বাংলাদেশের ব্যাংক খাত 

সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস!

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ৬, ২০১৯, ০৪:২৭ পিএম সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস!

অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক একটি দেশের প্রধান চালিকাশক্তি। দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল ও কার্যকর রাখতে ব্যাংকের ভূমিকা অপরিসীম। ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় সঞ্চয়, লেনদেন ইত্যাদির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে এ প্রতিষ্ঠান। আর্থিক এ প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের সঞ্চয় সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই পুঁজি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য করে। অর্থনীতিতে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা থাকলেও আমাদের দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে বিশাল খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে ধুঁকছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে পূর্বাপর সরকারগুলোর তরফ থেকে বিভিন্ন সময় নানারকম তোড়জোড় শোনা গেছে এবং সে অনুযায়ী তারা উদ্যোগও নিয়েছে; কিন্তু যে লাউ সেই কদু। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। 

বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনীতির গতি চাঙা হয়েছে, প্রবৃদ্ধির হার ৭ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশের বেশি হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এত সব সুসংবাদের মধ্যেও বড় দুঃসংবাদ হলো ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কিছু ঋণখেলাপি নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুটপাট করে চলেছে। এ কারণে নতুন সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েই আ হ ম মুস্তফা কামাল ঋণখেলাপিদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তখন তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে ‘আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না, বরং কমবে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। 

অর্থমন্ত্রীর এসব বক্তব্য-বিবৃতির পরও সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠিত ঋণ যাতে নতুন করে পুনঃতফসিলের সুবিধা পায়, তারই আয়োজনে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে সরকারকে! খেলাপি ঋণের হিসাবায়নে শিথিলতা এবং পুনঃতফসিলে ডাউন পেমেন্ট কমানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ অস্বাভাবিক সুযোগ শুধু বৃহৎ ও দীর্ঘকালীন খেলাপিদের জন্য। ব্যাংকের ঋণ প্রদান, আদায়, খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ-- এসবই ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের নিরিখে নির্ণয় হওয়ার কথা এবং তা হয়েও থাকে ছোট ও মাঝারি ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে। তবে ব্যত্যয় ঘটছে শুধু গুটিকয়েক বৃহৎ ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে। 

যারা ব্যাংকের ভালো গ্রাহক, যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন-- তাদের শিল্পঋণে সুদের হার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ এবং চক্রবৃদ্ধি হারে তা নেয়া হয়। অথচ যারা ঋণখেলাপি-- তাদের ঋণ পুনঃতফসিলে ৭ শতাংশ সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও আবার সরল সুদে। এ ছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবে ১৫ বছর। এর মধ্যে ২ বছর কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। আবার মাত্র ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনঃতফসিল করা যাবে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। শুধু গত বছরই পুনঃতফসিল করা হয় ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণা সম্ভবত এসব দীর্ঘস্থায়ী খেলাপিকে পুনর্বাসনের জন্য। বিষয়টি কতটা নৈতিক, কতটা বাস্তবসম্মত-- তা জনগণই ভবিষ্যতে বিচার করবে।

ব্যাংকে খেলাপি ঋণ
খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য এখন প্রধান সমস্যা। এ ঋণ জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পরও সরকারের হুঁশ হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যেখানে ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৮ সাল শেষে এই ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপন করা ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। এটি ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের মারাত্মক ঘাটতিরই নির্দেশ করে। সরকারের মন্ত্রীরা মাঝে-মধ্যে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করলেও, কার্যকর তেমন কিছুই হয় না। ভবিষ্যতে যে কিছু হবে, তারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এসব ঋণের ৪০ শতাংশই আটকা পড়ে আছে শীর্ষ কয়েক ঋণখেলাপির কাছে। প্রতিটি ব্যাংকে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটকা পড়ে আছে ৩২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এ সময় ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে রয়েছে। কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের এসব অর্থ বিদেশে পাচারও করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ব্যবসায়ীরাই এখন ঠিক করেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে কারা আসবেন। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় সময়ই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকে।

প্রতিবেশী ভারতের ৩০ শীর্ষ কোম্পানির কাছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি খেলাপি ঋণ (প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা) আটকে পড়ার পটভূমিতে তা মোকাবিলায় প্রথমে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ এবং পরে লোকসভা একটি আইন পাস করে। এ ধরনের পদক্ষেপ কি আমরা বিবেচনা করতে পারি না! অবশ্য এজন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দরকার সরকারের দৃঢ় মনোবলের। ঋণখেলাপিদের রাজনৈতিক খুঁটির জোর যেখানে সুবিদিত, সেখানে সরকারের মনোভাব আদৌ বদলাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সরকার যদি জনগণের গচ্ছিত আমানতের নিরাপত্তা বিধান এবং ব্যাংকিং খাতকে জাতির রক্ত সঞ্চালনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে, তা হলে রাষ্ট্রের বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র ও অনিয়ম
দেশের ব্যাংকিং খাতের উদ্যোক্তারা এখন পুঁজি ছাড়াই ব্যবসা করেন। কোনো কোনো উদ্যোক্তা এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। কেউ কেউ তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের চেয়ে জ্যামিতিক হারে কয়েকগুণ বেশি ঋণ নিয়েছেন। যাদেরকে মালিক বলা হচ্ছে, পুরো ব্যাংকিং খাতে তাদের অনেকের একটি টাকাও নেই। বরং পরিচালক পরিচয়ে আমানতকারীদের জমানো টাকা থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা তারা ইতিমধ্যে সরিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে পরিচালকদের বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। একই সময় পরিচালকরা ব্যাংক খাত থেকে ঋণ হিসেবে তুলে নিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এছাড়াও পরিচালকরা আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কারও নামেও ঋণ নিয়েছেন প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এভাবে পরিচালকদের অনেকেই এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যারা উদ্যোক্তা, তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত। 

২০১৮ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে এক পরিবারের দুজনের পরিবর্তে চারজন সদস্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পারিবারিক কর্তৃত্ব আরও সংহত করা হয়েছে। আরও বেশি সময় পদ ধরে রাখারও সুযোগ পাবেন তারা। টানা দুই মেয়াদে ৬ বছরের বদলে কোনো কোনো পরিচালক টানা তিন মেয়াদে ৯ বছর পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একই পরিবারের বহু ব্যাংকের মালিকানা। ঝুঁকির এ ধরনের নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনে এ ধরনের পরিবর্তন তাদের ভাষায় ব্যাংকিং খাতে লুটপাট এবং চরম অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করতে পারে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে ২২ পরিবার নামে পরিচিত ছিল কতিপয় ধনী-- যাদের কাছে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত ছিল এবং তারা প্রত্যেকেই ব্যাংকের মালিক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালিরা সেই ২২ পরিবারের বিরোধিতা করেছিল। এখন কি আবার ২২ পরিবারতন্ত্রে ফিরে গেলে ভালো হবে?’

এ খাত খেলাপি ঋণভারে নুয়ে পড়া এবং অনিয়ম ও বিচারহীনতায় নিমজ্জিত; লাগামহীন লুটপাটে টলটলায়মান। এ অবস্থায় যেখানে ব্যাংকগুলোকে শৃঙ্খলায় আনা দরকার, সেখানে ব্যাংকের মালিকদের চাপের মুখে আরও ছাড় দিচ্ছেন নতুন অর্থমন্ত্রী। ছাড়ের তালিকায় রয়েছে : ১. ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ বা ক্যাশ রিজার্ভ রেসিও (সিআরআর) সাড়ে ৬ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা, ২. সরকারি আমানতের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বেসরকারি খাতের ব্যাংকে প্রদান এবং ৩. বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে প্রদত্ত সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা। উল্লেখ্য, ব্যাংকগুলোর আমানতের সাড়ে ৬ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা রাখার বিধান বলবৎ ছিল। সরকারি আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার প্রবিধান ছিল। সরকারি আমানতের সংরক্ষণ ছাড়া অন্য সব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নেওয়ার কথা। এসব সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা তাই যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। এবার দেখা যাক, সাম্প্রতিক সুবিধাগুলো আদৌ খেলাপি ঋণ কমাতে পারবে কিনা, অথবা ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে?

ব্যাংকে হরিলুট
বিচার না হওয়ায় নামে-বেনামে ঋণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতা।  ফলে বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণ। দশম জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম বলেছিলেন, “২০১৭ সালে ব্যাংক খাত নড়বড়ে অবস্থায় পড়েছে। ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২০টিতে আর্থিক অবস্থা ছিল দৃশ্যমানভাবে খারাপ। অন্য ব্যাংকগুলোতেও কম-বেশি সুশাসনের অভাব। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে মারাত্মকভাবে। নামে-বেনামে ইচ্ছামতো ঋণ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক, নির্বাহী, বড় কর্মকর্তারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত।” ব্যাংকে লুটপাটের আরেকটি চিত্র প্রকাশ করেছিল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে গত ১০ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে জানায় তারা। রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমাদের করণীয় কী’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার খালেদ এ সম্পর্কে বলেন, ‘‘২০১০ সাল থেকেই আমরা ব্যাংকিং খাতে লুটপাট দেখতে পাই। বেসিক ব্যাংকের মতো একটি ব্যাংক খালি হয়ে গেল, অথচ চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না। আসলে ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবে। আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে বেশি হয়েছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখার দায়িত্ব হলেও, ব্যাংকিং আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত-পা বাঁধা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ক্ষমতা নেই। সুতরাং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া ব্যাংক লুটপাট বন্ধ করা যাবে না।” আসলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস ছাড়া আর কিছু নয়!

ব্যাংকব্যবস্থা নিয়ে ইদানীং যেসব আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে যেমন যুক্ত, একই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জবাবদিহিতার সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেকসই ও শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সম্প্রতি নেয়া নানা পদক্ষেপ আসলে কতটুকু ব্যাংকব্যবস্থার সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য, আর কতটুকু নিছক গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য--  সে সব বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। 

ব্যাংকে ঋণ অবলোপন
পাওনা আদায়ের জন্য সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করার পরও যদি দেখা যায় আদায়ের সব পথ রুদ্ধ, তা হলে সেই পাওনা অবলোপন করা যায়--  এটি বিশ্বব্যাপী হিসাববিজ্ঞানের স্বীকৃত একটি পন্থা। এ ব্যবস্থার দুটি উদ্দেশ্য থাকে : একটি অবশ্যই স্থিতিপত্র বা ব্যালেন্স শিটকে অনাদায়ী পাওনার ভারমুক্ত করা; অন্যটি অনাদায়ী পাওনার বিপরীতে আয়কর রেয়াত পাওয়া। কারণ, ঋণ অবলোপন করা ব্যবসায়িক লোকসান; এ লোকসানের বিপরীতে আয়কর প্রযোজ্য হয় না। তবে পরবর্তী সময়ে অবলোপন করা পাওনা যদি আংশিকভাবেও আদায় করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে আয়কর প্রযোজ্য হয়। ব্যালেন্স শিটকে নির্ভার রাখতেই অন্য সব ব্যবসার মতো ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের বিধান করা। উল্লেখ্য, ২০০২ সালের আগে মন্দ ঋণ অবলোপন করার কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা ছিল না। ২০০২ সালে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের অনাদায়ী মন্দ ঋণের ‘রাইট-অফ’ বা ঋণ অবলোপন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃক ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ‘রাইট-অফ’ করা হয়েছে। 

অবলোপন শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঋণ মওকুফের বিষয়টি সামনে চলে আসে। অনেকেই মনে করেন, ঋণ অবলোপনের অর্থ হচ্ছে, ঋণের দাবি ত্যাগ করা বা ঋণ মওকুফ করে দেয়া। আসলে এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। ঋণ অবলোপনের অর্থ কোনোভাবেই ঋণের দাবি ত্যাগ করা নয়, শুধু সংশ্লিষ্ট ঋণের হিসাব ব্যাংকের মূল লেজার থেকে আলাদা করে অন্যত্র সংরক্ষণ করাকে বুঝায়। অর্থাৎ অবলোপনকৃত ঋণ বিদ্যমান, কিন্তু দৃশ্যমান নয়। এটাকে অদৃশ্য খেলাপি ঋণও বলা যেতে পারে। 

ঋণ হিসাব অবলোপন আসলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণার শামিল। কারণ অবলোপনের জন্য খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন একটা অবহিত নন-- তারা জানতে পারছেন না। খেলাপি ঋণ হিসাবধারী, যারা সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে রয়েছেন-- তাদের জন্য এ ব্যবস্থা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক। তারাও ঋণ হিসাব অবলোপনের কারণে সমাজে নিজেদের কিছুটা হলেও ক্লিন হিসেবে প্রদর্শন করতে পারেন। প্রচলিত ব্যাংকিং নীতিমালাই তাদের সে সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হন লভ্যাংশ থেকে। 

প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ অবলোপনবিষয়ক নিয়মটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ এটা ব্যাংকিংব্যবস্থার জন্য কোনো সুফল বয়ে আনছে না। বরং খেলাপি ঋণ আদায়ের কার্যক্রমকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমাদের দেশের ব্যাংকিংব্যবস্থার সবচেয়ে দুর্বলতম দিক হচ্ছে, এখানে যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারী-- তাদের বিশেষ  কোনো আর্থিক সুবিধা দেয়া হয় না বা হচ্ছে না। কিন্তু যারা দিনের পর দিন ইচ্ছে করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হতে বিরত থাকেন, তাদের নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এতে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। অন্যদিকে নানাভাবে ঋণখেলাপিদের আর্থিক প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে। ফলে তারা ঋণের টাকা বা কিস্তি আটকে রাখার ক্ষেত্রে প্রণোদিত হচ্ছেন।
 
ঋণ মওকুফ সংস্কৃতি
শুধু ঋণ অবলোপনই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাংকিং খাতে সুদ মওকুফেরও হিড়িক পড়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক তদবিরে বড় অংকের সুদ মওকুফ করে দিচ্ছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানানুযায়ী, গত এক বছরে (২০১৭ সালে) ব্যাংক খাতে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এর আগের বছরের (২০১৬) সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল ৭৬৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে সোনালী ব্যাংক ২ হাজার ৪৪৬ কোটি, জনতা ব্যাংক ৩ হাজার ৩৩৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার ৯৮৪ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৭১৫ কোটি, বেসিক ব্যাংক ৬৮ কোটি ৫৬ লাখ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ২৪৩ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৩৮৬ কোটি ৪৭ লাখ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৯৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো কোটি কোটি টাকার সুদ মওকুফ করলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিন্তু তেমন কমছে না।

ঋণ আদায়ে আইন
অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে এবং যাচ্ছে লুটেরাদের পকেটে। ভুয়া এফডিআরের কাগজপত্র জমা দিয়ে, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা হয়ে, এমনকি জাল দলিলেও অনুমোদন হয়েছে মোটা অঙ্কের ঋণ। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে তারা লোপাট করে চলেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলো দৃশ্যত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও তা নিছক লোকদেখানো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আলোচিত একটি ব্যাংক কেলেঙ্কারিরও বিচার হয়নি। সাজা পায়নি অভিযুক্তদের কেউ। প্রায় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাড় দেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর মামলা চলছে। কিন্তু সুরাহা হচ্ছে না কোনো ঘটনার। আইনের ফাঁকফোকর এত বেশি যে, ৫-১০ বছরেও কোনো মামলার রায় আসে না। 

যে আশা নিয়ে অর্থঋণ আদালত ২০০৩ প্রণীত হয়, বাস্তবে সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। এর অন্যতম একটি কারণ হলো, আদালতের প্রায় প্রতিটি আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় রিট পিটিশন দাখিল করা। হাইকোর্টে হাজার হাজার মামলার চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত আসতে কয়েক বছর সময় লেগে যাচ্ছে। অথচ একেকটি মামলার অধীনে সাত-আটটি রিট পিটিশনও দাখিল করতে দেখা যায়। রিট করা রিটকারীর মৌলিক অধিকার। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের অধিকার জলাঞ্জলি দিয়ে একজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে মহৎ না বলে অপচেষ্টা বলাই এক্ষেত্রে শ্রেয়। একজন ঋণখেলাপি ১০০ কোটি টাকা ফেরত না দেয়ার মানসে নানা ধানাই-পানাইয়ের অংশ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার রক্ষার নামে ১৬ কোটি মানুষের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করতে যখন উদ্যত হন-- তার এ চেষ্টা জনস্বার্থবিরোধী তো বটেই, বরং উচ্চ আদালতকে নিজের অপরাধ থেকে রেহাই পাওয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আদালতের পবিত্রতায় কালিমা লেপন করার নামান্তর। দেশে অর্থ ঋণ আদালতে রুজু করা মামলার প্রায় ৯৫ শতাংশ রিট পিটিশনের কারণে অচল হয়ে পড়ে আছে। আইনের ফাঁকফোকর বা ছিদ্র বন্ধ করতে না পারলে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের কোনো এক সময় ধসে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

পুঁজি পুনঃকরণের নামে লোপাট
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি নয়টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। তাই পুনঃমূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ করা এডিপির ১৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ করের টাকা দিয়ে বিসমিল্লাহ, হল-মার্ক, এননটেক্সসহ অন্যান্য ব্যাংক লুটকারীর ভরণপোষণ করা হচ্ছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। লুটকারীদের যাদের জেলে নেওয়া হয়েছে, তাদের আয়েশি জীবনচিত্র পত্রিকান্তরেই দেখা যাচ্ছে। দেশে বিচারহীনতার এর চেয়ে বড় আর কী দৃষ্টান্ত হতে পারে!

জবাবদিহিতার অভাব 
একদিকে জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটানো হচ্ছে; অন্যদিকে ব্যাংক ব্যবসা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা না করেই একর পর এক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অর্থ নিয়ে বড় ও ক্ষেত্রবিশেষে মাঝারি গ্রাহকদের ফেরত দেয়ার অনীহা বাংলাদেশ তথা অনেক দেশেই লক্ষণীয়। সে কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ে। ব্যাংকব্যবস্থায় আজকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। সন্দেহ নেই, রাজনৈতিকভাবেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। এক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার কোনো বিকল্প নেই। 

সর্বোপরি, গোড়ায় গলদ রেখে কোনো কিছু সমাধান করার প্রয়াস সাময়িকভাবে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা চরম ক্ষতির সম্মুখীন করে। মনে রাখতে হবে, শর্তহীনভাবে পুনঃপুঁজিকরণ প্রক্রিয়া ব্যাংক রুগ্ন হওয়ার অন্যতম কারণ। সুতরাং শেয়ার মার্কেটের ধসের মতো ব্যাংকিং খাতে যাতে সুনামি না আসে, তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। মোট কথা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈপ্লবিক সংস্কার না ঘটা, সুশাসন এবং চরম জবাবদিহিতা না আনা পর্যন্ত এ আর্থিক খাতের রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না।


লেখক : সাংবাদিক