ছাত্র রাজনীতি

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০১৯, ০৪:৫৩ পিএম ছাত্র রাজনীতি

১.
আবরারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আমাদের সবাইকে একটা বিশাল ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক রাগ দুঃখ হতাশা এবং ক্ষোভের পর্যায়টুকু শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা এখন তার পরের পর্যায়টুকু দেখতে পাচ্ছি যেখানে এই অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনাটি নিয়ে দেশে-বিদেশে অল্প বিস্তর রাজনীতি করা শুরু হয়েছে। সরকারও তাদের মুখ রকক্ষায় কাজ শুরু করেছে, যদিও তাদের জন্য কাজটি খুব সহজ নয়। 

আমরা সবাই জানি আবরারকে নির্যাতন থেকে রকক্ষা করার জন্য খবর পেয়ে পুলিশ এসেছিল কিন্তু যেহেতু তাকে নির্যাতন করছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মী তাই তারা দরকার হলে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও তাকে উদ্ধার করার সাহস পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম বয়সী কয়েক তরুণ ছাত্রের সামনে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন অসহায় দুর্বল কিছু মানুষ, তাদের চোখের সামনে অচিন্তনীয় নৃশংসতায় একটি হত্যাকান্ডঘটে যেতে পারে কিন্তু তারা কিছু করতে পারে না এটি মেনে নেয়া খুব কঠিন। বলা যেতে পারে ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপটি এবারে আমরা দেখতে পেয়েছি। 

খুব স্বাভাবিক কারণে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সারাদেশে আলাপ আলোচনা হচ্ছে, আমাদের দেশে এখন আসলেই ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সেটা নিয়ে সবাই কথা বলছেন। ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র রাজনীতি তুলে দেয়া হয়েছে’ এই ঘোষণা দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিনা সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমি একটুখানি অবাক হয়ে লক্ষ করছি ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আলাপ আলোচনা হলেও শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে সে রকম আলোচনা হয়নি যদিও সেটাও কম জরুরি একটা বিষয় নয়।

অনেকদিন পর আমি নিজেও আবার ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভাবছি, নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করছি সত্যিই কি বাপারটা এত সহজ?  শুধুমাত্র একটা ঘোষণা দিলেই রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যখন বয়স কম ছিল তখন সব প্রশ্নের উত্তর জানতাম আজকাল যে কোন বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে দ্বিধা হয়। তবে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্রিয়ার মাঝে থাকার কারণে ছাত্র রাজনীতির নানা ধরনের ঘটনা দেখেছি, সে রকম কয়েকটি ঘটনার কথা বলি তা হলে ছাত্র রাজনীতি কীভাবে কাজ করে হয়তো তার ধারণা পাওয়া যাবে!

ঘটনা : তখন বিএনপি-জামায়াত আমল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। আমি ভর্তি কমিটির সভাপতি, সব ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার হলে ঢুকেছে, বাইরের সব মানুষকে বের করে বিল্ডিংগুলোর মূল গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হলের বাইরে জনমানুষ নেই, ভেতরে মাত্র পরীক্ষার প্রশ্ন দেয়া হয়েছে। হঠাৎ করে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম একটি ছাত্র তার পিঠে একটা ব্যাগ নিয়ে গদাইলস্করি চালে হলরুমের বারান্দা দিয়ে হাঁটছে। আমি ছাত্রটিকে চিনতে পারলাম সে ছাত্র শিবিরের একজন নেতা, তার হাঁটার ভঙ্গিতে সবার জন্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট একটা মেসেজ। সেটি হচ্ছে : ‘এই দেখ, পরীকক্ষার হলে কারও ঢোকার কথা নয়, কিন্তু আমি শিবিরের নেতা, আমি ঢুকেছি এবং বুক ফুলিয়ে হাঁটছি। কারও সাধ্যি নেই আমাকে কিছু বলে!’

 আমি তার মেসেজকে থোড়াই পরোয়া করে হুঙ্কার  দিয়ে বললাম, ‘এই ছেলে! তুমি এখানে কীভাবে ঢুকেছ? বের হও! এক্ষুণি বের হও।’ আমি দারোয়ানকে ডেকে তাকে বের করে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মাঝে অসংখ্য ছাত্র শিবিরের কর্মী এসে আমাকে ঘিরে ফেলল, চিৎকার  করতে লাগল, আমি নাকি তাদের সভাপতিকে অপমান করেছি! হৈচৈই শুনে তখন অন্য অনেকে ছুটে এসে কোনোভাবে অবস্থাটা সামলে নিলেন। 

ঘটনার বিশ্লেষণ : এটি হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি করার একটা অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন। শুধু অন্য ছাত্রদের সামনে নয়, শিক্ষক কিংবা প্রশাসনের সামনেও!  সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যে কাজটি করার কথা কল্পনাও করতে পারবে না, ছাত্র রাজনীতি করা নেতা হলে তারা অবলীলায় সেটা করতে পারে সবার মাঝে এ রকম বিশ্বাস তৈরি করতে হয়।

ঘটনা : এটি কিছু দিন আগের একটি ঘটনা। ডিপার্টমেন্টের কোন একটি উৎসবে সারাদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসেছে এবং তাদের নিয়ে একটি সমাপনী অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানে একজন প্রতিমন্ত্রীও আমার সঙ্গে মঞ্চে বসে আছেন। অনুষ্ঠান চলছে তখন হঠাৎ করে শ্লোগান শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি অডিটরিয়ামের পেছন থেকে সারি বেঁধে দশ বারোজন ছাত্র আসছে। সবার সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি তার পোশাক যথেষ্ট রাজকীয় এবং মুখে নেতাসুলভ গাম্ভীর্য। 

এই সভাপতিকেই অভিনন্দন জানিয়ে শ্লোগান দেয়া হচ্ছে। দৃশ্যটি যথেষ্ট হাস্যকর কিন্তু শ্লোগানের কারণে যিনি বক্তব্য দিচ্ছিলেন তাকে থেমে যেতে হলো এবং দলটি এসে শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত স্থানগুলোতে গ্যাট হয়ে বসে গেল। তখন আবার  অনুষ্ঠান শুরু হলো। বলাই বাহুল্য,  ঘটনাটি যথেষ্ট দৃষ্টিকটু এবং আমি খুবই বিরক্ত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের ছাত্রনেতা থাকে সাধারণত আমি তাদের চিনি না। কিন্তু ঘটনাক্রমে এই সভাপতি আমার পরিচিত কাজেই বক্তব্য দেয়ার সময় আমি তার নাম ধরে তাকে সবার সামনে তার এই ঔদ্ধত্যের জন্য বিতৃষ্ণাটুকু প্রকাশ করে তাকে সেটা জানিয়ে দিলাম। অনুষ্ঠান শেষে প্রতিমন্ত্রী মহোদয় আমার থেকেও আরও অনেক কঠিন ভাষায় এই ছাত্রনেতাকে সতর্ক করে দিলেন।

ঘটনার বিশ্লেষণ : এটি ঠিক আগের ঘটনার মতোই, ছাত্র নেতারা বিশ্বাস করে যে কোন অনুষ্ঠানের মাঝখানে শ্লোগান দিতে দিতে ঢুকে যাওয়ার তাদের অধিকার আছে। শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে যাওয়া তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা কত গুরুত্বপূর্ণ এবং কত ক্ষমতাবান সেটা সবাইকে জানানোর জন্য তারা খুবই ব্যস্ত থাকে। 

ঘটনা : তখন জামায়াত-বিএনপি আমল। পয়লা বৈশাখের দিন ছাত্র- শিক্ষক মিলে একটা আনন্দ র‌্যালি করবে। তখন কয়েক ছাত্র আমাদের জানিয়ে দিল ছাত্রদলের একজন নেতার হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে। এই  র‌্যালিটির মাধ্যমে তারা বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে বিচার দাবি করার কাজটি শুরু করতে চায়। ছাত্রদলের নেতারা আশপাশেই আছে, কাজেই আমরাও যদি থাকি তারা হয়তো একটু নিরাপদ থাকবে। কাজেই আমরা র‌্যালিতে থাকলাম এবং একটি আনন্দ র‌্যালি দেখতে দেখতে একটি বিক্ষোভ র‌্যালিতে পাল্টে গেল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর খুবই স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রী বিশাল একটি প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলল। 

ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস ঘেরাও করে ধর্ষকদের বিচার করার দাবি করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল উত্তেজনা, অসংখ্য ছেলেমেয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস ঘেরাও করে বিচার দাবি করছে, দূরে ছাত্রদল এবং শিবিরের ছাত্ররা, কাছাকাছি একটা পুলিশের গাড়ি। 
হঠাৎ করে পুলিশের গাড়িটি ধীরে ধীরে সরে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝে ছাত্রদল ও শিবিরের দলটি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করল। যারা এই ধরনের আক্রমণ নিজের চোখে দেখেনি তাদের বিষয়টা বোঝানো খুব মুশকিল। ঘণ্টা দুয়েকের একটা ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের পর শেষ পর্যন্ত আবার পুলিশ ফিরে এলো এবং তখন ভাংচুর এবং তাণ্ডব থিতিয়ে এলো। ভেতরে আটকে থাকা ছাত্রীরা বের হতে পারল।

ঘটনার বিশ্লেষণ : আমার বিবেচনায় এই ঘটনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন ছাত্রনেতার হাতে ধর্ষিত হওয়ার পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা খুব দক্ষতার সঙ্গে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কাজেই যারা দাবি করে নেতা গড়ে তোলার জন্য ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন তাদের আমি জোর দিয়ে বলতে পারি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা ব্যবহার করার জন্য রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেই হবে সেটি সত্যি নয়। ছাত্র রাজনীতি না করেই একজন ছাত্র বা ছাত্রী কিভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করতে হয় সেটা শিখতে পারে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা শুধু যে খুবই দক্ষভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে তা নয়, তারা খুব সতর্ক থেকেছে যেন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের বিপদে পড়তে না হয় কিংবা আন্দোলনটা অন্যদিকে দিক হারিয়ে না ফেলে। শুধু তাই নয় কেউ যেন ধর্ষিতা মেয়েটির পরিচয় জানতে না পারে তারা সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করেছিল।

এই ঘটনার সময় আরও কয়েকটি বিষয় ঘটেছিল। ছাত্রদল এবং শিবিরের নেতাকর্মীরা যেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নেতাকর্মীদের আক্রমণ করতে পারে সে জন্য পুলিশ বাহিনী তাদের সাহায্য করেছিল। এটি আমাদের দেশের খুবই বেদনাদায়ক একটি ঘটনা, এই দেশের পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না! তারা শুধু সরকারের নয়, সরকারি দলের আজ্ঞাবহ-অনুচর। আন্দোলনটি গড়ে তোলার সময় কোন একটি সভায় আমিও বক্তব্য দিয়েছিলাম। তার একটি ছবি দেখিয়ে একজন ছাত্র আমাকে বলেছিল, ‘স্যার, আপনার ঠিক পেছনে যে ছাত্রটি দাঁড়িয়ে আছে সে হচ্ছে ধর্ষকদের একজন সহযোগী!

দুঃখের কথা হচ্ছে ধর্ষককে শেষ পর্যন্ত কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। তবে যে বিষয়টি আমি কখনই বুঝতে পারিনি সেটা হচ্ছে- একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন রাষ্ট্রের আইন কাজ করবে না? একটি ছাত্র পরীকক্ষায় নকল করলে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শাস্তি দিতে পারে কিন্তু সে ধর্ষণ করলে কেন পুলিশ এদের ধরে নিয়ে যাবে না, বিচার করে আজীবন জেলে আটকে রাখবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা কেমন করে দেশের আইনের ঊর্ধ্বে থাকে?
এই পুরো দুঃখজনক ঘটনার মাঝে একমাত্র স্বস্তির বিষয় হচ্ছে ধর্ষিতা ছাত্রীটির পরিচয় কেউ জানতে পারেনি, সে তার লেখাপড়া শেষ করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পেরেছে। 

ঘটনা : অনেক আগের ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ফাইনাল পরীক্ষার একটা তারিখ ছিল, যদি কোনো কারণে একটি বিভাগও সেই তারিখে পরীক্ষা শুরু করতে না পারত তাহলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে যেত। ছাত্র নেতাদের লেখাপড়া নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই, যত দীর্ঘ সময় তারা ছাত্র হিসেবে থাকতে পারবে ততই লাভ, তাই পরীক্ষা পেছানোর ব্যাপারে তারা খুবই আগ্রহী। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এই নিয়ে খুবই ত্যক্তবিরক্ত। একবার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পেছানোর পাঁয়তারা চলছে তখন হঠাৎ করে হলের মেয়েরা সিদ্ধান্ত — নিল যেভাবে হোক তারা পরীক্ষা দেবে!

স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল উত্তেজনা, ভোরবেলা ছাত্রীরা দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে দলবেঁধে পরীক্ষা দিতে বের হয়ে এসেছে এবং ছাত্র নেতারা তাদের রাস্তা আটকে রেখে শ্লোগান দিচ্ছে, ককটেল ফাটাচ্ছে! আমরা কয়েক শিক্ষক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি বাড়াবাড়ি কিছু না ঘটে যায় সেটি দেখার জন্য। চার চারটি ঘণ্টা এভাবে কেটে গেল তখন ভাইস চ্যান্সেলর ছাত্রীদের অনুরোধ করলেন তাদের হলে ফিরে যাওয়ার জন্য, কথা দিলেন তিনি ব্যাপারটি দেখবেন। তখনই একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং করে সিদ্ধান্ত— নেয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগ এখন থেকে আলাদা আলাদাভাবে নিজের পরীকক্ষা নিতে পারবে। এখন যেহেতু পরীক্ষা শুরুর নির্দিষ্ট একটি তারিখ নেই ছাত্র নেতারা আর পরীক্ষা আটকাতে পারে না, সত্যি সত্যি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল!

