হাসান মতিউর রহমানের লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলী'র সুর করা এবং সাবিনা ইয়াসিনের কন্ঠে গাওয়া "যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই" গানটি বঙ্গুবন্ধুকে নিয়ে এ পর্যন্ত লেখা একটি অন্যতম গান। এ গানে লেখকের, সুরকারের আর গায়িকার কন্ঠে ঝরেছে সে মহান নেতাকে ফিরে পাবার আকুতি। দুঃখের পদাবলী হয়ে এ গান দাবি করে যায় বঙ্গবন্ধুর শারিরীক উপস্থিতি। কিন্তু এতো আকূল আবেদনও ফিরে আসেনি অভিমানি জাতির পিতা।
চিরনিদ্রায় চলে যাওয়া শেখ মুজিবকে একনজর দেখতে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী বঙ্গবন্ধুর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া যায়। মধুমতির পাড়ে ছায়া ঢাকা পাখিডাকা গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায় শুয়ে আছেন জাতির পিতা শেখমুজিবুের রহমান। টুঙ্গীপাড়ায়র আগে আরও দু'বার গোপালগঞ্জে এলেও যাওয়া হয়নি তাঁর সমাধি সৌধে। ব্যস্তসূচি নিয়ে এলেও এবার আর তাঁর সমাধি না গিয়ে ছাড়িনি। ঘাতকের বুলেট যে বক্ষ বিদীর্ণ করলো সে বুকেই তিনি জমা রেখেছিলেন-এ দুঃখিনী দেশটাকে। সেখানে তাঁর বিশাল পোট্রেট-এর পাশে দাঁড়াতেই মনে হল- ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নেতা চলে গেলেন ঠিকই। কিন্তু খুনীরা তাকে এখানে সমাহিত করার কারনে সেই স্মৃতিসৌধই আজ পরিনত হয়েছে - বাঙ্গালীর অন্যতম তীর্থস্থানে। মধুমতি নদী বিধৌত, সবুজ শ্যামল এ অপাপবিদ্ধ এ জনপদ টুঙ্গীপাড়া- যেখানে ১৯২০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানেই মাতা-পিতার কবরের পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গীপাড়া গ্রামে স্বাধীনার সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধটি অবস্থিত। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এই সমাধিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মধুমতির প্রশাখা বাইগার নদীর পাড়ে প্রায় ৩৯ একর জমির উপর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধটি নির্মাণ করে।
গ্রিক স্থাপত্য শিল্পরীতির ছোঁয়ায় লাল সিরামিকের ইট এবং সাদা-কালো টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে বেদনার প্রতীক বোঝাতে। কমপ্লেক্সের সামনের উদ্যান পেরিয়ে গেলেই তাঁর কবর। বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশেই তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুনের কবর। এই তিন কবরকে ঘিরেই মূল সৌধটি নির্মিত। চারদিকে কালো টাইলস ও মাঝখানে শ্বেতশুভ্র টাইলসে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। উপরের অংশ ফাঁকা। কবর তিনটি ঘিরে রাখা হয়েছে সংক্ষিপ্ত রেলিং দিয়ে।
সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার এক গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধিসৌধের ওপর দেয়ালে জাফরি কাটা। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো আসে। উপরে কারুকাজ করা কাঁচ ভেদ করেও আলো ছড়িয়ে পড়ে কবরে। এ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনীকেন্দ্র, মসজিদ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, উন্মুক্ত মঞ্চ, বকুলতলা চত্বর, স্যুভেনির কর্নার, প্রশস্ত পথ, মনোরম ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়।
বাংলাদেশের স্বাধনীনতার প্রতীক বঙ্গবন্ধু। তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়েই লিখে গেলেন দেশপ্রেমের অমোচনীয় স্বাক্ষর। দেশের মাটিতে শুয়ে মহান এ নেতা হয়ে থাকবে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকার প্রেরণা
লেখক : মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী