নারীর উন্নয়ন ও মস্তিষ্কের উপনিবেশ

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০১৯, ০৫:৩০ পিএম নারীর উন্নয়ন ও মস্তিষ্কের উপনিবেশ

অতীতের তুলনায় আমাদের দেশের নারীরা অনেক অগ্রসর। তারপরেও  বৈষম্য শেষ হয়েছে একথা বলা যাবে না। বহুদিনের লালিত বহু বিষয়ের সমাধান একবারে হবে এমন নয়। দেশের সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়ন এখন আর কল্পনার বিষয় নয়। বহুদূর এগিয়েছে অবরোধবাসিনী নারীরা।আসলে নারীদের সার্বিক পরিস্থিতি কতটা বদল  হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব একবারেই দেয়া যাবে। নারীদের আর ঘরে বসিয়ে রাখার দিন নেই। তারা এখন পুরুষের সমান কাজ করে এগিয়ে নিচ্ছে আমাদের দেশ ও সমাজকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরেউন্নয়নের যে ধারা চালু হয়েছে তাতে নারীপুরুষ উভয়েরই কর্মসংস্থান হয়েছে। তারমধ্যেও নারীদের উন্নয়ন লক্ষণীয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে  ৩৩% বেসরকারি চাকরি নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী করার কাজ করা হচ্ছে। এখন দেশের  এমন কোন সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত নেই যেখানে  নারীরা ক্ষমতার উচ্চাসনে বসা নেই। ভোরে রাস্তায় বের হলে দেখা যাবে, রাজধানীর সড়কে-জনপথে হাজার হাজার নারী হেঁটে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। তারপরওসমাজব্যবস্থা পুরুষশাসিত।

সুতরাং নারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর পুরুষের যে দৃষ্টি তা এত সহজে বদলানো সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবে নারীদের যেখানে পেছনেই রেখে দেয়া হয়েছিল সেখানে এত দ্রুত নারীর অধিকারকে নিশ্চিত করা না গেলেও আমাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে নারীরা এখন অনেক অগ্রসর যা ২০ বছর আগে ভাবাও যেত না। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীদের সমাজের সর্বস্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নিয়ে এসেছে।তবে এর মধ্যেও কিছু চিত্র আমাদের অপরাধী করে দেয়। সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্যের চিত্রগুলো তখন সজীব হয়ে উঠে। যা সত্যি কষ্টদায়ক। ধর্ষণের পরে হত্যা একটা ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। একই সাথে অনেক নৃশংসতার  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বহু নারকীয় ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। খাদিজা হত্যা প্রচেষ্টা, তনু হত্যাকাণ্ড বা নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনা আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের মানবিকতাকে বিক্ষত করে। বাসে ধর্ষণ করে হ্ত্যাপ্রবণতা আমাদের আতঙ্কিত করে। এমন এক একটি ঘটনার আমরা মুখোমুখি হচ্ছি যে, পুরানো ঘটনাগুলিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে এক একটি ঘটনা। কয়েকদিন আগে সাগর পাড়ের জেলা বরগুনা শহরে একটি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফ নামে এক তরুণকে বর্বরোচিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও চিত্র মানুষকে আহত করেছে, শঙ্কিত করেছে, দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছে।

কেমন করে দিনে দুপুরে  একটি মানুষকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা যায় এটা কারো মাথায় আসে না। মানুষ এত নৃশংস এতোটা বর্বর হয় কিভাবে?  এই হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, এক নারী তার স্বামীকে রক্ষার জন্য করার জন্য সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের সামনে গিয়ে  কি নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে । লোকজনকে ডাকছে। কোন সাড়া মিলছে না। তাকে সন্ত্রাসীরা ধাক্কাদিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে তারপরও সে  ধারালো অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।  সেখানে যতলোক মোবাইলে এটাকে ভিডিও করেছে তারা  গিয়ে
গেলে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি হয়তো ঠেকানো যেত। কিন্তু এখানে আরেকটি চিত্র আমাদের আরেক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রথম পর্বে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি শেয়ার করে এই হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেছে এক দল মানুষ।তার পরেই আবার  কিছু মানুষ নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকার  সাথে নয়ন বন্ডের  কয়েকটা ছবি  দিয়ে বোঝাতে চাইলেন এ ঘটনার কারণ পরকীয়া প্রেম। ধরে নিলাম এই আয়েশা সিদ্দিকী যিনি নিজের জীবন দিয়ে স্বামীকে বাঁচাতে চেয়েছেন  তিনি পরকীয়া প্রেমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । তার মানে যে করেই হোক মেয়েটিকে ভিকটিম করতে হবেই। যেকোন মেয়ে বা ছেলের এ ধরনের মৃত্যুর পর সবাই একজন নারীকে দায়ী করতে থাকেন। বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। সেখানে মনে হয় তারা হত্যাকারীকে বৈধতা দিচ্ছে। 

এবারে আমরা তিনটি বছর আগে ফিরে যাই। কুমিল্লায় ধর্ষণের পরে নিহত সোহাগী জাহান তনুর কথা মনে পড়বে সবার। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি। ২০১৬ সালের ২০শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ভেতরে তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পরই অভিযোগ ওঠে যে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম ময়না তদন্তে এরকম কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভের পর তনুর লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্ত করা হয়। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি।

তনু হত্যার পর কথা উঠেছিলো সে নাটক করতো, রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরতো তনু হিজাব না পড়লে হয়তো তার পোশাকেরও দোষ দেয়া হতো। প্রশ্ন হলো তনুকে কারা ধর্ষণ করে হত্যা করলো,বা বরগুনায় রিফাত শরীফকে করা হত্যা করলো বা সিলেটে খাদিজাকে হত্যা চেষ্টা যারা করে তাদের চেয়ে  বেশি দোষ মেয়েটার। তার চরিত্র খারাপ, পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো না ইত্যাদি। এভাবে  একটি মহল খুনির শাস্তির দাবিতে সোচ্চার না হয়ে মেয়েটার কুৎসা রটনায় তৎপর। নির্মম হলেও এটাই সমসাময়িক কালের প্রমাণিত সত্য যে, কোন বর্বরোচিত
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার পেছনে আমরা খুঁজে বেড়াই এক খণ্ড জমি নয়তো বা নারী ঘটিত কোন বিষয় । নির্দিষ্ট সময়ের পরেও সব আলোচনা বা কুৎসা হারিয়ে যায়। বিচারের বাণী তখন যদি নিভৃতে কাঁদে তখন কিন্তু কুৎসা রটনাকারীদের কোন নিশানা থাকে না। তাহলে এই কুৎসা রটনা কেন? 

সত্যিই কি নির্মম ঘটনা, কিছু না জেনেই একটা মেয়েকে বা নারীকে হেয় করার কত চেষ্টা আমরা দেখি সেটা অকল্পনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এটা কি একজন খুনি কে বাঁচানোর চেষ্ট না নারীর বিরোধিতা সেটা বোঝা দরকার। নতুবা যেকোন দুর্ঘটনার দিকে তাকালে আমরা দেখি আসলে নারীকে হেয় প্রতিপন্ন  করতে কত উদ্যোগ। কত কুৎসা, কত রটনা অর্থাৎ সরকার নারীর অধিকারকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও আমরা যেন একটি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে রয়ে গেছি। আমরা জানি না খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে । আকাশের বিশালতাকে দেখার মত মানসিকতাই  আমরা যেন হারিয়ে ফেলেছি।

নারী অধিকার নামে প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে অসংখ্য নারী এবং শিশু, নারী অধিকার নামে প্রতিদিন হরণ হচ্ছে আমাদের মা বোনদের সবটুকু অধিকার। এটাই কি আমাদের বিবেক? আমাদের জাগ্রত হতে হবে মানবতায়, ভালোবাসায় হৃদয়ের গহীন থেকে।এখনো আধুনিক সভ্যতার মানুষের কাতারে আমরা দাঁড়াতে পারিনি, আমাদের মানসিকতা আমাদের মস্তিষ্কের উপনিবেশ আরা বদলাতেপারিনি। বারট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব দ্য ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি’ বইয়ে মস্তিষ্কের উপনিবেশের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বোঝানো হয়েছে অনেক ছোটবেলা থেকে সমাজ-সামাজিকতা ও আচরণ যা কিছু দেখা হয়, শোনা হয় তা মস্তিষ্কে জমাট বাঁধে। ওটাই তার কাজকে প্রভাবিত করে। 

আমাদের মস্তিষ্কে পুরাতন কালের  বীজ রয়ে গেছে। পড়াশোনা ওই চিন্তা-চেতনাকে নাড়া দিতে পারেনি। ফলে আমরা জামা-কাপড় পরে ভদ্রলোক সাজলেও রয়ে গেছি নিয়ানডারথাল মানুষের যুগে। সে ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের উপনিবেশ ভাঙা না গেলে এ সংকট থেকে উত্তরণ দুরূহ ব্যাপার।  সমাজে নারী-পুরুষ কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ, প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে। তাদের সমর্থন যদি বর্বর খুনিদের পক্ষে যায়  কিংবা কোন বর্বর ঘটনার পক্ষ নেয় যায় তাহলে সামাজিক অবক্ষয়কে আমরা কোন প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি  সেটা ভাবনার বিষয়। 

এ ছাড়াও কোন তদন্তাধীন বিষয় সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া উচিত নয়, যা প্রকৃত ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিবে এবং অন্যদিকেপ্রভাবিত করবে। তাহলে সব অন্যায়কারী, খুনী ধর্ষক আমাদের পরিবারে জন্ম নিতে থাকবে। এই ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা বাড়তেই থাকবে। সরকারের এই অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে তৎপরতা বাড়ানোর এটাও এক ধরনের অপচেষ্টা। এসব পাষণ্ডদের দৃষ্টামূলক শাস্তি ও এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে প্রখ্যাত আইরিশ নাট্যকার আইজেন ইউনেস্কির গণ্ডারের মতো গণ্ডারে ভরে যাবে আমাদের সমাজ - সমকাল।

লেখক : সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের গৌরব

/ডিজি