ঘটনার বিশ্লেষণ : ছাত্র রাজনীতির বিভিন্ন দলের মাঝে সাপে নেউলে সম্পর্ক, একদল পারলে আরেক দলকে খুন করে ফেলে কিন্তু লেখাপড়া না করার মাঝে কিংবা পরীকক্ষা পেছানোর মাঝে তাদের ভেতরে কোনো বিরোধ নেই, তখন সবাই একসঙ্গে।

ঘটনা : তখন জামায়াত-বিএনপি আমল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরনের শ্বাসবন্ধ করা অবস্থান। তখন হঠাৎ মোটামুটি এক ধরনের ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রক্টর ঘোষণা দিলেন তারা কেউ তাদের পদ ছাড়ছেন না কিন্তু কাজ করা বন্ধ রাখবেন। প্রক্টরবিহীন বিশ্ববিদ্যালয় খুবই বিপজ্জনক জায়গা। ঠিক তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে পাশের রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের কোনো একটা বিষয় নিয়ে গোলমাল লেগে গেল। দুই দলের ভেতর মারামারি, ঢিল ছোড়াছুড়ি হচ্ছে, যেহেতু  কোনো প্রক্টর নেই তাদের থামানোর কেউ নেই। তখন পুলিশ এসে গুলি করল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ছাত্র গুরুতর আহত হলো। সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ গুরুতর আহত ছাত্রদের ঢাকা পাঠিয়ে দিল এবং ভোর রাতে খবর এলো আমাদের একজন ছাত্র মারা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাদের একজন সহপাঠীর গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার মতো একটি খবর সহ্য করার মতো নয়। মুহূর্তের মাঝে সারা বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে ফেটে পড়ল এবং ছাত্রছাত্রীরা ভাইস চ্যান্সেলরের ভবন আক্রমণ করল। তাদের সমস্ত ক্ষোভ তার ওপর এবং কয়েক ঘণ্টা জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের পর ভাইস চ্যান্সেলর তার পদত্যাগপত্র লিখে দিলেন। দুটি ট্রাক এনে ঠান্ডা মাথায় তার জিনিসপত্র তুলে বিদায় নিলেন। একজন ভাইস চ্যান্সেলরের জন্য সেটি যথেষ্ট অসম্মানজনক বিদায়।

ঘটনার বিশ্লেষণ : বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাদের সহপাঠীর মৃত্যু খুব হৃদয়বিদারক ঘটনা। এ রকম একটি ঘটনার ভেতর দিয়ে যদি বিশালসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী হঠাৎ করে সংগঠিত হয়ে যায় তা হলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। ছাত্র রাজনীতির দলগুলো সংগঠিত হলেও বিশালসংখ্যক সাধারণ ছাত্রছাত্রীর সামনে তখন তারা অসহায়। তবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাদের অর্জনটুকু ধরে রাখা কঠিন। সবাই অপেক্ষা করে তাদের উত্তেজনা কমে আসার জন্য এবং উত্তেজনা কমে আসার পর আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার কয়েক মাস পর তিনি শিবির এবং ছাত্রদলের পাহারায় আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন।

২. 
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমার ঘনিষ্ঠ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার পঁচিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে ছাত্র রাজনীতির কারণে ভালো কিছু হয়েছ সে রকম কিছু কি দেখেছ?
আমার তখন গণজাগরণ মঞ্চের কথা মনে পড়ল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা তরুণদের সেই অবিশ্বাস্য আন্দোলনের সময় কিন্তু ছাত্রদের প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সব ক’টি রাজনৈতিক দল সাহায্য করেছিল। শুধু তাই নয়, মে মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যাবেলা আমি শাহবাগে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর দিয়ে আক্রমণ করেছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের প্রতিহত করেছিল।
কাজেই আমরা কি জোর দিয়ে বলতে পারি এই দেশে ছাত্র রাজনীতির আর কোনো দরকার নেই, ভবিষ্যতেও কখনো দরকার হবে না? 

লেখক : শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক