নিমতলী ট্র্যাজেডি ও বর্তমান বাস্তবতা

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ৩, ২০১৯, ০৩:২৪ পিএম নিমতলী ট্র্যাজেডি ও বর্তমান বাস্তবতা

২০১০ সালের ৩ জুন ঢাকার নিমতলীতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। সেই অগ্নিকাণ্ডে পাবক হয়ে সব কিছু পবিত্র করেনি, বরং অনলশিখায় ছারখার করেছে মানুষের স্বপ্ন। সেদিন ওই অগ্নিকাণ্ডে সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১২৪। ওই দুর্ঘটনায় সম্পদেরআর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল এক কোটি ৬৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, এটা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। নিমতলীর ঘটনা স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিট ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর বার্ন ইনজুরিস দিনটিকে ‘অগ্নি সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। নিমতলীর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, আগুনে পোড়া মানুষের বাস্তবেসম্বল বলে কিছুই থাকে না। এ জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিমতলী ট্র্যাজেডিতে আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া তিন কন্যা উম্মে ফারওয়া আক্তার রুনা, সাকিনা আক্তার রত্না ও আসমা আক্তার শান্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নিজের কন্যা পরিচয়ে তিনি নিজেই
তাঁদের বিয়ে দেন। বর্তমানে নিয়মিত তাঁদের খোঁজখবরও রাখেন তিনি। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে এবং এটি তিন ঘণ্টারও বেশি সময় স্থায়ী হয়। ওই অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত একটি ভবনে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল এবং এ জন্য সেখানে ছিল অনেক অতিথির সমাগম। ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যায়।

পরের দিন শুক্রবার (৪ জুন) আসমা আক্তার শান্তার বিয়ের পান-চিনির অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। মেয়ের বিয়ের জন্য বাবা মুসলিম খান আড়াই ভরি ওজনের একটি সোনার নেকলেস তৈরি করেছিলেন। মায়ের ছিল সাড়ে চার ভরি সোনা। অলংকারগুলো সবই আগুনে গলে যায়।তাঁর মা আমেরি বেগম, নানি নূর বানু ও বড় ভাইয়ের মেয়ে রোকেয়া আক্তার আগুনে পুড়ে মারা যান। বাবা মুসলিম খানের শরীরের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে যায়। বড় বোনসহ পরিবারের আরো দুজন অগ্নিদগ্ধ হয়। নির্বাক আসমা আপনজনদের হারিয়ে যখন দিশাহারা তখন এগিয়ে আসেন মমতাময়ী শেখ হাসিনা। আসমার মতো ছিল হতভাগ্য রুনা-রত্নার জীবন। ওই সন্ধ্যায় আগুনে ছাই হয়ে যায় সাকিনা আক্তার রত্নার স্বপ্ন। ২২ জুন তাঁর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ৩ জুন সন্ধ্যায় নিমতলীর রত্নাদের বাসায় ছোট বোন রুনার বাগদান অনুষ্ঠানের সময় আগুনে ছাই হয়ে যায় সব কিছু। দুই বোন আর ভাই ফয়সল ছাড়া বাড়ির সবাই মারা যায়; রুনা-রত্নার পরিবারের ২১ জন নিহত হয়।

অগ্নিকাণ্ডের পর পরিবার-পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া রুনা, রত্না ও শান্তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপন করে নেন। ঘোষণা দেন, তাঁরা নিজের সন্তানের মতো তাঁর আপনজন। এর পরই গণভবনে নিজে উপস্থিত থেকে তাঁর তিন কন্যার বিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়েরা এখন ভালোই আছেন; তবে হারিয়ে যাওয়া মা, খালা, বোনদের কথা বারবার মনে হয়। তাঁদের হারানোর পর প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ হিসেবে পাওয়ার পর তাঁদের আর কোনো কষ্ট নেই।

বিয়ের সময় বিশ্বমানবতার নেত্রী রুনার স্বামীকে একটি চাকরি দেওয়ার কথাবলেছিলেন। সে অনুযায়ী তিনি নৌবাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন। আবার যখন কেউ দেখার ছিল না তখন গণভবনে রত্নার বিয়ের পর তাঁরস্বামীকে বেসিক ব্যাংকে চাকরি দেওয়া হয়। অন্যদিকে শান্তার স্বামীকে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। আপন মা যেমন জামাইবাড়ি গ্রীষ্মের ফল পাঠান, মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীও তাঁর তিন কন্যার বাসায় প্রতিবছর ফল পাঠান। সরাসরি বছরে একবার দেখা হলেও শত ব্যস্ততায় বিভিন্ন উৎসবে নিয়মিতই খোঁজ নেন তাঁদের।

অন্যদিকে নিমতলী ট্র্যাজেডির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল; তার সঙ্গেপ্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনার মিল-অমিল উভয়ই রয়েছে। ১৭ দফার উল্লেখযোগ্য দিক হলো—জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদামবা কারখানা সরিয়ে নেওয়া; অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া; রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবংবিক্রির জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা; ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা; আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন;

আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা; ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করা; রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা; দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা;দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন; রাসায়নিক ও রাসায়ানিক জাতীয় দাহ্য বস্তুরআলাদা দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন; সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো,জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো; অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উত্সুক জনতা উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো; পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলোবাধ্যতামূলক করা; ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা; কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র
রাখা প্রভৃতি।

এর মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো বাড়ানো হলেও এখনো এইসেক্টর অত্যাধুনিকভাবে গড়ে ওঠেনি বলেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা জরুরি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ওই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ,প্রকাশের পর একাধিক টিম রাজধানীর প্রতিটি ভবন পরিদর্শন করেছে। ভবনগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তামূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কি না, তা তারা দেখছে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিচ্ছে। অন্যদিকে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক পণ্যের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং নজরদারি বেড়েছে।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়