুগের ইউরোপে তাঁর রচনার ত্রয়োদশ শতকীয় লাতিন অনুবাদ প্রামাণ্য টেক্সট হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।

ভারত এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় মধ্য যুগের শেষ দিকে কমে আসে, আর তার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে, অনুবাদের পরিমাণও হ্রাস পায়। ভারতীয় বিদ্যাবত্তা ঘরকুনো ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়ে। মধ্য যুগে ভারতীয় বিজ্ঞানের দশা তুলনামূলকভাবে অগ্রসর ছিল, তার কারণ — কিছু গবেষণায় দেখা গেছে — মুসলিমরা আরব বিশ্ব থেকে ভারতে জ্ঞানের সম্ভার নিয়ে এসেছিলেন (রহমান, প্রমুখ। ১৯৮২)। যাই হোক, অনুবাদ কমে গেল। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে কাজ-কর্ম বলতে ছিল আগেকার গবেষণার টীকা-টিপ্পনি বা ব্যাখ্যা। 

ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে বিভিন্ন পর্যটক ও বণিক ভারতে  পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচলন ঘটান। পর্তুগীজরাই প্রথম ইউরোপীয় যারা ভারতে পদার্পণ করেছিল — ১৫১০ সালে পশ্চিম উপকূলে তারা একটি উপনিবেশ স্থাপন করে। এরপরে  আসে ওলন্দাজরা, ১৫৯৫ সালে, এবং ব্রিটিশরা; ১৬০০ সালে তারা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি গঠন করে। ভারতে বিদেশীদের এই উপস্থিতি অনুবাদের ক্ষেত্রে নতুন চাহিদার সৃষ্টি করে। জেসুইট ধর্মপ্রচারকারী, পর্যটক বা সফরকারী, এবং রাজনৈতিক দূতেরা সংস্কৃত এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষা শিখতে শুরু করেন। সাহিত্য, ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব (লিঙ্গুইস্টিক্স) এবং ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব (ফিলোলজি) বিষয়ক নানান পাণ্ডুলিপি জোগাড় করার মাধ্যমে তাঁরা ইউরোপে, এবং সেই সঙ্গে ভারতেও, ভারতবিদ্যা চর্চার ভিত্তি স্থাপন করেন। এই কর্মকাণ্ডের ফলে সংস্কৃত থেকে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অনুবাদ সম্পন্ন হয়। ১৬৯৯ সালে Mémories de l'Académie Royale des Sciences-এ ফরাসী জ্যোতির্বিদ জাঁ-দমিনিক ক্যাসিনি জ্যোতির্বিদ্যার ওপর অজ্ঞাতপরিচয় কারো রচিত একটি (হিন্দু) পাণ্ডুলিপির অনুবাদ প্রকাশ করেন। সেটি তাঁকে সিয়ামে অবস্থিত ফরাসী মিশন থেকে পাঠানো হয়েছিল।

একটি মহাকাব্যিক গবেষণার ক্ষেত্রেও অনুবাদ বড় ভূমিকা রেখেছিল। ব্রিটিশ প্রাচ্য বিদ্যাবিশারদ এবং পণ্ডিত উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬-৯৪) অংশত অনুবাদের ওপর ভিত্তি ক’রেই ভারতীয় ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, এবং বিভিন্ন ধর্মের একটি সামগ্রিক সংকলন প্রস্তুত করেন। তিনিই লন্ডনে ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনের মাধ্যমে প্রাচ্যবিদ্যা ও সংস্কৃত অধ্যয়নের সূত্রপাত ঘটান, এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় নানান সংস্কৃত রচনা অনুবাদে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। এছাড়াও তিনি এই তত্ত্ব হাজির করেন যে সংস্কৃতই ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর উৎস। জোন্স Asiatic Researches নামের একটি জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন; সেখানে বিভিন্ন ‘মৌলিক’ (ঊর্ধ কমা অনুবাদকের) রচনা এবং নতুন ও পুরাতন অনুবাদ প্রকাশিত হতো। এই বিপুল কর্মযজ্ঞে অসংখ্য অনুবাদক অংশগ্রহণ করেছিলেন, এবং এর ব্যাপ্তি ছিল প্রায় দুই শতক, ১৬৯০ থেকে ১৮৮২।

{কয়েকজন বিশিষ্ট অনুবাদকের নাম এখানে উল্লেখযোগ্য: জাঁ সিলভিয়ান বেইলি, রুবেন বারো, জোসেফ তিয়েফেনথেলার, জন বেন্টলি, এবং লিওঁ রিওদেত। দেখুন, সেন (১৯৭২:৪৪-৭০)}

হেনরি কোলব্রুকের (১৭৬৫-১৮৩৭) কাজ পরবর্তী কালের অনুবাদকবৃন্দ এবং গণিতের ইতিহাসবিদদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর  Algebra with Arithmatic and Mensuration, translated from the Sanskrit of Brahmegupta and Bhascara (১৮১৭)-তে জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিত বিষয়ক রচনা ব্রহ্মসিদ্ধান্ত থেকে সটীক অনুবাদ ছিল; সেই সঙ্গে ছিল বীজগণিত বিষয়ক দুটি গবেষণা প্রবন্ধ বীজগণিত এবং লীলাবতি। লীলাবতি ১৮১৬ সালে ইংরেজিতেও অনূদিত হয়েছিল; অনুবাদক ছিলেন জন টেইলর। ৮০০ থেকে ৫০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে রচিত বৌদ্ধযান-সুল্বসূত্র ভারতীয় গণিতের সবচাইতে মূল্যবান রচনা। বইটি জার্মান প্রাচ্যবিদ গিওর্গ ফ্রিডরিখ উইলহেম থিবাউট (১৮৪৮-১৯১৪) ১৮৭৪-৭৫ সালে প্রকাশ করেন, সেটার সঙ্গে ছিল বইটির একটি ইংরেজী অনুবাদ, টীকা,  এবং ষষ্ঠ শতকের একজন পণ্ডিত Dvarakantha Yajva রচিত ব্যাখা-বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি, যিনি সুল্ব-দিপীকা-রও ব্যাখ্যাকার ও রচয়িতা ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে ১৮৮৮ সাল অব্দি থিবাউট বেনারসে অবস্থিত সংস্কৃত কলেজের পরিচালক ছিলেন (বেনারসকে বারাণসীও বলা হয়। উত্তর ভারতে অবস্থিত এই নগরটি হিন্দুরা পবিত্র বলে গণ্য করেন।) তিনি পণ্ডিত নামে একটি জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন; আগে প্রকাশিত হয়নি এমনসব সংস্কৃত টেক্সট এবং প্রাচীন সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি এই পত্রিকায় ছাপা হতো।

১৮৯০-এর দশক থেকে, ‘বাওয়ার পাণ্ডুলিপি’ নামে পরিচিত প্রাচীন সংস্কৃত আর প্রাকৃত ভাষায় রচিত চিকিৎসাশাস্ত্রীয় কিছু রচনার একটি সংগ্রহ আরেকজন প্রাচ্যবিশারদ ইংরেজ রুডলফ হোরনেল (১৮৪১-১৯১৮) অনুবাদ করেন (হোরনেল, ১৯৮৭)। উল্লেখ্য, পাণ্ডুলিপিগুলো যিনি পুনরাবিষ্কার করেছিলেন তাঁর নামানুসারে সেগুলোর নাম রাখা হয়েছিল। উনবিংশ শতকে এমন বেশ কিছু অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলো বেশ আগে অনূদিত হলেও অপ্রকাশিতই রয়ে গিয়েছিল। তার একটি উদাহরণ হচ্ছে পারস্য বংশদ্ভূত মুসলিম কবি আবুল ফয়েজি ইবনে-মুবারক-এর (১৫৪৭-৯৫) রচনা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় লেখা গণিত বিষয়ক ভাস্করাচার্যের বিখ্যাত রচনা লীলাবতি ফারসী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি বিখ্যাত মহাকাব্য মহাভারতের কিছু অংশও অনুবাদ করেছিলেন অথবা অনুবাদের তত্ত্বাবধান করেছিলেন।

{বৈদিক যুগের (আনুমানিক ১০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ) এক লক্ষ কুড়ি হাজার শ্লোকের মহাকাব্য মহাভারত অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব দেশেই সেটি অনূদিত হয়েছে, এবং সেসব দেশের সাহিত্য ও শিল্পে অগুনতি বিষয়বস্তুর জোগান দিয়েছে।}

জনশ্রুতি আছে, বেনারস গিয়ে জনৈক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শেখার জন্য তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি কেবল সংস্কৃতই শেখেননি, দশ বছর ধরে বেদ-ও অধ্যয়ন করেছিলেন, যাতে তা ফারসিতে অনুবাদ করা যায়।

{বেদ হচ্ছে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা পবিত্র এবং কাব্যিক রচনা। বেদই প্রথম ভারতীয় সাহিত্যিক রচনা। বৈদিক ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আদি রূপ।}

কিন্তু তিনি সেই ব্রাহ্মণের কন্যার প্রেমেও পড়েছিলেন। ব্রাহ্মণ পিতা তাঁর শিষ্যের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিতে সাসন্দে রাজি হলেও যখন জানলেন ফয়েজি নিজের পরিচয় গোপন করেছেন তখন তিনি তাঁকে তাঁর অধ্যয়ন ও অনুবাদ চালিয়ে যেতে নিষেধ করেন; শুধু তাই নয়, ফয়েজি এর আগে বেদ থেকে যেসব অনুবাদ করেছিলেন সেসব প্রকাশ করতেও মানা করেন।

{এই কাহিনী বা কিংবদন্তীটির কথা বলেন আলেকজান্ডার ডন, যিনি ১৭৭০ সালে ফারসী থেকে ইংরেজিতে Farishta's Story নামে একটি অনুবাদ করেন।}

জ্ঞান পরিবহনে সংস্কৃত বা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের ভূমিকা কতটুকু তা মূল্যায়ন করা আরো কঠিন, তার কারণ এ-ব্যাপারে ভালোভাবে অধ্যয়ন করে তেমন কিছু নথিভুক্ত করা হয়নি। ভারতের দিকে জ্ঞানের অভিপ্রয়াণের  ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। যদিও, খণ্ড খণ্ড কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। আমরা দেখেছি, ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ষোড়শ শতক একটি উল্লেখযোগ্য সময়। তার এক শতক পরে জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক ইউরোপীয় পারদর্শিতার সঙ্গে ভারত পরিচিত হয়। আরব দেশ, ইউরোপ এবং ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক রচনার সাহায্যে মহারাজা সভাই (Sawai) জয় সিং (১৬৯৯-১৭৪৩) — যিনি নিজেও একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন — পাঁচটি মান মন্দির স্থাপন করেন এবং কিছু আলোকবিদ্যা সংক্রান্ত যন্ত্র (অপটিকাল ডিভাইস) আবিষ্কার করেন যেগুলো পরে সেসব মানমন্দিরে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাঁর তৈরি করা জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সারণিগুলো (অ্যাস্ট্রনমিকাল টেবলস) খুবই নিখুঁত বলে পরে প্রমাণিত হয়েছিল। তাঁর প্রধান জ্যোতির্বিদ জগন্নাথ সম্রাট (১৬৫২-১৭৪৪) টলেমির আলমাজেস্ট এবং ইউক্লিডের এলিমেন্টস আরবি থেকে সংস্কৃততে যথাক্রমে সম্রাট-সিদ্ধান্ত এবং রেখাগণিত শিরোনামে অনুবাদ করেন। ‘জ্যোতির্বিদ রাজপুত্র’ নামে পরিচিত জয় সিং-কে অ্যাস্ট্রোলেব-এর ডিজাইন ও গঠন বিষয়ক একটি গবেষণা প্রবন্ধ যন্ত্ররাজা রচনার কৃতিত্ব দেয়া হয়ে থাকে, তবে সম্ভবত সেটি হয় ফারসী নয়ত আরবি থেকে অনুবাদ (সেন ১৯৭২:৫৬)।

ভাষাতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহ এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের পণ্ডিতদের মধ্যে জ্ঞান পরিবহনের ক্ষেত্রে অনুবাদকের ভূমিকা কতটা তা নয়নসুখপাধ্যায়ের একটি অনুবাদ উকরাখ্য গ্রন্থ (১৭৩০) যথেষ্ট বিশদভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল। জ্যামিতি বিষয়ক এই সংস্কৃত গবেষণা প্রবন্ধ একটি সামষ্টিক আরবি সংস্করণ থেকে অনূদিত,  যে আরবি সংস্করণটি আবার আসলে একটি মূল গ্রীক সংস্করণ থেকে অনূদিত (সেন (১৯৬৬) । এই ধরনের ‘হাত ফেরতা’ অনুবাদ মধ্য যুগের ইউরোপে গিয়ে পৌঁছানো অনুবাদগুলোর মতোই, যে অনুবাদগুলো ছিল একটি চেইন বা শেকলের অংশ যেখানে মূলটি ছিল গ্রীক, আর তার সংযোগ সূত্রগুলো ছিল, ধারাবাহিকভাবে, সিরিয়াক, আরবি, লাতিন, এবং ইউরোপীয় দেশী ভাষা সমূহ।

ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে, বুদ্ধিজীবী এলিট শ্রেণীর চাপের ফলে বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দেশী ভাষার ব্যবহার বাংলা এবং দিল্লীতে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছিল। এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরো সহজগম্যতার দাবি তুলেছিল এবং ম্যাকঅলের শিক্ষা ব্যবস্থার সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করেছিল।

{টমাস ব্যাবিংটন ম্যাঅকলে (১৮০০-৫৯) ছিলেন একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এবং রাজপুরুষ। ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সাল অব্দি তিনি ভারতে চাকরি করেছিলেন, এবং তিনি ব্রিটেনের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একটি দণ্ডবিধিও তৈরি করেছিলেন যার ওপর ভিত্তি ক’রে পরে ভারতীয় ফৌজদারী আইন তৈরি করা হয়।}

অনেকেই এ কথা উপলব্ধি করেছিলেন যে অনুবাদ আর অল্প কিছু পণ্ডিতের একান্ত এক্তিয়ারভুক্ত হয়ে থাকা উচিত নয়। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার অভিযানে দেশী ভাষায় অনুবাদ একটি মৌলিক উপাদান। এবং, বিভিন্ন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সংস্থা বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার এই কাজ হাতে তুলে নিয়েছিল। ১৮২৪ সালে নেটিভ মেডিকেল ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা এবং সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসায়  (আক্ষরিক অর্থে একটি ‘বিদ্যালয়’) ১৮২৬ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রীয় কোর্স চালু হওয়ার ফলে সংস্কৃত, বাংলা এবং অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় অসংখ্য ইউরোপীয় টেক্সট অনুবাদের প্রয়োজন হয়।  ১৮৬৮  থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে বাংলা ভাষায় অন্তত দশটি বৈজ্ঞানিক জার্নাল এবং সাতচল্লিশটি প্রায়োগিক প্রকাশনা বের হয়। আধুনিক বিজ্ঞানকে ভারতীয় ভাষাগুলোতে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, যেমন, মাদ্রাজ, বম্বে, পাঞ্জাব এবং ওউধেও (বর্তমান সময়ের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে) বিস্তার লাভ করে। (কৃষ্ণ ১৯৯১:৯৫)

জ্ঞান-বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিদ্বজ্জনোচিত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরানো দিল্লী কলেজের পৃষ্ঠপোষকতায় দিল্লীতে, ১৮৪৩ সালে, দেশী ভাষায় অনুবাদের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। গণিতজ্ঞ, সাহিত্যিক, এবং বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক যসুদাস রামচন্দ্র (১৮২১-৮০), সেই কলেজেরেই ছাত্র এবং পরে সেখানের শিক্ষক (৯ নম্বর ছবি) টেট-এর Elements of Mechanism উর্দু ভাষায় Risala Usual Kalon ke bare main শিরোনামে অনুবাদ করেন। অনুবাদ এবং সৃজন তাঁর ক্ষেত্রে হাতে হাত রেখে চলেছিল। সৈয়দ আহমদ খান, যিনি ১৮৬৪-তে একই ধরনের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর মতে, ‘যাঁরা ভারতের উন্নতির জন্য উৎসাহী তাঁদের একথা মনে রাখা উচিৎ যে তা করার সেরা উপায় হলো তাঁদেও নিজেদের ভাষায় সব শিল্পের ও বিজ্ঞানের অনুবাদ [...] (ইরফান হাবিব ও রায়না কর্তৃক উদ্ধৃত ১৯৮৯: ৬০৫) । মওলানা ইমদাদ আলী, যিনি ১৮৬৮ সালে বিহার বৈজ্ঞানিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনিও একই ধরনের মত প্রকাশ করেছিলেন: ‘যে ধরনের উন্নত সভ্যতা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং জার্মানি অর্জন করেছে তা তারা কখনোই করতে পারত না যদি না মূলত রোম এবং গ্রীস থেকে নেয়া বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা তারা জনগণের কাছে তাদের ভাষায় পৌঁছে না দিত (ইরফান হাবিব ও রায়না ১৯৮৯: ৬০৫)। এই পরিপ্রেক্ষিতে, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের বেলায় অনুবাদ একটি নির্ণায়ক এবং আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে একটি জরুরি উপাদান।

জ্ঞানের স্থানান্তর এবং অভিযোজন, যা এক ‘বহু স্তর বিশিষ্ট সাক্ষাৎ’, একটি জটিল বিষয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে একই সঙ্গে ‘দু দিকে মুখ ফেরানো’ হিসেবে দেখা হয়। ‘তা একদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বার্তাবহ, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক সর্বনাশের লক্ষ্মণ সূচিত করে।’ (রায়না এবং ইরফান হাবিব ১৯৯৩:৯৩:৯৬)। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক চিন্তা অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। যদিও বিনা তর্কে নয়, কারণ জানাশোনার সনাতন পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে বিচারবুদ্ধির সংযোগ ঘটেছিল। বিউপনিবেশায়নের প্রক্রিয়ায় বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক এলিটদের সংশ্রব ছিল (রায়না এবং ইরফান হাবিব ২০০৪)।

(অনুবাদ: জি এইচ হাবীব)