জনইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও নিম্নবর্গের চেতনা

রঞ্জনা বিশ্বাস প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২১, ০৩:৩৩ পিএম জনইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও নিম্নবর্গের চেতনা

জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলো কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে, তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক-কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকরা মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংস্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতে চাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভুক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনাগুলো বা মূল সূত্রটুকু সযত্নে আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনোই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উন্মোচিত হয় না।

১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রগামী ছিলেন এ দেশের নিম্নবর্গের মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর। এমনকি এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এদেরই সম্পর্ক ছিল গভীর। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬৯-এর আগে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিজীবীর সংখ্যা ছিল ৭৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আবার দেশের বর্গাচাষি, কৃষিমজুর এবং শিল্পশ্রমিক (যাদের মোট পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ) ছিলেন মোট শ্রমশক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। বাঙালিরা ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ২৮১ বার ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আন্দোলনগুলোর মধ্যে শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১০৫ ও ৪২। এদিকে ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল ১০৬। বলাই বাহুল্য, এই ছাত্রদের বড় অংশই ছিল গ্রামের কৃষকের সন্তান। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের অধিবাসী। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৮৩ শতাংশের পারিবারিক আয়ের উৎস ছিল আংশিক অথবা পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ কৃষিসমাজই ছিল বাংলার অর্থনীতির প্রাণ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা ভারতের জমিসংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। তারা মুঘল আমলের কৃষিব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন সাধন না করে তাদের আদলেই নিজেদের সুবিধামাফিক জমিদারি প্রথা বহাল রেখে নীতি নির্ধারণ করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে বাঙালিরা মনে করে যে এখন তাদের সরকার হয়তো ভূমি সংস্কার ও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টে যে ভূমি সংস্কার বিল পাস করা হয়, তাতে জোতদারদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। শাসকদের অসম ভূমি ব্যবস্থাপনা, জমির মালিক ও বর্গা চাষিদের মধ্যে ফসলেরর বণ্টন প্রক্রিয়ায় অসমতা, ফসল ফলানোর ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা জারি, কৃষকের কাছ থেকে বেশি করে ভূমি রাজস্ব আদায়, কর্ডন আইনের মাধ্যমে কৃষিদিনমজুরকে প্রতারণাসহ নানা রকম নিপীড়ন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় বাংলার গ্রামীণ সমাজে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে শুরু করে মানুষ। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে গ্রামীণ সমাজের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন— ‘My question is whose money we are spending now? This money belongs to the poor farmer of this country…’

কিন্তু ছাঁচে সাজানো ইতিহাসবিদ্যায় প্রচারিত হয় উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আর উপেক্ষিত হয় জনসাধারণের অংশগ্রহণ, সাধারণ মানুষের ইতিহাস চেতনা। অথচ জাতীয় আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝতে হলে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করতে হবে, বুঝতে হবে। আর এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করতে হলে জনসমাবেশের রাজনৈতিক চেতনা ও সমবেত কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা দরকার। প্রতিটি আন্দোলনের প্রথম শর্ত বা উপাদানই হলো জনসমাবেশ। এই জনসমাবেশ যেমন প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তি বা সংগঠনের মাধমে সংঘটিত হয় তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনসাধারণের স্বতন্ত্র উদ্যোগেও সংঘটিত হয়। মুঘল আমলে যেসব কৃষক আন্দোলন বা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল এবং সমাবেশ ঘটেছিল, তাদের প্রত্যেকেরই ছিল নিজের গোষ্ঠীচেতনা। রায়তদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ, শোষণের তীব্রতায় নিরুপায় সাধারণ মানুষ স্থানীয় প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় সেই সব আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনায় ঐতিহাসিকের সমস্ত ফোকাস গিয়ে পড়েছে রাজপুত সরদার দুর্গাদাস, সামন্ত প্রভু প্রতাপাদিত্য বা প্রতাপ সিংহ কিংবা শিবাজী প্রমুখদের ওপর। অথচ এই সব আন্দোলনের যে গণমুখী ধারা, সেই ধারার নায়ক ছিলেন একজন সনাতন সরদার, একজন গরিব দাস হাডা বা বান্দা বাহাদুর বা দাসী কর্মী। কিন্তু সেই মানুষগুলোর সামগ্রিক চেতনার আভাস লিখিত ইতিহাসে মেলে না। মুঘল আমলেও যেমন এদের ইতিহাস রচিত হয়নি তেমনি ঔপনিবেশিক আমলে বিরসার বিদ্রোহ, আগস্ট সংগ্রাম, নৌ বিদ্রোহ প্রভৃতির ইতিহাসেও জনগণের অভ্যুত্থান ও জাতীয়তাবাদী চেতনা উপেক্ষিত হয়েছে। মুঘল আমল কিংবা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সংঘটিত আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখত না। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মুঘল রাষ্ট্রের অনুজ শাসনব্যবস্থা হিসেবে মনে করত। এ কারেণে তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহ বা সমাবেশ ন্যায়সংগত পথে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা পরিচালিত হয়েছে ভুল পথে। এ রকমটা হতো। কেননা, ঔপনিবেশিক শোষণের তীব্রতা সেই সব নেতার চেতনাকে গ্রাস করে পরিবর্তিত করে দিত। তাই মুঘল যুগের আন্দোলনগুলোর চেয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আন্দোলনের মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তবে এই সব আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতারা বরাবর সকারের মদদপুষ্ট ও পক্ষপাতদুষ্ট সুবিধাভোগী হওয়ার ফলে এতে আন্দোলনের সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায় না। তবে এই সব সমাবেশের মধ্যে গোষ্ঠীচেতনা থাকলেও জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকট ছিল না। তারা প্রায়ই উৎপীড়িত জমিদার ও সামন্ত প্রভুদের মন্ত্রণায় চালিত হতো। ফলে তাদের আন্দোলনের গতিপথ পাল্টে যেত আর তার সুবিধা ভোগ করত সামন্ত নায়কেরা। আর্থিক সুবিধা থেকে নাম যশও সবকিছুই প্রায় তাদের দখলে চলে যেত। এসব সমাবেশের জনগণ ছিল রাজনৈতিক আভিজ্ঞতা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ফলে তাদের আন্দোলন স্থানীয় প্রতিনিধির বিরুদ্ধে হলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে ঈশ্বরজ্ঞানে মান্য করত। এসব কারণে তাদের আন্দোলন কখনোই চূড়ান্তভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ পায়নি এবং সফলও হয়নি। তবে এ কথা সত্য, এই সব আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বীজ।

১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা পূর্ব বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। তারা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদলে এখানে শাসন ও শোষণের ধারা অব্যাহত রাখেন। তাদের সঙ্গে কালের পার্থক্য ছাড়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো পার্থক্যই ছিল না। কিন্তু শোষকরা এটা ভুলে গিয়েছিল যে সব ব্যর্থ বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী নেতারা যেকোনো সময় তাদের চেতনাকে বদলে ফেলতে সক্ষম হবেন। আর এ কারণেই ’৪৭-পরবর্তী পূর্ব বাংলার সমস্ত বিদ্রাহ বা আন্দোলন তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য নিয়ে ফিরে এসেছিল। বাঙালিরা শুরুতেই তাদের আন্দোলনের বর্শামুখ ধাবিত করতে পেরেছিল সুনির্দিষ্ট শত্রুর বিরুদ্ধে। তারা স্থানীয় প্রতিনিধি নুরুল আমীনের বিরুদ্ধে নয়, সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেই তাদের আন্দোলনের বর্শামুখ ধাবিত করেছিল। তারা জানত নুরুল আমীন শাসকদের ক্রীড়নকমাত্র। অতএব আন্দোলন সফল করতে হলে কোনো মধ্যস্থতাকারী দালালকে আশ্রয় করা যাবে না। অর্থাৎ তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল না। তারা নিজেদের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মধ্যখানের ফারাক সম্পর্কে ওয়কিবহাল ছিল। তারা তাদের পূর্বসূরিদের মতো এই ফারাককে আধ্যাত্মবাদের ধারণা দিয়ে ভরে দেয়নি। বরং তারা পরিপূর্ণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়েই তা পূরণ করে নিয়েছে। তারা তাদের অধিকার ও শাসকদের ব্যবহার সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবেই সচেতন ছিল। এ কারণে লোককবি গানে গানে প্রচার করেছিলেন- বাঙালিরা গাভী পালে/ গাইরে খাওয়ায় ঘাস/ পশ্চিমারা দুধ খাইয়াছো এই তো ইতিহাস… আমার হাঁসে আন্ডা পাড়ে /কার বিড়ালে খায়/ মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা এবার/ বিড়াল ধরতে চায়/ বিড়াল বাঁচবে না বাঁচবে না/ মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না। পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে কতটা পরিষ্কার ধারণা রেখে ছিল, তা লোককবির এই গানটা থেকেই স্পষ্ট হয়। ইতিহাসের অন্য সব আন্দোলনকে উৎপীড়িত জমিদাররা নিজেদের স্বার্থে জনগণকে যেভাবে ব্যবহার করতে এগিয়ে এসেছেন, তাতে করে তাদের আন্দোলনের গতিমুখ বা চরিত্র প্রায়ই পাল্টে গেছে। কিন্তু বাঙালির কোনো আান্দোলনের ক্ষেত্রে তেমন ঘটনা দেখা যায় না। আর তা ছাড়া বাংলায় অনেক যোগ্য নেতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ বাঙালি তার চূড়ান্ত পর্বের আন্দোলনের জন্য নিজেদের নেতা নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের নির্বাচিত নেতা কোনোরকম জোতদার-জমিদার নয়, নয় সামন্তপ্রভু। তিনি যে পশ্চিমাদের সঙ্গে আঁতাত করে বাঙালিদের সঙ্গে বেঈমানিও করবে না, এটাও তারা বুঝতে পেরেছিল। আর এ কারণেই লোককবির নিজস্ব ইতিহাস চেতনার মধ্যে তাদের নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে পাই একজন মাঝি হিসেবে। লোকসমাজে ‘মাঝি’ তাদের মতোই নিম্নবর্গের একজন মানুষ, প্রান্তিক মানুষ। খাল-বিল-হাওর নদীবেষ্টিত পূর্ব বাংলায় মাঝি হলো এমন একজন যে পারাপারের দায়িত্ব নির্দ্বিধায় পালন করে। সে হয় সবার পরিচিত আর আপনজন। তাই বিপৎকালে মাঝির চেয়ে আপন মানুষ লোকসমাজে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই লোককবির চেতনায় শেখ মুজিব তাদের কান্ডারি-মাঝি। বারবার সেই কথাটাই তারা তাদের গানে কবিতায় প্রচার করেছেন। সুনামগঞ্জের লোককবি কামাল উদ্দিন বলেন—
‘নৌকা আগে চলে রে, এ নৌকা শেখ মুজিবের
ও নাও দেখতে ভালো, চাঁদের আলো গলই ছিল চন্দনের
এগারো তক্তার নৌকাখানি, নাহি দিলো গাব গাঁথুনিরে
একবিন্দু দেয় না পানি, উপরে তার আছে ছানি
গলুই ছিল সেগুনের।
ওই নৌকার ভিতর খোলা মানুষ ধরে উনিশ জেলার
বুঝি না ভাই খোদার লীলা, জায়গা হয় না দালালের
শেখ মুজিব হাইরে ধরা, সামাদ ব্যাটা মাস্তুল খাড়া
 ছায়া পড়ল আরশের।’ 
এই গানে পূর্ব বাংলা ভূখণ্ডকে নৌকা রূপে জ্ঞান করে লোককবি তার মাঝির দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন শেখ মুজিবকে। লোককবি সিলেটের মানুষ তাই সেই নৌকার মাস্তুল হিসেবে তিনি সিলেটের মোহাম্মদ সামাদ আজাদকে উপস্থাপন করেছেন। সেই নৌকা এগারো তক্তা দিয়ে তৈরি। এই এগারো তক্তা হলো ছাত্রদের এগারো দফা। এই গানে লোককবি তার লোক-ঐতিহ্যের উপাদানে সেকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে নিজের চেতনার রঙে রাঙিয়ে নিয়েছেন। দালালমুক্ত উনিশ জেলার মানুষ সেই নায়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের পার করে দেওয়ার দায়িত্ব শেখ মুজিবের। এ রকম আর একটি গানে তিনি বলেন—
নৌকা বাইয়া যাওরে বাংলার জনগণ
বঙ্গবন্ধুর সোনার নাও ভাসাইলাম এখন
ও ভাইরে ভাই, ছয় দফার এই নৌকাখানি
সাজাইয়াছেন মুজিব জানি বাংলার দুঃখ করিতে নিবারণ।
এই গানটিতেও লোককবি নৌকা তথা দেশের মালিকানা দিয়ে দিয়েছেন মুজিবের নামে। অর্থাৎ একমাত্র মুজিবই পারেন বাংলার মানুষের দুঃখ নিবারণ করতে। সেই সময় সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষের চেতনার মধ্যে বঙ্গবন্ধু নামের যে মানুষটিকে নেতা হিসেবে উপস্থিত হতে দেখি, সে তাদের নিজের গোত্রের মানুষ, নিম্নবর্গেরই মানুষ—একজন মাঝি।

’৭০-এর নির্বাচনের বহু আগেই তিনি লোকমানসে একজন কান্ডারি হিসেবেই জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। সাধারণ জনগণকে রাজনৈতিকভাবে ইতিহাস সচেতন করে তোলার জন্য তিনি যত সভা সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন, মানুষের কাছে গিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন ততটা ইতিহাসের আর কোনো নেতা করেননি। আর এ কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন গণমানুষের আদর্শ নেতা। ফলে অন্যান্য আন্দোলনের সমাবেশ থেকে পূর্ব বাংলার আন্দোলনের সমাবেশ এক বিশেষ সংগ্রামী ভূমিকার ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। তাই ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘ ছয় দফা’ ‘বাংলাদেশ’ সবই একটি বিশেষ নৌকা প্রতীকে উপস্থাপিত হতে দেখি লোকচেতনায়। তারা নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ের সঙ্গে মিলেয়ে বিষয়গুলোকে নিজের করে নিতে ‘মাঝি’ ও ‘নৌকা’ রূপকের আশ্রয় নিয়েছে। এসবই হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বতন্ত্র ও বিশেষ চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধ ১১ সেক্টরের মহান কর্তাব্যক্তিদের অধীনে পরিচালিত হলেও এটা সর্বাংশে সেই সব কর্তাব্যক্তি তথা উচ্চবর্গের কৃতিত্ব নয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রে রেখেই সেই সব উচ্চবর্গের নেতৃত্বকেই বর্তমান ইতিহাসবিদ্যায় ঠাঁই দিয়ে দেশের কামার-কুমার, জেলে-মাঝি, কৃষক-তাঁতি, মুটে শ্রমিক, মেথর আদিবাসীসহ বিভিন্ন প্রান্তের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেতনা ও নেতৃত্বকে অবহেলা করা হয়। এতে করে জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে রচিত এই সব ইতিহাসে বর্ণিত নিম্নবর্গের আত্মত্যাগের ঘটনাকে অলীক রূপকথার মতো মনে হয়। তারা সেই সংগ্রামে কেবল বলির পাঁঠা, হত্যার শিকার কিছু সংখ্যামাত্র। আর তাই পক্ষপাতদুষ্ট এই সব ইতিহাসে তাদেরই আমরা পুরস্কৃত হতে দেখি, যারা ঘটনার পরে উচ্চবর্গের মর্যাদায় আসীন হয়েছে। অথচ আন্দোলনের প্রাক্কালে তারাও ছিল পাকিস্তানিদের দ্বারা নিষ্পেষিত এবং একইভাবে এ দেশের নিম্নবর্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু স্বাধীনতার পর ইতিহাসের যে তথ্য সরবরাহ হতে দেখা যায়, সেখানে ঐতিহাসিকের সব আলো উদ্ভাসিত করেছে কেন্দ্রে অবস্থান করা উচ্চবর্গের মানুষের মুখ। তারা প্রান্তিক মানুষের চেতনাকে উপেক্ষা করেন। কারণ, তারা মনে করেন, এই সব মানুষের চেতনা বলে কিছু হয় না। এদের স্বকীয়তা বলে কিছু নেই। এদের মধ্যে যতটুকু ভালো বা মন্দ বৈশিষ্ট্য, তা শেষ পর্যন্ত উচ্চবর্গের কাছ থেকেই পাওয়া। তাদেরই বলে দেওয়া দিকনির্দেশনারই ফল। অথচ সেই সময় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজও জানত জনগণের চেতনার সঙ্গে নিজেদের চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে আন্দোলন সফল করা অসম্ভব। আর তাই তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যেসব গণজাগরণমূলক গান প্রচার করেন, তাতেও জনগণের প্রাণের সুর ও চেতনাকে সম্বল করা হয়। এ রকম একটি গান—
মুজিব বাইয়া যাও রে
নিপীড়িত দেশের মাঝে
জনগণের নাও রে মুজিব 
বাইয়া যাও রে...
ইতিহাস পর্যলোচনা করলে দেখা যাবে যে উচ্চবর্গের নেতৃত্ব তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নিতে যেমন সক্ষম হয়নি, তেমনিভাবে যে সব আন্দোলন নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র উদ্যোগে গড়ে উঠেছে, তা-ও জাতীয় আন্দোলনগুলোকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। সেই ক্ষেত্রে বাঙালির জাতীয় আন্দোলন এক ব্যতিক্রম প্রচেষ্টা যেখানে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মানুষের অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদের সমষ্টিগত রাজনৈতিক চেতনার ঐক্যে গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান পর্বে এসে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের ইতিহাস চেতনা, তাদের চালক ও সহায়কদের মনোভাব, গণজীবন ও গণমানুষের মত সম্পর্কে এই বিশেষ ঐক্য লক্ষ করা যায়।

ইতিহাসের নিম্নবর্গের চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত সব মানুষ নির্বিশেষে তাদের নেতার মধ্যে ধর্মীয় নেতার অধিষ্ঠান বা আবির্ভাবের বার্তা খুঁজে পায়। স্বরাজ আন্দোলনের নেতা ‘গান্ধীকে নিয়েও কৃষকদের মধ্যে অনুরূপ মনোভাব লক্ষ করা যায়। তারা তাঁর বক্তব্যের মধ্যে এমন সব উপাদান খুঁজে বের করে, যার মাধ্যমে তাঁকে দেবতুল্য জ্ঞান করা যায়। তারা গান্ধীর নামে ভিক্ষা চায় তাঁর নামে ভোগ দেওযার উদ্দেশ্যে। তাদের কাছে গান্ধী এক বিশেষ ধারণা। এই ধারণা একাধারে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতির। নিম্নবর্গের মধ্যকার জাগতিক ধারণা যে আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হয়, তা-ই তাকে সমাবেশের একজন হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আর আধ্যাত্মিকতার ধারণা তাকে অসাধ্য সাধনের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলে ঔপনিবেশিক আমলের সব আন্দোলনকে বা সমাবেশকে দেখি অসফল হতে। নেতার প্রতি আধ্যাত্মিকতার ধারণা তৈরি হয় রাষ্ট্রের প্রধান বা সরকারকে প্রভুজ্ঞান করার কারণে। রাষ্ট্রের যিনি সর্বেসর্বা সেই প্রভুশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হলে মানুষের ক্ষমতা দ্বারা তা সম্ভব নয়, তাই তাদের এই অসাধ্যতার ধারণা থেকেই তাদের মধ্যে নেতাদের প্রতি আধ্যাত্মিক শক্তির ধারণা কল্পিত হয়। ঐতিহাসিক গবেষকরা নিম্নবর্গের ইতিহাস ও রাজনৈতিক চৈতন্যের মধ্যে এই বিশেষ লক্ষণ পরিস্ফুট হতে দেখেন। একে তারা বলেন ধর্মভাব। যার কারণে সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসে বিদ্রোহের নেতা সিদো ও কানহু নিজের লড়াইটাকে আখ্যা দিয়েছেন ঠাকুরের লড়াই হিসেবে। অর্থাৎ ইংরেজের সঙ্গে সাঁওতালদের লড়াই হচ্ছে ইংরেজদের সঙ্গে ঠাকুরের লড়াই।
এর কারণ, সাধারণ নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের ক্ষমতাকে চিনতে পারছে না। তাই তারা একে ঐশ্বরিক বলে কল্পনা করছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ক্ষমতার পিরামিডের তলায় যারা একেবারেই মাটির কাছাকাছি সেই নিম্নবর্গের কাছে পিরামিডের শীর্ষস্থ রাজশক্তিকে দেবশক্তি বলে মনে হয়। আর এ কারণে ভারতবর্ষের নিম্নবর্গের অনেক বিদ্রোহ বা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে রাজশক্তির দোহাই দিয়ে তার অধীনস্থ ফৌজের বিরুদ্ধে বা স্থানীয় প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। এ রকমটা কেবল ভারতবর্ষেই ঘটেছে, তা নয়। এ রকম রাশিয়াতেও দেখা গেছে। জারের কসাক বাহিনীর হামলার শিকার সাধারণ মানুষ জারের কাছেই সুবিচার প্রার্থনা করে এবং জারের নাম নিয়েই বিদ্রোহ করে। 
কিন্তু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পর্বের ইতিহাসে যেসব নিম্নবর্গের মানুষের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি, তারা তাদের ক্ষমতা যোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তা সত্ত্বেও ’৭১ পর্বে যে মুক্তির আন্দোলন, সেখানেও নিম্নবর্গের চেতনায় তাদের নেতার মধ্যে দেবতার মাহাত্ম্য ও আদর্শ কল্পনা করার প্রবণতা আমরা লক্ষ করি। লোককবি ভবা পাগলা তার গানে জগৎকান্ডারি ভগবানকে মুজিবের মধ্যে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তার গানে—
ভবা পাগলার অভিমান
আর কেন দেরী, শোন হে কান্ডারী
মুজিবরে হও অধিষ্ঠান। সুসন্তান তোমার নিয়াছে এ ভার
(আজি) ধরিতে বাংলার হাল।

লোককবির এই চেতনা নিম্নবর্গের সাধারণ চেতনারই অংশ। আরেক লোককবি তোরাব আলী শাহ চূড়ান্তভাবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে পৌরাণিক দেবতার মহিমায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি সত্যযুগের সত্যদাতা, তিনি ভব নদী পার করতে জয় বাংলা নৌকা ভাসিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, শ্রীকৃষ্ণ যেমন মোনমোহিনী হয়ে মথুরাবাসীর মন জয় করতে মথুরায় জন্ম নিয়েছেন, তেমনিভাবে মুজিবুরও মনমোহিনীরূপে জগতের মন ভরিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়াকে মুক্তি দিতে তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বাংলায় জন্ম নিয়েছেন। তিনি হলেন বিধির বিধাতা আর তাই বাংলার ব্যথা তিনিই বুঝতে পেরেছেন। 
লোককবি মোসলেম উদ্দিন বয়াতি বঙ্গবন্ধুকে দেখেন জিতেন্দ্রিয় পুরুষ হিসেবে, দেখেন নায়েবে রসুল হিসেবে। তিনি তাকে দেবতা ভীম ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ হিসেবেও দেখেন। তাতেও তার মন ভরে না অবশেষে তিনি তাঁকে সাক্ষাৎ ভগবান বলে ঘোষণা করেন। তার গানে—
জিতেন্দ্রিয় পুরুষ তুমি নায়েবে রছুল
ভাঙ্গিতে এসেছ তুমি বাঙ্গালীর ভুল
রুদ্র রূপে ভীম তুমি, শুদ্র রূপে কাম
জীবের মধ্যে সজীব তুমি, মুজিব তোমার নাম।
তুমি ইন্দ্র ও চন্দ্র, তুমি বরুণ সুরেন্দ্র
বীরেন্দ্র কুমার তুমি বীরেন্দ্র সন্তান।
... ...
তুমি পিতা তুমি ভ্রাতা তুমি বন্ধুবর
সর্বরূপী তুমি দয়াল শেখ মুজিবর।
তুমি দিবা তুমি নিশি, তুমি কান্না ও হাসি
তুমি আকাশের শশী, তুমি সাক্ষাৎ ভগবান।
যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বে প্রভু শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত নিম্নবর্গের সমাবেশের মধ্যে গণমানুষের চেতনার যে স্বরূপটি আমরা প্রকাশ হতে দেখি, এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্বীয় নেতার মধ্যে দেবত্বের আরোপকে তারা অসাধ্য সাধনের প্রচেষ্টা বলেই মনে করে। তবে এর একটি সমাজ মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। নিম্নবর্গের মানুষেরা যুগ যুগ ধরে যে শোষণ-নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে, সেখানে সে ন্যায়বিচার পায় না। সে তখন ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সে মনে করে এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে যখন ভগবান দুষ্টের দমন করবেন। মনে মনে তার ভেতরে যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কাজ করে তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে সে তার নেতাকে মুক্তিদাতা হিসেবে কল্পনা করে নেয়। আর এ কারণে তার পক্ষে স্বীয় নেতাকে বিধির বিধাতা, সাক্ষাৎ ভগবান, নায়েবে রছুল কোনো কিছুই বলতে বাধে না। এ কারণেই তথাকথিত ইতিহাসবিদরা নিম্নবর্গের মানুষের চেতনাকে স্বকীয়তাহীন বলে মনে করেন। ফলে আমাদের চর্চিত ইতিহাসবিদ্যায় তাদের ঠাঁই মেলে না। তবে এ কথা পরিষ্কার যে পূর্ব বাংলার আন্দোলনে অংশ নেওয়া জনসাধারণের চেতনা ঔপনিবেশিক আমলের নিম্নবর্গের চেতনার অনুসারী নয়। আর এ কারণেই এ দেশের সাধারণ মানুষ তাদের নেতাকে যতই অলৌকিক শক্তির আধার বলে মনে করুক না কেন, তারা বাস্তবিকভাবেই ছিল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অধিকারী। অসাধ্যকে সাধনের অলীক কল্পনা দ্বারা তারা তাড়িত হয়নি। যেখানে নিম্নবর্গের মানুষের আন্দোলন আইনসিদ্ধ পথে এগিয়ে প্রয়োজনে বেআইনি পথ ধরে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, সেখানে পূর্ববঙ্গের গণ-আন্দোলন আইন ভঙ্গের মধ্যে লিপ্ত না হয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষাকে তাৎপর্যপূর্ণ ও অধিক শক্তিশালীরূপে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। এ যাবৎকালে সংঘটিত নিম্নবর্গের আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চৈতন্যের স্তর ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যে বিস্তর অমিল ছিল, ছিল আদর্শের অমিল ও পারস্পরিক বিরোধ। কিন্তু ’৭১ পর্বের আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষের চৈতন্যের স্তর, বাস্তব অভিজ্ঞতা আদর্শের চেহারা সব ক্ষেত্রেই ছিল সমন্বয়ের চিত্র। শত্রুর প্রতি তাদের বিরোধিতা কখনো স্বীয় নেতার প্রতি আনুগত্যকে ছাড়িয়ে যায়নি। আর তাই মুক্তির আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা নিম্নবর্গের মানুষের রাজনীতির মৌলিকতার সঙ্গে ঔপনিবেশিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিম্নবর্গের মানুষের রাজনীতির মৌলিকতার পার্থক্য রয়েছে। কারণ, তাদের নেতা তাদের মধ্যে জাগ্রত করেছিলেন রাজনৈতিক অধিকার বোধ। তিনি একা ‘ছয় দফা’র মর্মার্থ জনগণকে বোঝাতে ছুটে বেড়িয়েছেন নগর থেকে বন্দরে, শহর থেকে গ্রামে। পূর্ব বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে তার পায়ের ছাপ পড়েছে ছয় দফা দাবির গুরুত্ব জনগণকে বোঝাতে গিয়ে, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। আর তার সঙ্গে পা মিলিয়ে, তার চৈতন্যের সঙ্গে নিজেদের চিন্তাকে মিলিয়ে বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ হয়ে উঠেছে যথার্থরূপে মুজিবের অনুসারী, অধিকার সচেতন ‘গণমানুষ’। তাই তাদের কল্পনায় কোনো অলীক রাষ্ট্রের ধারণা কাজ করেনি কিংবা ধর্মভাব দিয়েও তাদের চেতনা আচ্ছন্ন হয়নি। তাই লোককবি অকপটে বলতে পারেন—
কেবা হিন্দু কেবা মুসলিম এই কথা যাও ভুলি
জন্মগত হিন্দু মুসলিম জাতে হই বাঙালি
বিভেদ চলবে না চলবে না 
মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না। 
ঔপনিবেশিক আমল থেকে ভারতবর্ষে যত আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে এই একটি আন্দোলনই সফল ও সার্থক হয়েছে। কারণ, অন্য সব আন্দোলনের নেতা তাদের কর্মীদের, জনসাধারণকে অজ্ঞতার মধ্যে রেখে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাদের যথার্থ রাজনৈতিক অধিকার সচেতন করে তুলতে পারেননি। আর তাই তাদের চেতনার একটি বড় অংশ অলীক কল্পনা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়েছিল, যার কারণে তারা তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে ধন্দে ভুগেছে। দ্বিধাদ্বন্দের কারণেই তাদের বিদ্রোহ বা আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বাঙালির এটা সৌভাগ্য যে তারা নিজেদের জন্য এমন এক নেতা পেয়েছিল, যিনি তার দেশের জনগণকে তাদের নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অবহিত করেন। ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা নয় বরং বাঙালির জীবনে সৃষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমূলে বিনষ্ট করার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। এ কারণেই প্রথাগতভাবে নিম্নবর্গের যে ইতিহাস-চেতনা যে রাজনৈতিক-চেতনা তা থেকে বাঙালির গণমানুষের ইতিহাস-চেতনা ও রাজনৈতিক-চেতনা একেবারেই আলাদা।