যে কারণে ধস নেমেছে দেশের চামড়া শিল্পে

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০১৯, ০৮:২৩ এএম যে কারণে ধস নেমেছে দেশের চামড়া শিল্পে
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ- ছবি: জাগরণ

বর্তমানে ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে দেশের চামড়া শিল্প। রপ্তানি অব্যাহতভবে কমছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।  ২০১৭ সালে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের হেমায়াতেপুরে স্থানান্তর হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) শতভাগ ফাংশনাল না হওয়ায় এখনো একটি কারখানাও কমপ্লায়েন্স সনদ পায়নি। ফলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো। পাশাপাশি আর্টিফিশিয়াল লেদারের কারণে বিশ্ববাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদাও কমছে। সবমিলিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে চামড়া শিল্প। দৈনিক জাগরণের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় চামড়া শিল্পের সঙ্কটের বিষয়গুলো তুলে ধরেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ।

শাহীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ববাজারের পরিমাণ প্রায় আড়াইশ বিলিয়ন ডলারের। এ বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সামান্য। গত কয়েক বছরে এটি আরও সঙ্কুচিত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও আমরা ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও গত অর্থবছরে তা ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ রপ্তানি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, ট্যানারি শিপমেন্টের কারণে কমপ্লায়েন্স জটিলতা এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের কারণেই রপ্তানি কমে এসেছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে আর্টিফিশিয়াল লেদারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। এগুলো একদিকে ফ্যাশনেবল অন্যদিকে দাম কম। ১০ ডলারে তারা একটি স্নিকার কিনে কয়েক মাস ব্যবহার করেই ফেলে দিতে পারে। আবার নতুন ডিজাইনের স্নিকার কেনে। কিন্তু চামড়ার একটি স্যান্ডেল কিনতে খরচ করতে হয় ১০০ ডলার। এভাবেই চামড়ার জায়গা দখল করে নিচ্ছে আর্টিফিশিয়াল লেদার।

কমপ্লায়েন্স ইস্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে বড় ব্র্যান্ডগুলো মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় চীনের নন-ব্র্যান্ড ক্রেতারা আমাদের চামড়া কিনছেন। আমাদের চামড়ার ৩৫ শতাংশই এখন এভাবে চীনে যাচ্ছে। কিন্তু চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীনের ফিনিশড পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে গেছে। ফলে সেখানকার ব্র্যান্ডগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে তারা আমাদের কাছ থেকে চামড়া কেনা কমিয়ে দিয়েছে। আবার আমাদের বড় ব্র্যান্ডগুলো মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় চীনের ব্র্যান্ডগুলো খুব কম দামে আমাদের ফিনিশড চামড়া কিনতে চায়। বাধ্য হয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে আমরা এক রকম বাধ্য হচ্ছি। ফলে ডলারের হিসাবে রপ্তানি কমে গেছে।

সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে ট্যানারি এসোসিয়েশনের এই প্রেসিডেন্ট বলেন, সাভারে এরইমধ্যেই সব ট্যানারি চলে গেছে। বিসিকের তথ্যানুযায়ী, ১২৩টি ট্যানারিতে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিইটিপি নির্মাণের ৯৭ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। ৪টি মডিউলই চালু করা হয়েছে। কমপ্লায়েন্স শর্ত পূরণের জন্যই আমাদের সাভারে যাওয়া। ২০১৭ সালে হাজারিবাগ থেকে জোর করে আমাদের ওখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এখনো সিইটিপি শতভাগ ফাংশনাল নয়। তাহলে এই ২ বছরে আমাদের যা ক্ষতি হলো তার দায় কে নেবে?

তিনি আরও বলেন, সিইটিপি শতভাগ ফাংশনাল না হওয়ায় কোনো ট্যানারি লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডি­উজি) ছাড়পত্র পায়নি। ফলে কমপ্লায়েন্ট ব্র্যান্ডগুলো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইতালি, সাউথ কোরিয়া, জাপানের বড় বড় ব্র্যান্ড আমাদের ফিনিশড চামড়া কিনত। এখন তারা কিনছে না। আর একবার মুখ ফিরিয়ে নেয়া ক্রেতাকে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। তবু আমরা আশাবাদী। কারণ তারাও তো ব্যবসায়ী। সারাবিশ্ব ঘুরে ঘুরেই তারা পণ্য সোর্সিং করেন। যেখানে সুবিধা পাবে সেখান থেকেই তারা কিনবেন। তারা বাংলাদেশে ফিরে আসবেন বলে আমরা আশাবাদী।

ব্যাংক ঋণের অভিযোগের বিষয়ে বিটিএ এর এই সভাপতি বলেন, এই ট্যানারি শিপমেন্ট নিয়ে আমাদের সর্বশান্ত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। একদিকে রপ্তানি আয় কমে গেছে। অন্যদিকে নতুন জায়গায় ট্যানারি স্থাপন করতে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ হচ্ছে। ২০১৭ সালে হাজারিবাগে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও সাভারে এখনো সবাই উৎপাদনে যেতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ১২০টি ট্যানারি উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে। এই অবস্থায় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ট্যানারি শিপমেন্টে আমরা নিজেদের পকেট থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছি। অথচ চামড়া শিল্পনগরীতে প্লটের লিজ ডিড আমরা এখনো হাতে পাইনি। ফলে নতুন করে ঋণও নিতে পারছি না। 

শাহীন আহমেদ বলেন, ৩০টি ট্যানারি বন্ডের সুবিধা নিয়ে কেমিক্যাল আমদানি করে, নন-বন্ডেড ট্যানারি রয়েছে আরও ১২০টি। এছাড়া ৩০০ জন কমার্সিয়াল এক্সপোর্টার রয়েছে। তারা এই শুল্ক সুবিধা পায় না। এতে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। আমরা এনবিআরের কাছে আবেদন করেছি, ৪০টি ডেডিকেটেড রাসায়নিক রয়েছে, এগুলো শুধু ট্যানারিতেই ব্যবহার হয়। এগুলোর শুল্ক কমিয়ে দিলেই এই বৈষম্য অনেকটা কমে আসবে।

এআই/একেএস/টিএফ

আরও সংবাদ